মাহী ইলাহি:
গত কয়েক বছরে রাজশাহীতে মাছ চাষ কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে কৃষিজমি কমেছে ১৫ হাজার হেক্টরও বেশি। কৃষিজমির একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। মাছ চাষে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষিজমিতে পুকুরখনন করছেন মালিকরা।
মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিকে সাফল্য হিসেবে দেখছে মৎস্য দফতর। তবে কৃষি দফতর বলছে, বাণিজ্যিক এসব পুকুর খনন হয়েছে আবাদি জমিতেই। অপরিকল্পিতভাবে যচ্ছেতাই পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। চাপও বাড়ছে পরিবেশের ওপর।
রাজশাহী মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২০১৭ সালে জেলায় পুকুরের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ২৯৪ হেক্টর। এর মধ্যে বাণিজ্যিক মাছের খামার ছিল তিন হাজার ৪৬২ হেক্টর জমিতে। ২০১৮ সালে বাণিজ্যিক খামার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩০৯ হেক্টরে। ২০২১ সালে ১৩ হাজার ১৫০ একর জমিতে বাণিজ্যিক মাছের খামার হয়েছে ৪৩ হাজার ১৯৬টি। এ বছরে ৮৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। ২০২২ সালে ৮৫ হাজার ৩৩৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে জেলায় মোট জমির পরিমাণ দুই লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। গত আট বছরে নতুন পাঁচ হাজার পুকুর কাটা হয়েছে। ফলে কয়েক বছরে পুকুরসহ অন্যান্য কারণে শুধুমাত্র জেলায় ফসলি জমি কমেছে ১৫ হাজার হেক্টর।
কয়েক বছর ধরেই গোদাগাড়ী, পবা, তানোর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। শীত শুরু হওয়ার আগে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন হচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কিছু অসাধু ব্যক্তি আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদারসে চলছে খননযজ্ঞ। কমছে কৃষিজমি, বাড়ছে কৃষিশ্রমিকের বেকারত্ব। ভেঙে পড়ছে গ্রামীণ নিরাপত্তা বেষ্টনী। আবাদের ফাঁকে ফাঁকে গরু-ছাগল পালনের তৃণভূমি থাকছে না। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই আইনে। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোকে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করেন তারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রাজশাহী আঞ্চলিক সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল বলেন, ভূমি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনগুলোতে ভূমির ধরণ রূপান্তর করা নিষিদ্ধ। তাছাড়াও, ২০১৩ সালের বাংলাদেশ পানি আইনে প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রবাহকে বাধা দেওয়া কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে। কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের খসড়া, যেখানে পরিষ্কারভাবে কৃষি জমি রূপান্তরে নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ আছে, সেটি এখনো পূর্ণতা পায়নি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, জেলায় গত কয়েক বছরে পুকুর খননের কারণে অনেক ধানের জমি কমেছে। তবে সরকারি নির্দেশনা থাকার পরেও পুকুরগুলো গড়ে উঠেছে। এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। অন্যান্য চাষাবাদ কমে যাচ্ছে।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত কয়েক বছরে রাজশাহীতে প্রায় দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন বেড়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে পুকুরও বেড়েছে কয়েক গুণ। মাছ চাষ করে অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ চাষের জন্য চাষিদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে জেলায় মাছ এখন উদ্বৃত্ত থাকছে। যা দেশের বিভিন্ন জেলা এবং দেশের বাইরে রফতানি করে বিপুল অর্থ আয় হচ্ছে।
এদিকে, রাজশাহী অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আবাদি জমিতে পুকুর খননকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছর ব্যাপক ফসল নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া পরিবেশের ওপর চাপও বাড়ছে।