বাবলাবন হত্যাযজ্ঞে শহিদ মির্জা আজিজুর রহমানের পরিবারের মানবেতার জীবন

আপডেট: নভেম্বর ২৪, ২০১৬, ১১:৫৮ অপরাহ্ণ


ওয়ালিউর রহমান বাবু
শহিদ মির্জা আজিজুর রহমানকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাজশাহী শহরের শ্রীরামপুর বাবলাবন বধ্যভূমিতে অন্যদের সাথে হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় অন্যদের সাথে মাটিচাপা দেয়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শহিদ মির্জা আজিজুর রহমান রাজশাহী শহরের নাম করা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও তার আদর্শের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন-প্রতিরোধ সংগ্রাম সংগঠিত করায় পাকিস্তানপন্থিদের কু-নজরে পড়েন। পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী শহর দখল করে নিলে তার পরিবার নিয়ে সীমান্ত পার হতে না পেরে রাজশাহী শহর ছেড়ে কালিগঞ্জহাটে আশ্রয় নেয়। একমাস পর রাজশাহী শহরে ফিরে ব্যবসা করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করতে থাকলে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা তা জেনে ফেলে। পঁচিশ নভেম্বর রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী শহরের কুমারপাড়ায় তার বাড়ির দরজা ভেঙ্গে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে এলেন না। তথ্য অনুযায়ী দেশ স্বাধীন হবার পর ঊনিশে জানুয়ারি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো শ্রীরামপুর পদ্মা নদীর চরে বাবলা বনে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নৃশংস নির্যাতনে নিহত কয়েকজনের মৃতদেহ বালির মধ্যে দড়িবাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এখবর পেয়ে শহিদ মির্জা আজিজুর রহমানের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, ঘনিষ্টজনেরা সেখানে গিয়ে রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শহিদ আজিজুল হক চৌধুরী, শহিদ মকবুল চৌধুরী, শহিদ আলতাফ হোসেন, শহিদ মীর আব্দুল কাইয়ুম, শহিদ আবুল হোসেন, শহিদ চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন, শহিদ তৈয়ব আলী, শহিদ নওরোজদৌল্লা খান, শহিদ আমিনুল হক চৌধুরী প্রমুখের মৃতদেহের সাথে তার বিভৎস গলিত মৃতদেহ সনাক্ত করে সেখান থেকে উদ্ধার করে এনে রাজশাহী শহরের কাদিরগঞ্জ গোরস্থানে দাফন করলেন।
মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বাধীনতা স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান শহিদ মির্জা আজিজুর রহমানের স্ত্রী সাবেরা বেগমকে একটি চেক ও শহিদ পরিবারের মর্যাদা দিয়ে সনদপত্র দেন। এই টুকুই, এরপর এতবছর হয়ে গেলেও আর কেউ কোনদিন পরিবারটির খোঁজখবর বা তাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন নি। মূল্যায়ণ হলো না শহীদ মির্জা আজিজুর রহমানের, মূল্যায়ণ হলো না সহজ সরল পরিবারটির। যাদের এগুলি দেখা উচিৎ বা ভাবা উচিৎ তাদের কোন উদ্যোগ নেই। অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও পরিবারটি একটু ভালভাবে জীবন যাপনের কোন সুযোগ পাচ্ছে না। মির্জা আজিজুর রহমানের মূল্যায়ণ কি হবে না? মানবেতার জীবন যাপনের মধ্যদিয়ে কি পরিবারটি শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যাবে? শহিদ মির্জা আজিজুর রহমানের ছেলে মির্জা মোবারক বিভিন্ন দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে ও নানা সমস্যার মধ্যে থেকে কোন রকমে পরিবারটি হাল ধরে রেখেছেন। কিন্তু কতদিন এভাবে চলবে তার প্রশ্ন। তাদের বাবা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, এতে পরিবারটি গর্বিত কিন্তু তার বাবার অবদান কে মূল্যায়ন করতে বাঁধা কোথায়? পরিবারটি সামান্য একটু ভালভাবে জীবন যাপনের সহযোগিতা কী পেতে পারে না? তাদের বাবা শহিদ মির্জা আজিজুর রহমান বেঁচে থাকলে হয়তো তাদের এই অবস্থায় পড়তে হতো না। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছোট বোন ইয়াসমিনকে সুস্থ করে তুলতে তারা হয়ে গেছে নিঃস্ব। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস আদরের বোনটিকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি। অনেক কষ্ট নিয়ে  সাবেরা বেগমও না ফেরার দেশে চলে গেছেন। মির্জা মোবারকের মেজ ভাই মির্জা মজিবুর রহমান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেনÑ বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি কর্মহীন। ছোটভাই মির্জা সেলিমের কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ হয় নি। পরিবারের আর যারা আছেন তারাও ভাল নেই। তারা কষ্টের সাথে অমানবিক জীবন যাপন করছে।
মানবতার দিক বিবেচনা করে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এই শহিদ পরিবারটিকে মানবেতার জীবন থেকে রক্ষা করে একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে তাদের পাশে কী কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন না? সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করলে এই শহিদ পরিবারটি সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পাবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক