ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে গবাদিপশু পাঠানো বন্ধের হুমকি || নেপথ্যে পশু গ্রহণে অনীহা ও ছাড়করণে জটিলতা

আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০১৭, ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক



রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্ত পথে ভারত থেকে গবাদিপশু আসা আমদানি বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে গবাদিপশু গ্রহণে অনীহা ও ছাড়করণে  জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় সীমান্তের এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য যে কোনো সময় বন্ধ হতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এমনকী ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এসব কারণে বাংলাদেশে গবাদি পশু পাঠানো বন্ধের হুমকি দিয়েছে। এর ফলে দেশে মাংসের দাম আরো বাড়ার যেমন আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি গবাদিপশুর মারাত্মক ঘাটতিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি সীমান্তে বসবাসকারী লোকজনসহ এই বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত প্রায় লাখখানেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়াতে পারে।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গবাদিপশু ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশের অন্যান্য সীমান্ত এলাকায়  কাঁটাতারের বেড়ার কারণে ভারত থেকে গরু  আমদানি প্রায় বন্ধ থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্ত পথেই সিংহভাগ গবাদিপশু আসে কাঁটাতার না থাকায়। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্ত পথে গবাদিপশু আমদানিতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এর ফলে  ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই। এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে আগামি ৩০ জানুয়ারির পর বাংলাদেশে গবাদি পশু পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার হুমিক দিয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে বিজিবির রিজিওন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী জানান, সরকারের দেয়া নিয়মের মধ্যে গরু আনতে বাধা নেই। সেভাবেই ভারতীয় গবাদিপশু আসছে। এক্ষেত্রে বিজিবি যথাযথ দায়িত্ব  পালন করছে।  কোনো সমস্যা  হলে সেটা স্থানীয় সমস্যা।
রাজশাহীর গরু ব্যবসায়ী কালু সেখ, মমিন, মনিরুল, সুজন ইসলামসহ অন্যরা জানান, স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়  সীমান্ত পথে আনীত গরু মহিষের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে রাজশাহী, নওগাঁ  ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় ২০টি বিট খাটাল দিয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে আসা গবাদিপশুর রাজস্ব আদায় সাপেক্ষে দেশের অভ্যন্তরে চলাচলে সহযোগিতা দিতে বিজিবি ও শুল্ক বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে দায়িত্বরত বিজিবি কর্তৃপক্ষ গরু-মহিষ আনতে যেমন বাধা প্রদান করছে, তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে কোটা ব্যবস্থা চালু করেছে। এতেই দুই দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়েছেন।
ব্যবসায়ীরা আরো জানান, বিজিবি খাটালগুলিতে গরু মহিষের কোটা চালু করে ২শ থেকে ৩শ’র বেশি গরু মহিষ ঢুকতে দিচ্ছে না। আবার সপ্তাহের সবদিন গরু মহিষ ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। বিজিবি সপ্তাহে একদিন বা দুদিন গরু আনতে দিচ্ছে সীমিত আকারে। কোন কোন খাটালে দুই সপ্তাহে একদিন গরু আনার অনুমতি মিলছে।  আবার অনেক খাটালে গরু ঢুকতেই দেয়া হচ্ছে না।  ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সীমান্তে গরু এনে বসে থাকলেও বিজিবি প্রায়ই ফেরত পাঠাচ্ছে। আবার নিয়ম মেনে গরু আনলেও বিজিবি আটক করে চালান করে দিচ্ছে।  বিজিবির এমন সিদ্ধান্তের ফলে গরু মহিষ আমদানিও আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুই দেশের সচিব পর্যায়েও গরু আনার বিষয়টিকে অনুমোদন করা হয়েছে। এরপরও বিজিবি সরকারের নির্দেশনা মানছে না। তাদের মতে, হয় গরু আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হোক, না হয় ভালোভাবে চলতে দেয়া হোক।  চাঁপাইনবাবগঞ্জের একাধিক গরু ব্যবসায়ী জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরা গরু-মহিষ আসে উত্তর প্রদেশ, রাজস্থানসহ দেশটির দূরের রাজ্যগুলি থেকে। বিজিবির অনীহার কারণে সীমান্তে গরু এনে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে হস্তান্তরের জন্য তাদের ১৫ থেকে ২০দিন এমনকি একমাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অপেক্ষার এ সময়ে গরুগুলি খেয়ে না খেয়ে মারা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজারের বেশি গরু মারা গেছে। এতে অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়েছে। একইভাবে যেসব বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কমিশনে গরু কিনতে ভারতে বিপুল পরিমাণ টাকা পাঠিয়েছিলেন সেসব টাকাও হারিয়ে গেছে সময়মতো গরু না আসায়। আর এসব কারণেই ভারতীয় ব্যবসায়ীরা গরু পাঠানো বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের একাধিক খাটাল মালিক বলেন, রাজশাহী সীমান্তের বিপরীতে দায়িত্বরত ১২০ বিএসএফ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিপরীতে ৮৩ ব্যাটালিয়ান কর্তৃপক্ষের সম্মতি ও সহযোগিতায় ওই দেশের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে গরু পাঠাচ্ছেন। ফলে এই অঞ্চলের সীমান্তে বাংলাদেশিদের প্রাণহানির ঘটনা  ঘটছে না। উল্লেখ্য, প্রতি বছর সীমান্ত পথে ২০ লাখ গরু আসে ভারত থেকে। এতে দেশে গবাদিপশুর মোট চাহিদার ৪০ ভাগ পূরণ হয়।
ওহেদপুরের খাটাল মালিক তরিক ইসলাম বলেন, দুই দেশের ব্যবসায়ীদের সমঝোতায় গরু আসা বন্ধ হলে চোরাই পথে গরু আসবে। তখন আবার বিএসএফের কিলিং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তরিক বিজিবির এই কোটা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নিয়ম মেনে গরু আসলে তাতে বাধা না দিয়ে দেশে ঢুকতে দেয়ার  দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে  রাজশাহী বিভাগীয় শুল্ক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার সৈয়দ আতিকুর রহমান জানান, আগে গরুর ছাড়করণ হতো প্রতিদিন। এখন শুক্রবার ও শনিবার বন্ধ থাকে। এতে ব্যবসায়ীদের কিছু অসুবিধা হয়। আর নিয়ম মেনে গরু আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো বিধিনিষেধ নেই বলে জানান তিনি। দিনে কতটি আনা যাবে সেটাও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।  তিনি বলেন, গরু বেশি আসলে সরকারও বেশি রাজস্ব পাবে।
শুল্ক বিভাগের সূত্র মতে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও  নওগাঁর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গত কয়েক মাসে গরু আমদানি কিছুটা কমেছে। সূত্র মতে, গত বছর অক্টোবরে ১ লাখ ১৩ হাজার গরু আসলেও নভেম্বরে এসেছে মাত্র ২৩ হাজার ৮৬৩টি। একইভাবে ডিসেম্বরে এসেছে ৪৮ হাজার। চলতি ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এসেছে সাড়ে ৬ হাজার গরু। এতে একদিকে যেমন গরু সঙ্কট হচ্ছে দেশে, তেমনি সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রাজশাহীর  বিভাগীয় টাস্কফোর্সের সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল হান্নান জানান, সীমান্ত পথে গরু আনতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিধিনিষেধ নেই। গত ১ জানুয়ারি বিজিবির নতুন মহাপরিচালকও ভিডিও সম্মেলনে গরু আনার ব্যাপারে বিজিবির পক্ষ থেকে কোনো বাধা না থাকার কথাই জানিয়েছেন।