মঙ্গলবার, ৩০ মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
১০ শতাংশ নেহাতই কম নয়Ñ জঙ্গিবাদ এমনই এক উন্মত্ততা- এর এক শতাংশও সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য মোটেও শুভ নয়। এই ১০ শতাংশের মধ্যে আমজনতা নেই। আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীরা। খুবই ভয়ঙ্কর এবং উদ্বেগজনক তথ্য এটি। একে অবহেলার নূন্যতম কোনো সুযোগ নেই।
দৈনিক সোনার দেশে বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীকৃত একটি জরিপ ফলাফল সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১০ শতাংশ সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে। গত জুলাইয়ে গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জিম্মি নিহতের পর দেশব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারের মধ্যে এই জরিপ কার্যটি পরিচালিত হয়। এতে দেখা যায়, সন্ত্রাসবাদকে যারা সমর্থন করছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। বয়সের দিক দিয়ে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণদের (১৮-২৫ বছর) মধ্যে এ ধরনের ভাবনার প্রাধান্য ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশের।
২৭ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর সন্ত্রাসবাদ ও তারুণ্য নিয়ে ২০টি প্রশ্নের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার শিক্ষার্থীর মতামত নেয়া হয়। ৬৬৩ জন ছেলে ও ৩৩৭ জন মেয়ে শিক্ষার্থী জরিপে অংশগ্রহণ করেন।
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান বাংলাদেশে হয়েছেÑ এটা এই প্রমাণ করে যে, জঙ্গিবাদ দর্শনের সমর্থক ও মানবতাবিরোধী ওই দর্শনে বিশ্বাসীরা এই সমাজের মধ্যেই আছে। এবং এই দর্শন সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ ও সম্পদ বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশে বিদেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা রয়েছে। অর্থাৎ সভ্যতার বিরুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধের নিয়ামক শক্তি দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যমান। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে মোটেও কার্পণ্য করে না। এ ব্যাপারে দেশবাসী ইতোমধ্যেই বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যারা আধুনিক ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করে পশ্চাদপদ ধারণা চিন্তায় পোষণ করছে কেন? এর উত্তর খুঁজে বের করা খুবই জরুরি।
আমরা জানতাম মাদ্রাসায় পড়–য়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদে দীক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু এরসাথে আরেক সত্য জাতির সামনে প্রকট হয়েছে যে, উচ্চবিত্তের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়ারাও এই জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিচ্ছে এবং তারা নির্বিচার মানুষ হত্যাসহ ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে মোটেও অবহেলা করার করার সুযোগ নেই। শুধু আইনি অ্যাকশনে এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর আর্থ-সামাজিক কারণগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে দুর্নীতি ও বৈষম্য দুটি ভয়ঙ্কর উপাদান যা জঙ্গিবাদে মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। বর্তমান সময়ে মানুষ এতো বেশি টাকার পিছনে হন্যে হয়ে ঘুরছে যে, পরিবার- পরিজনের সাথে সান্নিধ্যের প্রয়োজনও মনে করছে না। উচ্চবিত্তের সন্তানরা দুহাত খুলে ব্যয় করতে পারছে- তাদের দেখার কেউ নেই। অনুশাসন না থাকার কারণে পারিবারিক শ্বাশত সম্পর্ক থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। মাটি ও মানুষের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা সহজেই সবকিছু পেতে চায়। মৃত্যুর পর বেহেতস্তও শটকার্ট পেতে চায়। আর জঙ্গিদীক্ষা আকর্ষিত স্লোগানই হলোÑ ‘বাঁচলে গাজী, মরলে শহিদ।’ আর অনন্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য- হুর-পরিদের সমারোহ। মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতির সাথে সংযোগহীনতায় এমন ভাবনা তো স্বাভাবিক। সংস্কৃতির সাথে মানুষের ব্যবচ্ছেদ ক্রমশই একটি অমনাবিক উগ্রপন্থার সংস্কৃতিকে সামনে নিয়ে এসেছে। অথচ বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির ধারা যে মানবম-লিকে একই জায়গায় সম্প্রীতি ও সৌহার্দের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের জয়গান মানবকল্যাণে ব্রতী করে তুলেছিল। সেই ঐতিহ্য ও গৌরবের ধারাবাহিকতা কেন রক্ষা করা গেল নাÑ তার কারণ খুঁজে পাওয়া খুবই জরুরি। যে সংস্কৃতির চর্চা-জাগরণ মানুষের আঙিনায় ছিলÑ সেই শেকড়ের অনুসন্ধান হওয়া আজ খুবই প্রয়োজন। যার আঙিনায় মানবতার গান ঝংকরিত হয়, সেই মানুষেরা তো মানুষ হয়Ñ জঙ্গি হয় না।