ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনে রাজি বাংলাদেশ

আপডেট: মে ২৫, ২০২৩, ১১:২১ অপরাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক:


গত কয়েক মাস ধরে টাকা ও রুপি বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) ভিত্তিতে বাণিজ্যের আলোচনা চললেও— দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেনের একটি অংশ শুধু রুপিতেই নিষ্পত্তি করবে বাংলাদেশ ও ভারত। অর্থাৎ দুই দেশের লেনদেনে রুপির পাশাপাশি বাংলাদেশি মুদ্রা টাকায় লেনদেন হওয়ার যে কথা ছিল তা হচ্ছে না। যদিও ডলারের ওপর চাপ কমাতে দুই দেশের নিজ নিজ মুদ্রা (টাকা ও রুপি) ব্যবহারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার বিষয়ে আলোচনায় ছিল বাংলাদেশ ও ভারত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রুপিতে লেনদেনে রাজি হয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক সোনালী ব্যাংক ও ইষ্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডকে (ইবিএল) ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে নস্ট্রো-অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এই দুই ব্যাংকে খোলা নস্ট্রো-অ্যাকাউন্টে শুধুমাত্র (ভারতে) রফতানির বিপরীতে রুপিতে অর্জিত আয় জমা করা যাবে। জমা হওয়া অর্থে শুধুমাত্র ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য ও সেবার ব্যয় মেটানো যাবে।
এছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে আগাম পরিশোধ করা যাবে। তবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে এসব অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ওভার ড্রাফট ও স্বল্প মেয়াদি ঋণও নেওয়া যাবে।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী জুনের মধ্যে উভয় দেশের ব্যাংকগুলো এ ধরনের লেনদেনের জন্য প্রস্তুতি শেষ করতে পারবে। এরপর জুনেই এলসি খোলা বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সোনালী ব্যাংক ও ইবিএল ছাড়াও অন্যান্য ব্যাংকগুলো এ দুই ব্যাংকের মাধ্যমে রুপিতে লেনদেন করতে পারবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশ ডলার সংকটে পড়েছে। এছাড়া ভূরাজনৈতিক কারণেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ডলার এড়িয়ে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নভুক্ত (আকু) দেশগুলো নিজস্ব মুদ্রায় আমদানি দায় পরিশোধের আলোচনা করছে।
গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক চীনা মুদ্রা ইউয়ানে এলসি খোলার অনুমোদন দিয়েছে। উত্তরা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক এ ধরনের এলসি খুলেছেও। রাশিয়ার সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ।
এদিকে ভারত চাচ্ছে তাদের মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন বাড়াতে। গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে বাংলাদেশকে তাদের মুদ্রা রুপি ব্যবহারের মৌখিক প্রস্তাব দেয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কয়েক মাস আগে রুপিতে লেনদেন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি পর্যালোচনা করে রুপিতে দ্বিপাক্ষিক লেনদেন করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনও ব্যবসায়ী আমদানি বা রফতানির ক্ষেত্রে রুপিতে এলসি খুলতে চাইলে তা করতে পারবেন।’ ব্যাংকগুলো রুপিতে এলসি করতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে অনুমতি দেবে বলেও তিনি জানান।
এদিকে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইবিএল ইতোমধ্যে ভারতের ব্যাংকে নস্ট্রো-অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কাছে আবেদন করেছে।
এ প্রসঙ্গে ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ইষ্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডকে ভারতের ব্যাংকে একটি নস্ট্রো-অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেওয়ার পর স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে (এসবিআই) হিসাব খোলার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) কাছে আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সোনালী ও ইবিএল পাইলট হিসেবে এই লেনদেন শুরু করবে। শুরুতেই অনেক লেনদেন সম্ভব হবে না। তবে ধাপে ধাপে এগোতে হবে। বাংলাদেশের রফতানির বিপরীতে যতটা রুপি পাওয়া যাবে, ততটা আমদানি দায় রুপিতে পরিশোধ করা যাবে।
এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেন, ‘এই মুহূর্তে ডলারের ওপর চাপ কমাতে রুপিতে লেনদেন করতে পারলে ভালো কাজ দেবে। তার মতে, পর্যায়ক্রমে দুই দেশের আরও ব্যাংক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানির পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ লেনদেন রুপিতে সম্পন্ন করবে দুই দেশ। অপরদিকে গত অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩.৬৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এরমধ্যে দুই বিলিয়ন ডলার রুপিতে হবে বাকি লেনদেন হবে, আগের মতোই ডলারে।
প্রসঙ্গত, দুই দেশের নিজস্ব মুদ্রার মধ্যে লেনদেন প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা করতে এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে ঢাকা সফর করে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিনিধি দল। তারা গত ১১ এপ্রিল বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংকে (ইবিএল) বৈঠক করে। সেখানে ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সফরকারীরা দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন পরিশোধ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে রুপি ছাড়াও বিকল্প মুদ্রা নিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে চীনা মুদ্রায় এলসি খোলার অনুমতি দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। বিশেষ করে রাশিয়ার অর্থায়নে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, সেটার ঋণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও রাশিয়া সম্মত হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিকল্প নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুযোগ আইনে যুক্ত করার জন্য একটি প্রস্তাব সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ছাড়া যেসব মুদ্রা ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই, তার মধ্যে রয়েছে পাউন্ড, রুপি, ইউরো, ইয়েন ও রুবল। এসব মুদ্রা ব্যবহারে ‘বিনিময় চুক্তি’ এবং ‘কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডলারের বিকল্প রুপিতে লেনদেন হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হবে। তবে এর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ এখনও ৫৯ শতাংশ রিজার্ভ হলো ইউএস ডলারে। ইউরো প্রায় ২০ ভাগ। আর সব মুদ্রা মিলিয়ে বাকি ২০ শতাংশ। ইউয়ান ২.২৫ শতাংশ। বিকল্প মুদ্রা ক্ষেত্রে ইউয়ান কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, ভারতীয় রুপিতে আমদানি হলে ডলার বাঁচবে। কিন্তু রফতানির ক্ষেত্রে তো আর সেটা হবে না। আমাদের এটুকু লাভ হতে পারে যে আমরা চীন ও ভারতে রফতানি করে তাদের যে মুদ্রা পাবো, তা ব্যবহার করতে পারবো।’
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট আমদানির ৪০ শতাংশই হয় চীন ও ভারত থেকে। এরমধ্যে ২৬ শতাংশ চীন এবং ১৪ শতাংশ ভারত থেকে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, মোট রফতানির ২৬ শতাংশ এবং আমদানির সাড়ে ৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। মোট রফতানির ৫৬ শতাংশ এবং আমদানির ৮ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে।
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন