বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮ ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
গত কয়েক সপ্তাহে ভারতের বিভিন্ন অংশে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যায় বহু মানুষের প্রাণ গেছে; বাস্তুচ্যুত হয়েছে হাজারো মানুষ।
বিবিসি লিখেছে, বছরের এই সময়ে ভারত বা এশিয়ায় বন্যা অস্বাভাবিক নয়, কারণ এ অঞ্চলে এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়ে পড়ছে, অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের পর দীর্ঘ সময় ধরে দেখা দিচ্ছে বৃষ্টিহীনতা বা খরা।
এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বা আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়ছেই; সেই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে এক ধরনের ঝড়, যাকে বলা হচ্ছে ‘বায়ুমণ্ডলীয় নদী’ বা ‘উড়ন্ত নদী’।
এই ঝড় আসলে বিপুল জলীয় বাষ্পের অদৃশ্য ফিতার মত; যার জন্ম হয় উষ্ণ মহাসাগরে। বাষ্পীভূত পানি ওই অদৃশ্য ফিতার মত জড়ো হয় বায়ুমণ্ডলে।
জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের নিচের অংশে অনেকগুলো স্তম্ভ গঠন করে, বাতাসে ভেসে সেগুলো ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে শীতল অক্ষাংশে চলে যায়। পরে তা নেমে আসে বৃষ্টি বা তুষার হিসেবে, যা বন্যা বা মারাত্মক তুষারপাত সৃষ্টির জন্য দায়ী।
পৃথিবীর বাতাসে ভাসমান মোট জলীয় বাষ্পের প্রায় ৯০ শতাংশই বহন করে এই ‘আকাশ নদীগুলো’। এই জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বিশ্বের বৃহত্তম নদী আমাজনের স্বাভাবিক পানি প্রবাহের প্রায় দ্বিগুণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী দ্রুত উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলো দীর্ঘ, প্রশস্ত ও তীব্রতর হয়ে উঠছে, যা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে বন্যার ঝুঁকিতে ফেলেছে।
ভারতের আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ভারত মহাসাগরে উষ্ণায়নের কারণে ‘উড়ন্ত নদী’ তৈরি হচ্ছে, যা জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে মৌসুমি বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করছে।
বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে ১৯৫১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বর্ষা মৌসুমে মোট ৫৭৪টি বায়ুমণ্ডলীয় নদীর দেখা মিলেছে; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনা বেড়েছে।
ভারতে গত দুই দশকে সবচেয়ে তীব্র বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশই বন্যা সৃষ্টি করেছে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি দল এই গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা দেখেছেন যে, ১৯৮৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বর্ষা মৌসুমে ভারতের সবচেয়ে ১০টি মারাত্মক বন্যার সঙ্গে সাতটিরই যোগ আছে বায়ুমণ্ডলীয় নদীর সঙ্গে।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভারত মহাসাগরে বাষ্পীভবন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলীয় নদী ও তার মাধ্যমে বন্যা সৃষ্টির ঘটনাও সম্প্রতি বেড়েছে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মিটিরিওলজির বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানী ড. রক্সি ম্যাথিউ কোল বিবিসিকে বলেন, “বর্ষা মৌসুমে ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে প্রবাহিত আর্দ্রতার তারতম্য (আরও ওঠানামা) বৃদ্ধি পায়।
“ফলে উষ্ণ সমুদ্রের পুরো আর্দ্রতা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলোতে চলে যায়। তাতে দেশজুড়ে ভূমিধস ও হড়কা বান বাড়ছে।”
বিবিসি লিখেছে, এক একটি বায়ুমণ্ডলীয় নদীর দৈর্ঘ্য ২ হাজার কিলোমিটার (১,২৪২ মাইল), প্রস্থ ৫০০ কিলোমিটার এবং গভীর প্রায় ৩ কিলোমিটার হতে পারে। এমন নদী এখন আরও প্রশস্ত ও দীর্ঘতর হচ্ছে, কিছুক্ষেত্রে ৫ হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ নদীও দেখা গেছে। তবে এগুলো খালি চোখে মানুষ দেখতে পায় না।
নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির বায়ুমণ্ডলীয় গবেষক ব্রায়ান কান বলেন, “ইনফ্রারেড ও মাইক্রোওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে এগুলো দেখা যায়।
“সে কারণেই বিশ্বজুড়ে জলীয় বাষ্প এবং বায়ুমণ্ডলীয় নদী পর্যবেক্ষণের জন্য স্যাটেলাইট কার্যকর উপায় হতে পারে।”
ব্রায়ান কান বলেন, ওয়েস্টার্ন ডিস্টার্বেন্সের মত ক্রান্তীয় ঝড়, বর্ষা ও ঘূর্ণিঝড়ের মত অন্যান্য আবহাওয়াগত কারণেও বন্যা হতে পারে।
কিন্তু বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬০-এর দশক থেকে বায়ুমণ্ডলীয় জলীয় বাষ্প ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ এশিয়ায় ৫৬ শতাংশ অতি ভারি বৃষ্টি ও তুষারপাতের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলীয় নদীর যোগসূত্র দেখতে পেয়েছেন। যদিও এই অঞ্চলে গবেষণা হয়েছে সীমিতই। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাশের অঞ্চলে বর্ষায় বায়ুমণ্ডলীয় নদীর সঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাতের যোগসূত্র নিয়ে বিশদ গবেষণা হয়েছে।
আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন প্রকাশিত ২০২১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমের শুরুতে (মার্চ-এপ্রিল) পূর্ব চীন, কোরিয়া ও পশ্চিম জাপানে ঝরা ভারি বৃষ্টির ৮০ শতাংশের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলীয় নদীর সম্পর্ক আছে।
জার্মানির পটসড্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সারা এম ভালেজো-বার্নাল বলেন, ১৯৪০ সাল থেকে পূর্ব এশিয়ায় বায়ুমণ্ডলীয় নদীর তীব্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
“আমরা দেখেছি যে, তখন থেকে মাদাগাস্কার, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে এই নদী আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।”
বিবিসি লিখেছে, অন্যান্য অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরাও সাম্প্রতিক কয়েকটি বড় বন্যার সঙ্গে বায়ুমণ্ডলীয় নদীর যোগসূত্র দেখতে পেয়েছেন।
২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রচণ্ড বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি ও বিরল বৃষ্টিপাতের পর ইরাক, ইরান, কুয়েত ও জর্ডান ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে।
পরে আবহাওয়াবিদরা দেখতে পান যে, এই অঞ্চলের বাতাস রেকর্ড পরিমাণ আর্দ্রতা বহন করেছে। ২০০৫ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছিল, তবে তখন এতো আর্দ্রতা ছিল না।
দুই মাস পরে চিলিতে মাত্র ৩ দিনের মধ্যে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। আকাশ থেকে এত বেশি বৃষ্টি ঝরেছিল যে- তার কারণে আন্দিজ পর্বতের কিছু অংশে বরফ গলে যায়; দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা-যাতে সড়ক, সেতু ধসে যায় এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
বছর খানেক আগে অস্ট্রেলিয়াতে ভারি বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছিল, যাকে ‘রেইন বম’ বলে বর্ণনা করেন রাজনীতিকরা। ওই বৃষ্টিতে ২০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়।
বিপর্যয়কর বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বিবেচনা করে হারিকেনের মত করে বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলোকে তাদের আকার ও শক্তির ভিত্তিতে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে।
সব বায়ুমণ্ডলীয় নদীই যে ক্ষতিকর নয়। বিবিসি লিখেছে, কিছুক্ষেত্রে এমন নদী উপকার বয়ে আনে, বিশেষ করে যেসব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে খরা চলছে। তবে অতীতের তুলনায় বায়ুমণ্ডলে যে অনেক বেশি আর্দ্রতা দেখা যাচ্ছে, সেটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিচেনা করতে হবে।
এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় বন্যা ও ভূমিধসের প্রশ্নে ওয়েস্টার্ন ডিস্টার্বেন্সের মতো ক্রান্তীয় ঝড় বা ভারতীয় ঘূর্ণিঝড়ের মতো আবহাওয়াগত যেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হয়, তার তুলনায় ‘বায়ুমণ্ডলীয় নদী’ ঝড় নিয়ে তেমন গবেষণেই হয় না।
আইআইটি ইন্দোরের গবেষক রোসা ভি লিঙ্গওয়া বলেন, “এই অঞ্চলে ধারণাটি নতুন হওয়ায় এবং এটি প্রচলন করা কঠিন হওয়ায় আবহাওয়াবিদ, পানি বিশেষজ্ঞ ও জলবায়ু বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে সহযোগিতামূলক কোনো প্রচেষ্টা নেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং।
“কিন্তু ভারতের কিছু অংশে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায়- এই ঝড় (বায়ুমণ্ডলীয় নদী) এবং এর সম্ভাব্য বিধ্বংসী প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ