শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
শুভ্রারানী চন্দ
মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর অন্যতম বাসস্থান বা বসতি। এই বাসস্থান বা বসতি নিয়ে থাকে মানুষের অফুরন্ত স্বপ্ন। কেউবা বাস্তবে এ গৃহকে সাজিয়ে তোলে মনের মাধুরী মিশিয়ে। নিত্য নতুন আঙ্গিকে, নতুন সাজে সাজিয়ে তোলে তাকে। গৃহ হচ্ছে মানুষের সুখের আলয়, নিরাপদ আশ্রয়। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে পাখি যেমন ফিরে যায় আপন নীড়ে। মানুষও শত ব্যস্ততার নানা কাজের ঝক্কি-ঝামেলা সামলে ফেরে নিরাপদ আশ্রয়, পরম প্রশান্তির ঠিকানা আপন গৃহে।
এ গৃহ শুধু মানুষকে আশ্রয়ই দেয় না, দেয় নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ, ঐশ্বর্য্য, আত্মপরিচয়ের সাথে গৃহের সম্পর্ক গভীর। আমাদের সুন্দর, সোনালী ও উন্নত ভবিষ্যতের সূচনা করে এ গৃহ। গৃহের পরিবেশ যত মনোরম ও মধুময় হবে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ তত সুন্দর ও উজ্জ্বল হবে।
ভাড়া করা কিংবা নিজের ঘর যেটাই হোক না কেন গভীর মায়া-মমতা ও ¯েœহডোরে বেঁধে রাখে মানুষ তাকে। মানুষের সুচিন্তার ও সৃষ্টিশীলতার সূতিকাগার এ গৃহ। এ গৃহই মানুষের পরিচয় ও ঠিকানার সন্ধান দেয়। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চা ও মননশীলতার উৎকর্ষ সাধিত হয় সুন্দর গৃহকোণেই। হৃদয় মনের প্রসারতা ও উদারতার চর্চাকেন্দ্রও এ গৃহ। একটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও নির্ভর করে গৃহের পরিবেশের উপরে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে “বিশ্ব বসতি দিবস” এবারে এ দিনটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “-ডড়রিহম ধঃ ঈবহঃৎব”- অর্থাৎ “গৃহায়ন উন্নয়নের কেন্দ্র! গৃহ বা আবাস মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। আমাদের দেশে এখনও অনেক মানুষ আছে যারা ভূমিহীন বা ভাসমান। এই মানদ-ে তারা দরিদ্রশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এ দরিদ্রশ্রেণির আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য।
এ আবাস পরিকল্পনা হবে সুচিন্তিত, স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যসম্মত ও সুন্দর। এসব আবাসনের পরিবেশ হওয়া উচিৎ সুন্দর, খোলামেলা, নিরাপদ, থাকবে খেলাধূলাসহ বিনোদনের সুবন্দোবস্ত। অপরিকল্পিত আবাসন কিংবা শিল্পায়ন অর্থনৈতিক তথা সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। গৃহের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত। নগর সভ্যতায় যেভাবে অপরিকল্পিত উপায়ে আবাসন ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা সুস্থ পরিবেশের অন্তরায়। এমন অনেক বাড়ি আছে যেখানে মুক্ত আকাশ দেখা তো দূরের কথা সূর্যের আলোও প্রবেশ করে না দিনের বেলাতে। মুক্ত বাতাস, খোলা খেলার মাঠ এগুলো তো ভাবাই যায় না। এ ধরনের পরিবেশে শিশুর স্বাভাবিক বুদ্ধি ব্যাহত হয়-শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে। কলকারখানার কালো ধোঁয়া যন্ত্রচালিত যানবাহনের নিঃসৃত গ্যাস বাতাসকে ভারী ও দূষিত করছে প্রতিনিয়তÑ ফলে জনমানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। অপরিকল্পিত ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মানুষ নানা রোগ- বিশেষ করে ছোঁয়াচে রোগে ভোগে। ফলে তাদের স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়। শিশু কিশোরদের অসুস্থতা তাদের শিক্ষাজীবনকে প্রভাবিত করে। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিতির হার বাড়ায়, লেখা-পড়ায় অমনোযোগী করে গড়ে তোলে, সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে গড়ে উঠে এখানকার শিশুরা।
চাকরির জন্য শহরে আসা বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ আবাসন সমস্যার কারণে বস্তিতে থাকতে বাধ্য হয়। শুধু চাকরি নয়, লেখা-পড়া বা অন্যান্য নানা কাজে আসা মানুষের একটা বড় অংশই মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের নানা প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে চলতে হয় এবং এর ফলে অনেক সময় মানুষের সহজাত বা স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিও ঠিকমতো কাজ করে না, করতে পারে না। সুতরাং, মানুষের ধন-সম্পদ কিংবা সহায় সম্পত্তির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের আবাসন বা গৃহায়ন। সুস্থ, সুন্দর, স্বাস্থ্যকর ও মনোরম পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে দেশের উন্নয়নে যে কোন দেশের জন-মানব হতে পারে একটা অন্যতম প্রধান সহায়ক ও চালিকাশক্তি।
কবি নজরুল লিখেছেন-
দাও স্বাস্থ্য, দাও আয়ু
স্বচ্ছ আলো, মুক্ত বায়ু
দাও দেহে দিব্য শান্তি
দাও গেহে নিত্য শান্তি,
গৃহ সে যেমনই হোক না কেন সেখানে শান্তি চাই। আর শান্তি থাকলে সব অসুন্দরও সুন্দরে পরিণত হবে। ধন-জস-মান- সম্পদ, শৌর্য, বীর্য, জ্ঞান-মেধা, নব নব উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতায় সমৃদ্ধ দেশ জাতি গঠনে প্রয়োজন শান্তির নীড়- সুখ ও শান্তিময় গৃহ। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে যে আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে তাকে শুধু মাথা গোঁজবার ঠাঁই হিসেবে নয়Ñ পরিণত করা হোক উন্নয়নের কেন্দ্র হিসেবে-আপন মমতা ও মনের মাধুরী মিশিয়ে।