নিজস্ব প্রতিবেদক
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে অস্থায়ী খণ্ডকালীন অপারেটর কাম রেকর্ডকিপার নিয়োগে নতুন নীতিমালা করা হয়েছে। তবে এবার আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার টাকা। এছাড়াও পুরুষদের মতো নারীদেরও রাতে থাকতে হবে গভীর নলকূপের কক্ষে। নারীদের কাজের ক্ষেত্র একই।
তবে এই গভীর নলকূপ দখল নিতে মরিয়া হয়ে আছে একটি প্রভাবশালী চক্র। বিভিন্ন উপজেলার রাজনৈতিক নেতাসহ অনেকেই সক্রিয় আছে। দখল নিয়ে বেশকিছু স্থানে সংঘর্ষের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে বিএমডিএ এমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়াও শেষ পর্যায়ে। অপারেটর পদে নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎ নেওয়া শুরু হয়েছে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) থেকে। যা শেষ হবে আগামী জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের ১৩৫টি উপজেলা এখন বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধিভুক্ত এলাকা। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিএমডিএর গভীর নলকূপের সংখ্যা ১৫ হাজার ৯৬৫টি। এর মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা, নওগাঁর নিয়ামতপুর, সাপাহার ও পোরশায় রয়েছে ১ হাজার ৯৮০টি গভীর নলকূপ।
রাজশাহীতে বিএমডিএর গভীর নলকূপের আধিপত্য নিতে চলছে নানামুখী তৎপরতা। ১৭ বছর ধরে যারা গভীর নলকূপের অপারেটর ছিলেন তাদের বাদ দিতে কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর থেকে বিভিন্ন এলাকায় গভীর নলকূপ দখলের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
বিএমডিএর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেছে, খণ্ডকালীন অপারেটর হতে অফেরতযোগ্য এক হাজার টাকার বিনিময়ে আবেদন ফরম গ্রহণ করতে হবে। এতে জামানত হিসেবে দিতে হবে পুরুষদের ২০ হাজার টাকা ও নারীদের ১৫ হাজার টাকা। আগে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য ছিল সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নারীদের রাতের বেলাও থাকতে হবে সেচচালিত কক্ষে। অপারেটরের শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে এসএসসি পাস। ফরমের দাম ১০০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার। কমানো হয়েছে নলকূপ চালানোর সময়। এতে করে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে, দাবি চাষিদের।
চারঘাট উপজেলার হলিদাগাছী নাওদাড়া মাঠের একটি গভীর নলকূপের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। এতে ওই মাঠের প্রায় ৩৫০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন আবাদের সেচ সংকট দেখা দিয়েছে। চার দিন ধরে প্রয়োজনীয় পানি না পেয়ে বিপাকে কৃষকরা। আর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের কচুয়া মাঠে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ জবরদখলের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় বিবাদমান দুটি পক্ষের মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বিষয়টি নিয়ে অপারেটর জিয়াউর রহমান জিয়া দখলদার রুবেল হোসেনের নাম উল্লেখ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
তবে এই অপারেটর নিয়োগের জন্য আবেদন ফরম বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে বিএমডিএর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ফরম নিলেই দিতে হচ্ছে এক হাজার টাকা করে। এর আগেও ফরম জমা নিয়েছিলেন বিএমডিএতে। ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে গুনতে হয়েছিল ওই সময়। আগের ফরম বাতিল করে নানা নিয়ম বেঁধে নতুন ভাবে আবেদন ফরম কেনার জন্য নোটিশ দেয় বিএমডিএ।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী সরকারের পতন হলে গভীর নলকূপে তালা দেয়ার হিড়িক পড়ে। এক প্রকার বাধ্য হয়ে অপারেটর নিয়োগের জন্য আবেদন নেয়া শুরু করেন বিএমডিএ। সেই ফরম জমা দেয়ার জন্য নির্ধারিত দিন ধার্য করা হয়েছিল। একটির বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছিল প্রায় ১০টির মতো। সে সময়ের টাকাও খোয়া গেছে।
প্রায় ৫১৬ টি গভীর নলকূপের বিপরীতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার আবেদন পড়েছিল। ফরম প্রতি ২০০ টাকা করে খরচ হলে ৫ হাজার আবেদনের বিপরীতে লক্ষাধিক টাকা খোয়া যায় আবেদনকারী কৃষকদের। কিন্তু অধিক বাণিজ্যের কারণেই আগের আবেদন বাতিল করে মোটা বাণিজ্য করতেই আবেদন ফরমের ১ হাজার টাকা করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
গূত্রে জানা যায়, গত অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিএমডিএর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন. সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ছোটভাই এম আসাদুজ্জামানকে। তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর নতুন নিয়ম জারি করে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে গভীর নলকূপের অপারেটর নিয়োগের জন্য আগের আবেদন বাতিল করে নতুন নিয়ম কানুন জড়িয়ে দেন।
কৃষকদের ভাষ্য, গভীর নলকূপে অপারেটর নিয়োগ হয় দলীয় বিবেচনায়। গত ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের কব্জায় ছিল গভীর নলকূপগুলো। সরকারের পতনের পর সব ডিপে একাধিক তালা মারা হয়। নিয়োগের আগেই দখল হয়ে গেছে নলক’পগুলো, তাহলে নিয়োগের জন্য আবেদন কেন- এমন প্রশ্ন কৃষকদের।
মঞ্জুর রহমান নামে গোদাগাড়ীর চাষি জানান, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জামানতের নতুন যে নিয়ম করা হয়েছে, তাতে বর্তমান অপারেটররা বাদ পড়বেন। পছন্দের লোকজনকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দিতে এমন নিয়ম করেছেন বলে দাবি তার।
বিএমডিএ নির্বাহী প্রকৌশলী এএসএস দেলোয়ার হোসেন বলেন, নারীদের রাতে বেলা থাকতে হবে না। কারণ সেচ সবসময় চলেও না। পাম্প চালানো অবস্থায় থাকতে হবে। যদিও সেটা রাত হয় তবে তার প্রতিনিধিকে থাকতে হবে।
বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, গভীর নলকূপ অপারেটর নিয়োগে যে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, সেটি ভাঙতে নতুন নীতিমালা। এ ছাড়া এতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমবে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আগে অপারেটর নিয়োগে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। কারও হেদায়েত হয়ে এখানে অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সেটি ভাঙতে নতুন নীতিমালা। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারও কমে আসবে।’