বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩১ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
ড. মো. মিজানুর রহমান:
বিশ্ব পরিবেশ দিবস স্থানিয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্পদের পরিমিত ব্যবহার, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিনির্মাণের একমাত্র আদর্শ পক্রিয়া যা ইতোমধ্যেই সকলের কাছে গৃহীত ও প্রশংসিত হয়েছে। উপরোক্ত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ৫-১৬ জুন সুইডেনের স্টকহোমে মানবিক পরিবেশ বিষয়ে সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়।
এই সময় জাতিসংঘের সাধারণ সভায় প্রতিবছর ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৭৪ সালে প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপিত হয় যার থিম ছিল Only One Earth। ১৯৭৪ সাল থেকে সিদ্ধান্ত হয় প্রতিবছর নতুন একটি দেশ নতুন একটি থিম নিয়ে স্বাগতিক দেশের ভূমিকা পালন করবে। সেই থেকে প্রতিবছর বিশ্বের এক একটি দেশ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ বিষয়ে নতুন থিম নিয়ে স্বাগতিক দেশ হিসেবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের আয়োজন করে থাকে।
এবারের থিম- Land restoration, desertification and drought resilience Ges এবং স্লোগান- Our land our future, we are #geneartion restoration. এবং আয়োজক দেশ সৌদি আরব। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বিশ^ পরিবেশ দিবসের থিম ভাবানুবাদ করে- “করবো ভূমি পুনুরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা” এবারের থিমে তিনটি বিষয় সুর্নির্দিষ্ট- ভূমি পুনুরুদ্ধার অর্থাৎ অবক্ষয়িত ভূমি পুনুরুদ্ধার করা; দ্বিতীয় বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনের করণে বিশ^ব্যাপি ক্ষরার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা কমিয়ে নিয়ে আসা এবং তৃতীয় বিষয় হচ্ছে মরুময়তা কমিয়ে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন নিয়ে এসে সৃষ্ট ক্ষরার সঙ্গে অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, UN এর তথ্যমতে বিশ্বে মাত্রাগত ও পারিসরগত মরুময়তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০২-২০০৩ সালে খরাভুক্ত জমির পরিমাণ ছিল মোট ভূমির শতকরা ৪৩.৯২ ভাগ (৩.১৩ বিলিয়ন হেক্টর), যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৪-২০০৭ সালে দাঁড়ায় শতকরা ৪৫.৯৭ ভাগ (৩.২৫ বিলিয়ন হেক্টর), ২০১৬-২০১৯ সালে শতকরা ৫০.০৮ ভাগ (৩.২৮৩ বিলিয়ন হেক্টর)। এক অনুমান অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাদাগ শতকরা ৯০ ভাগ জমি খরার কারণে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। যাহোক, এক দিকে যেমন খরাভূক্ত এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি চরম (Extreme) এবং গুরুতর (Severe) খরাভূক্ত এলাকার আয়তনও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবছর বিশ^ নিউ মেক্সিকো বা পোল্যান্ডের সমান উর্বর কৃষি জমি মরুময়তার কারণে হারাচ্ছে।
United Nations Convention to Combat Desertification এ বলা হয় মরুকরণে ২৫০ মিলিয়ন লোক আক্রান্ত এবং ২০৪৫ সাল নাগাদ ১৩৫ মিলিয়ন লোক মরুময়তার কারণে জীবিকার অন্বেষণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার স্থানান্তরিত হবে। ফলে বিশে^ মানবসভ্যতা মারত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই মরুময়তা বৃদ্ধির পেছনে চালিকা শক্তি কী এবং ফলাফলই বা কী হতে পারে? প্রথমে যদি মোটা দাগে চালিকা শক্তিসমূহের নাম বলি তাহলে বলতে হয় আধুনিক কৃষিব্যবস্থার প্রয়োগ; প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূলে এনে কৃষিকাজের সম্প্রসারণ ঘটানো, প্রচুর পরিমাণে খনিজদ্রব্য উত্তোলন ও ব্যবহার, ব্যাপক পরিমাণে বনজসম্পদ ধ্বংস, ব্যাপক শিল্পায়ন, উন্নত পরিবহণব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণসহ ভূমি ব্যবহারের আমূল পরিবর্তন।
২০৫০ সাল নাগাদ বিশে^র জনসংখ্যা হবে প্রায় ১০ বিলিয়ন। FAO এর মতে এই বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করতে শতকরা ৫০% খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এই থেকেই বোঝা যায় কৃষি কাজে অব্যবহার যোগ্য মৃত্তিকাকে ব্যবহার যোগ্য করা সহ ভূমির প্রগাঢ় ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যা পরিবেশ অক্ষুণ্ন্নরেখে অর্জন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে কৃষিকাজে পানির বর্ধিত চাহিদা মোকাবেলা করা। ২০৫০ সাল নাগাদ পানির চাহিদা শতকরা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।
কৃষিকাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারনে ইতোমধ্যেই পানির লেভেল অনেক নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ব্যবহারযোগ্য ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি কমে গেছে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি পূরণ হতে পারছে না। যা পরোক্ষভাবে মরুময়তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বনভূমিকে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ু দূষণের শোধনাগার বলা হয়। কিন্তু বিশ্ব ব্যাপি এই বনভূমির পরিমাণ আশংকাজনকভাবে কমছে। ২০০২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বে বনভূমির পরিমাণ কমেছে শতকরা ৭.৪ ভাগ। অপরদিকে ক্রমবর্ধন শিল্প-কারখানা বা কৃষিকাজের মাধ্যমে উৎক্ষিপ্ত দূষক বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করছে ফলে বিশ^ব্যাপি জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জলবায়ু হারাচ্ছে তার স্বকীয়তা। জলবায়ুর আচরণ হয়ে উঠছে অনিয়মতান্ত্রিক। ঘটছে অসময়ে কোথাও অতিবৃষ্টি আবার কোথাও অনাবৃষ্টি, কোথাও অতিরিক্ত শীত আবার কোথাও মাত্রাতিরিক্ত গরম।
একইভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনে জৈব জ্বালানির ব্যবহারও কম দায়ী নয়। এই জৈব জ্বালানির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮৫ সালে মোট জৈব জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৬৬.০৪ কোয়ডরিলিয়ন বিটিইউ যা ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ৭৭.১৮ কোয়ডরিলিয়ন বিটিইউ। সুতরাং একদিকে জৈব জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে জৈব জ্বালানি বৃদ্ধিজনিত কারণে সৃষ্ট দূষণ পরিশোধনকারী বনভূমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বিশ্ব ব্যাপী জলবায়ুর এক্সট্রিমিটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে তাপ ও বৃষ্টিপাতের অনিয়মতান্ত্রিকতার ক্ষেত্রে। যা বিশ্ব ব্যাপী মরুময়তাবৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
যাহোক, বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও এর প্রভাব কম নয়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এমনিতেই খরাপ্রবণ। বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে তাপমাত্রার আধিক্য এবং কম বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে এই বৈশিষ্ট্য আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। সুতরাং সমনের বছরগুলিতে এই মাত্রা যে আরো বৃদ্ধি পাবে তা সহজেই অনুমেয়। এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের পথ খুব সহজ নয়। কেননা বায়ুমণ্ডলের কোনো রাজনৈতিক সীমানা নেই।
তাই এক জায়গায় সৃষ্ট দূষণ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবর্তন নিয়ে আসে বিশ্ব জলবায়ুতে। বায়ুমণ্ডলের দূষণে বাংলাদেশের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য না হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাই বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনে কাজ করতে হবে এবং একই সঙ্গে পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এইরূপ কৃষিব্যবস্থা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য এমন ধরনের শস্য উদ্ভাবন এবং চাষ করতে হবে যাতে কম সেচের প্রয়োজন হয়। এছাড়া শস্য-প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।
মনে রাখতে হবে অবনয়নকৃত পরিবেশ যেমন পুনুরুদ্ধার করা জরুরি, তেমনি আমাদের কর্মকাণ্ড যেন আর পরিবেশের অবনয়ন না ঘটায় সে দিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি। সকলের সচেতনতাই পারে ভবিষৎ প্রজন্মকে দূষণমুক্ত পরিবেশ উপহার দিতে।
লেখক : প্রফেসর, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়