বেসামাল বিএনপি

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭, ১২:০১ পূর্বাহ্ণ

সুজিত সরকার


দেশের আদালত নয়, ১৪ দলও নয়, এবার বিদেশি আদালতে বিএনপি-কে একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে রায় দেয়া হয়েছে। সবার মনে আছে নিশ্চয়ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দিতে গিয়ে দেশের উচ্চ আদালতও জামাতকে মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আমরা সবাই জানি, বিএনপি ও জামাত একজোট, এক কল্কের সেবক। একে অপরের পরিপূরক। তাদের ৪ দলীয় জোটের অর্থ ও মাসুলের জোগানদাতা জামাত। অবৈধ অর্থ আর গু-ামিই তাদের রাজনীতি মূলধন। সেই মূলধন বিনিয়োগ করে তারা ধর্মরাজ্য (?) প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু পারে না। কারণ মানুষ সব সময়ই শান্তিপ্রিয়। সন্ত্রাস-দুর্নীতি চায় না। অর্থ-আতঙ্ক-অশান্তি আর নৈরাজ্য দিয়ে কখনো ধর্মরাজ্য কেনো ভালো কোনো কিছুই করা যায় না। তার জন্যে প্রয়োজন হয় ভালোবাসা আর শুভচিন্তা। ভালোবাসা এবং শান্তির বাণী মানুষকে শুনিয়ে মহানবী সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং সাফল্য অর্জনও করেছিলেন। সুতরাং সন্ত্রাস-খুন-ধর্ষণ-লুটপাট-দুর্নীতি কোনো রাজনীতিক কর্মসূচি নয়, নয় জনকল্যাণের আয়োজন। বিএনপি-জামাত জোট ২০০১-এর নির্বাচনের পর এবং ২০১৫-র জানুয়ারি থেকে মার্চ অব্দি তিন মাস একটানা দেশময় যে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলো, তার উপযুক্ত পাওনা দেশ-বিদেশ থেকে তারা এখন অর্জন (?) করছে। জনগণ তাদের পেছনে প্রায় অনুপস্থিত। কোনো কর্মসূচিই তাদের সফল হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জামাত নানা নামে ব্লগার-নাস্তিক ইত্যাদি অভিযোগে দেশময় খুন-খারাবি করেছে, তা নিশ্চয়ই দেশবাসী জানে। কারণ মানুষ শান্তি চায়। তাই তাদের কাছ থেকে মানুষ সমর্থন প্রত্যাহার করছে। আজকে তাদের নেতাদের মধ্যে কোন্দল। জামাতেও প্রায় সে রকম অবস্থা। কানাডার আদালতের রায় যথার্থ বলেই দেশবাসী মনে করে। এ ভাবেই সন্ত্রাসী-লুটপাটকারী আর সাম্প্রদায়িক শক্তি দুর্বল হয়। মানুষের নীরব ক্ষোভ-অবিশ্বাসের আক্রমণের শিকার হয়। এই নীরব ক্ষোভে তারা এক সময় কর্পূরের মতো উপে যাবে। এটাই বাস্তবতা। মুসলিম লীগের অস্তিত্ব নেই কেনো? কারণ তারাও বিএনপি-জামাতের মতোই আচরণ করেছে। পাকিস্তানে যে মুসলিম লীগ আছে তার শত খ-ে বিভক্ত। এরাও জনরোষে তা-ই হবে। মুসলিম লীগ বিএনপি আবরণে বাংলাদেশে রাজনীতি করে দেশবিরোধী, উন্নয়ন আর বিজ্ঞান মনস্ক বিরোধী দুর্বৃত্তায়ন করছে।
কানাডার আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপি-র নেতারা বলেছেন, রায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিএনপি-র নেতারা আরো বলেছেন, ‘বিএনপি কোনো সন্ত্রাসী দল নয়, বরং তারাই সন্ত্রাসের শিকার।’ আওয়ামী লীগের সভাপতি ম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘বিএনপি এই রায়ের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট অর্জন করলো।’ বিএনপি জনগণের ভেতর থেকে গড়ে ওঠা রাজনীতিক দল নয়। সেনা ছাউনির ভেতরে বসে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন সামরিক-বেসামরিক শক্তিধর এবং ক্ষমতালিপ্সু কিছু মানুষের আকাক্সক্ষা চরিতার্থের লক্ষ্যে গড়ে তোলা দল বিএনপি। জামাত সত্যিকারেই ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক এবং সাম্য-সম্প্রীতি বিরোধী একটি সন্ত্রাসীর দল। দেশ-বিদেশের সুস্থ ও সচেতন মানুষ তাদের চরিত্র খুব ভালোভাবে অনুধাবণ করতে সক্ষম আজ। এখন হেফাজতিরা আবার সুপ্রিম কোর্ট চত্ত্বরে নির্মিত নারীভাস্কর্য ভাঙার দাবি জানিয়েছে। তারা নাকি কঠোর কর্মসূচিও দেবে। তাদের পরামর্শ ও দাবি অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিনা মূল্যে পাঠ্যবই মুদ্রণে যে সাম্প্রদায়িকতাকরণ করেছে, সেই দাবি মানা হয়েছে বলেই আজকে আদালত চত্ত্বরের ঐতিহ্যবাহী একটি ভাস্কর্য যা সুবিচারের প্রতীক সেটা ভাঙার দাবি জানিয়েছে। এটা যদি সরকার মানে, তাহলে আগামী দিনে তারা পঠন-পাঠনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়ও নগ্ন হস্তক্ষেপ করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করবে। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করবে। ওদের এখনই রোখার সময়। গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে যারা নিজেদের দাবি করে, তাদেরই আজকে ওদের বিপরীতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গত ২৬ তারিখ বগুড়ার আদমদিঘিতে নিরাপত্তা বেষ্ট ভেঙে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরা নিরাপত্তা কর্মীদের অমনোযোগিতা এবং কর্তব্যে অবহেলারই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া আবশ্যিক।
২০১৫ সালের শুরু থেকে বিএনপি-জামাত যৌথভাবে নির্বাচন বর্জন করে সারা দেশে দিনের পর দিন হরতাল ডেকে একাত্তরের কায়দায় জ্বালাও-পোড়াও আর নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তার আগে ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে একই কায়দায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিক দল ও সংগঠনসহ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস নির্যাতন করে। করে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ, হত্যা-ধর্ষণ। সে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে-যা একাত্তরেই কেবল দেশবাসী দেখেছে। তার শিকারও হয়েছে। তাদের এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম দেশি-বিদেশি সাংবাদিকসহ বিবেকবান মানুষ পর্যবেক্ষণ করেছে। ফলে ঢাকার মিরপুরের জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা জুয়েল হোসেন ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল কানাডায় রাজনীতিক আশ্রয়ের জন্যে আবেদন করেন। তাকে সে দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাসের অনুমতি দিলেও তাদের দিয়ে নানা অনুসন্ধানের পর ২০১৬ সালের ১৬ মে সে দেশে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করে ইমিগ্রেশন দপ্তর  মন্তব্য করে, ‘সে বিএনপি করে, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। আবেদনকারী সন্ত্রাস ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত থাকায় তাকে কানাডায় বসবাসের অনুমতি দেয়া যাবে না।’ জুয়েল হোসেন কানাডার ইমিগ্রেশন দপ্তরের মন্তব্যের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে জুডিশিয়াল রিভিউ আবেদন করেন। ফেডারেল কোর্ট তাদের দেশের ইমিগ্রেশনের দপ্তরের মন্তব্য বহাল রেখে রিভিউ খারিজ করে উল্লিখিত মন্তব্য করেন। এই সিদ্ধান্ত কানাডার নয়, সে দেশের গভর্নর কাউন্সিলের। ইমিগ্রেশন দপ্তর কানাডার ক্রিমিনাল কোডের ধারা তুলে ধরে বলেন, ‘বিএনপির ডাকা হরতাল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। তাদের (বিএনপি) নেতা-কর্মীদের হাতে দেশের মালামালের ক্ষতিসাধনসহ জনজীবনকেও বিপর্যস্ত করে। পরীক্ষার বিঘœ ঘটায়। অসংখ্য নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে, বোমা মেরে হত্যা করে। যানবাহনের ক্ষতি করে। তাদের দাবি মানার জন্যে সরকারকে বাধ্য করার জন্যে দিনের পর দিন হরতাল দিয়ে মানবাধিকারকেও ক্ষুণœ করে। বিধায় এটি একটি সন্ত্রাসী দল।’ ৩২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের ৭ নম্বর কারণে উল্লেখ করা হয়, ‘বিএনপি রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে সশস্ত্র হয়ে সহিংসতায় লিপ্ত হয়। তারা বোমা-পিস্তলসহ যুদ্ধের মতো একে ৪৭ রাইফেল, গ্রেনেড এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে।’ জুডিশিয়াল রিভিউ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে বিচারক হেনরি এস. ব্রাউন বলেন, ‘কানাডার আইনে সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীর কার্যক্রমের যে সংজ্ঞা দেয়া আছে, তার আলোকে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই ওই কর্মকর্তা (ইমিগ্রেশন) তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। আদালত সে মন্তব্যকে সমর্থন করে।’ বিধায় রিভিউ আবেদনকারী জুয়েল হোসেনকে ‘কানাডায় বসবাসের অনুমতি দেয়া যায় না’।
জানি না, ২০০১ কিংবা ২০১৫ সালে জুয়েল হোসেন কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত ছিলো কি না। সেটা বাংলাদেশও তার সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে জুয়েল হোসেন বাংলাদেশ ছেড়ে কেনো কানাডায় আশ্রয় নিলেন সেটাই এখন রহস্য। এই রহস্যের জাল ভেদ করে আসল তথ্য জানা গেলে সাধারণ মানুষের বিষয়টি বুঝতে সুবিধে হয়। তবে যারা দুর্মুখ, মানে স্পষ্টবাদী মুখের ওপর কথা বলেন, তারা বলছেন, এতো মানুষ দেশে থাকতে পারছে, জুয়েল কেনো পারছেন না? নিশ্চয়ই ‘ডাল মে কুচ্ কালা হ্যায়’ মানে জুয়েল সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত ছিলো, তাই সে অপরাধী। আর সে কারণেই সে সময় থাকতেই অন্য দেশে আশ্রয় নিয়ে নিজের অপরাধকে আড়াল করতে চেয়েছিলো। শাস্তি থেকেও রেহাই পাওয়ার কৌশল হিসেবে কানাডায় আশ্রয় নিতে চেয়েছিলো। অপরাধীরা বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা অনেকেই নাম-পরিচয় গোপন করে নানা দেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বিচার করা হলেও দেশে ফেরৎ এনে রায় বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। জুয়েল হোসেনকে নিয়ে বাংলাদেশ তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। অভিযুক্ত প্রমাণিত হলে তার বিচারও করা যেতে পারে। তাকে দ্রুত দেশে ফেরৎ এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো উচিত। না হলে এ ভাবে আরো অনেকেই দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করবে। পালিয়ে শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে। ওকে অনুসরণ করে অনেক অপরাধী বিদেশে পালিয়ে যাবে। তারা থাকবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বিদেশের মাটিতে বসে কলকাঠি নাড়াবে, দেশকে সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের অভয়ারণ্যে পরিণত করবে। একাত্তরে এ ভাবে গোলাম আযমসহ অনেক যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তান আর সৌদি আরবে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা মিথ্যেচার করে ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি ওই সব দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করে জামাতকে পুনর্জীবিত করে তাদের রগকাটা-চাঁদাবাজি আর গু-ামি শুরুর সুযোগ পেয়েছিলো। এখন তারা সে অপরাধে আবার গর্তে লুকিয়েছে। নানা চক্রান্ত করছে। বিএনপি তাদের ইন্ধনও দিচ্ছে। খালেদা জিয়ার জেল হবে বলে নানা অপতৎপরতা এবং অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। বরছে জেল হলেও তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। আইনে কী আছে তা আমরা অতি সাধারণেরা জানি না। তার অর্থ বিএনপি নেতারা চান বেগম জিয়ার শাস্তি হোক, নাকি? শাস্তি হলে তারা কোমরে গামছা বেঁধে পেট্রোলবোমা, লুটপাট আর খুন-যখমের একটা টাটকা ইস্যু পাবেন। জুয়েলের মতো কর্মীদের মানবতা ও শান্তি-উন্নয়ন বিরোধী দুষ্কর্মে লাগাতে পারবে। জুয়েল হোসেনেরা বুঝেছে, তাদের ব্যবহার করে নেতা-নেত্রীরা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে লাভবান হতে বিশেষভাবে মনোযোগী হতে চান। বুঝ তাকলে জুয়েল হোসেনেরা আর সন্ত্রাস-নৈরাজ্যে যুক্ত হবে না। বরং উল্টো নেতা-নেত্রীদের অপচিন্তা, দেশবিরোধী কাজের বিরোধিতা করে মাঠে সক্রিয় থাকবে। বিএনপির মধ্যে এখন ভাঙন স্পষ্ট। জামাতেও তাই। ফলে তারা কার্যত কোনো কর্মসূচি দিতে না পারলেও দেশে অবস্থানরত অসংখ্য জুয়েলদের দিয়ে বোমা মেরে মানুষ খুন, পেট্রোল বোমা মেরে ঝলসিয়ে দেয়া, ছিনতাই, অপহরণ ইত্যাদি নানা অপকর্মে লিপ্ত হবে। সরকারকে এদের গতিবিধি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। সকল অপরাধীই মানবতার বিপক্ষে। তাই তাদের জন্যে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করতে হবে। শাস্তি দিতে হবে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজদের। দেশের উন্নয়নে, রাজনীতিক ও সামজিক স্থিতিশীলতাকে প্রতিষ্ঠা করতে মূল্যবোধ অর্জনের ধারায় শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে। তবেই দেশ উন্নয়নের রোডম্যাপে দ্রুত এগিয়ে যাবে। দেশবাসী সেটাই প্রত্যাশা করে।