মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা বিসিএসের জন্য রেকর্ডসংখ্যক আবেদন পড়েছে। ৩৮ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য আবেদন করেছে প্রায় ৪ লাখ চাকরিপ্রার্থী। যা গতবারের চেয়ে প্রায় দেড় লাখ বেশি। অথচ পদ রয়েছে মাত্র ২ হাজারটির মত। বৃহস্পতিবার আবেদন গ্রহণ শেষ হয়েছে।
গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে আবেদনকারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সরকারি চাকরির প্রতি আগে থেকেই অনেকের আগ্রহ থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগ্রহ এতটা বাড়ার কারণ কী? অনেকে বলছেন,পরিবারের মানসিকতা হলো যে সরকারি চাকরি করতে হবে, ক্ষমতা থাকতে হবে, বিয়ে করার জন্য এই চাকরির গ্রহণযোগ্যতা বেশি ইত্যাদি। অনেক শিক্ষার্থী পাশ করার পর ৪-৫ বছরও কাটিয়ে দিচ্ছেন প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির জন্য। অন্যদিকে অনেকে বেসরকারি চাকরি ছেড়েও সরকারি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। তবে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ মনে করেন, এর পেছনে সরকারি চাকরিতে বেতন বাড়ানো একটি বড় কারণ। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম থাকায় চাকরি তৈরি হচ্ছে না এবং উদ্যোক্তা হবার ঝুঁকিও অনেকে নিচ্ছেন না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেবেও দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না এবং চাকরির সুযোগ কম। ফলে সরকারেরই যতটুকু বিনিয়োগ সেজন্য সেখানে একটা ঝোঁক বেশি। অধ্যাপক আকাশ মনে করেন, সরকারি চাকরির বেসরকারি খাতের একটি অনভিপ্রেত ব্যর্থতারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি মনে করছেন। তাই সরকারকে এ বিষয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বলেছেন, আজ একটা চাকরির জন্য যুবকরা দৌড়াদৌড়ি করে। কিন্তু আমরা চাই না তারা এটা করুক। আমি তরুণদের বলব, চাকরি না খুঁজে নিজেই উদ্যোক্তা হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, কর্মসংস্থান প্রত্যাশী যুবসমাজের কাছে কর্মসংস্থানের সংজ্ঞাটা যথেষ্টই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। কর্মক্ষম যুবসমাজের অধিকাংশই মনে করে কর্মসংস্থান বলতে একটি চাকরি, বিশেষত সরকারি চাকরিকে বুঝায়। কিন্তু কর্মসংস্থান বলতে তো কেবল সরকারি চাকরি করা বুঝায় না, কর্মসংস্থানের পরিধি কোনোভাবেই এতটা সংকীর্ণ নয়। চাকরি, বিশেষত সরকারি চাকরি কর্মসংস্থানের অনেকগুলো সেক্টরের মাঝে কেবল একটি সেক্টর মাত্র, এর বেশি কিছু নয়।
চাকরি, বিশেষত সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকদের প্রতি আহ্বান থাকবে প্রতিবেশী দেশকে অনুসরণ নয় বরং নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে নিয়োগ পরীক্ষার এমন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করুন যা শিক্ষার্থীদের স্নাতকে অধ্যয়নকালীন বিষয়গুলোর আলোকে শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়ন করা যায়, যাতে করে নতুন করে আবার গুরুত্বপূর্ণ দুই-তিনটি বছর কারো নষ্ট করতে না হয়। আর অবশ্যই সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা লাঘব করা উচিত। নিয়োগ প্রক্রিয়া কোনোভাবেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুক্তিযুক্ত নয়, এক বছরের মধ্যেই চাকরি প্রত্যাশীরা যেন সকল প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চাকরিতে যোগ দিতে পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। আর চাকরি প্রত্যাশীদের কথা বলব, চাকরি বলতে শুধু সরকারি চাকরিকে বিবেচনা নয় বরং প্রাইভেট সেক্টরেও যে কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ সেটিও স্মরণ রাখতে হবে। নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস এবং ঝঁকি নেওয়ার সাহস থাকলে অবশ্যই প্রাইভেট সেক্টরে আপনার সাফল্য সরকারি সেক্টর থেকে কোনো অংশে কম আসবে না।
এবার আসি কর্মসংস্থানের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ সেক্টরে, হ্যাঁ আমি উদ্যোক্তার কথাই বলছি। কর্মসংস্থানের সব থেকে মর্যাদাপূর্ণ, স্বাধীন এবং চ্যালেঞ্জিং পেশা হলো উদ্যোক্তা। একজন উদ্যোক্তা তার সৃজনশীল চিন্তাশক্তি দিয়ে নতুন সম্ভাবনার খোঁজ করে, নতুন কোনো ব্যবসায়ী ভাবনা কিংবা পুরাতন ধারাটাকে নতুন করে সাজিয়ে একজন উদ্যোক্তা তার উদ্যোগটির বাস্তবিক রূপ দেয়। একজন উদ্যোক্তা একটি চাকরির সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হয় না বরং সে হাজারটি চাকরির সুযোগ তৈরি করে। সমস্যা হচ্ছে আমরা চাই কর্মক্ষম সবার কর্মসংস্থান হোক, তবে আমরা কেউ উদ্যোক্তা হতে চাই না কিংবা আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে পারছে না। যার অন্যতম কারণ, ঝুঁকি গ্রহণে আমাদের স্বভাবসিদ্ধ অনাগ্রহ, নতুন ব্যবসা পরিচালনার উপযুক্ত পরিবেশের অভাব এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আর্থিক সমস্যা। একজন উদ্যোক্তা তার উদ্যোগটি বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ আর্থিক সাপোর্ট প্রয়োজন হয় তা সে তার পরিবার থেকে কিংবা ব্যাংক থেকে পায় না, যার ফলস্বরূপ অধিকাংশ সম্ভাবনাময়ী উদ্যোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রতিটা ব্যাংকেই তাদের বার্ষিক রিপোর্টে উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে, তবে তাদের ঋণ প্রদানের অধিকাংশই হয় যারা ইতোমধ্যে উদ্যোক্তা হিসাবে সফল কিংবা প্রতিষ্ঠিত। নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদান করে তারা ঝুঁকি নিতে চায় না, করলেও তার সংখ্যা খুবই সামান্য। বেশি করে উদ্যোক্তা তৈরি করতে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে তেমনি নতুন উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনীয় উদ্যোগ বাস্তবে রূপ দিতে সরকার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। তাই চাকরি প্রার্থীর পরিবর্তে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে অগ্রসর হোক।