ভারত-পাকিস্তান যেভাবে ভাগ করে নিয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন

আপডেট: আগস্ট ১৯, ২০১৭, ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক


মহেঞ্জোদারোর হারের দুই অংশ- এর একটি ভারতে, অন্যটি পাকিস্তানে।

ভারত ভাগের ৭০ বছর উপলক্ষে লেখাটি যৌথভাবে লিখেছেন বিবিসি হিন্দির কণিষ্ক থারুর এবং বিবিসি উর্দূর মারিয়াম মারুফ:
ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সেই হারটির কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। মহেঞ্জোদারো এলাকায় খনন করে প্রায় ৫,০০০ বছরের পুরনো হারটি উদ্ধার করা হয়েছিল প্রায় একশ’ বছর আগে।
প্রাচীন ইতিহাসের নিদর্শন সেই হারের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের ইতিহাসে আপাতভাবে কোনও সম্পর্ক থাকার কথা নয়।
কারণ ভারত আর পাকিস্তান কোনও সময়েই তো আলাদা ছিল না। তাদের ইতিহাস একই – সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যও এক ছিল। কিন্তু যখন দুই দেশের মধ্যে ভূমি ভাগ হল, তখন শুধুই যে দুই দেশের মধ্যে সীমারেখা টানা হল, তা নয়- ঐতিহ্যও যেমন ভাগ হয়ে গেল, তেমনই দ্বিখণ্ডিত হল মিলেমিশে কাটানো সময়কালটাও।
দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হল সূচ, পেন্সিল, চেয়ার, টেবিল, ফাইল রাখার আলমারি- এমনকি সরকারের পোষ মানানো জন্তু-জানোয়ার ভাগাভাগি নিয়েও।
ভাগাভাগির কাহিনী
তবে সে সব ছাপিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির অন্যতম- সিন্ধু সভ্যতার এলাকা থেকে খুঁজে পাওয়া একটি হার কীভাবে দুদেশের মধ্যে ভাগ হবে, তা নিয়ে দু’পক্ষের দ্বন্দ্বে।
১৯২০ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অনেক আগে যখন ভারত আর পাকিস্তান একটাই দেশ ছিল, সেই সময়ে সিন্ধু নদ অঞ্চলের মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া গিয়েছিল এক প্রাচীন শহরের খোঁজ।
এই প্রাচীন সভ্যতা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই সেই সময়ে ব্রিটিশদের গোলাম হয়ে থাকা ভারত নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করার মতো আরেকটি বিষয় পেয়ে গিয়েছিল।
ভারতের মানুষ সহজেই বুক বাজিয়ে বলতে পারতেন তাঁদের ইতিহাসও মিশর, ইউনান আর চিনের সভ্যতার মতোই হাজার হাজার বছরের পুরনো।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁর বই ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’তেও মহেঞ্জোদারো নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
তাঁর কথায়, “মহেঞ্জোদারোর ওই টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলাম যে আমি পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এক সভ্যতার উত্তরাধিকারী। সে এমন একটা সভ্যতা, যেটা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল।”
মহেঞ্জোদারো-র সেই হার কীভাবে পাওয়া গিয়েছিল
সেই মহেঞ্জোদারোতেই খনন চলার সময়ে যে হাজারেরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল একটি নর্তকীর মূর্তি আর ধ্যানরত এক পূজারীর মূর্তি। কিন্তু কোনটিই অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। একমাত্র অক্ষত অবস্থায় যেটা পাওয়া গিয়েছিল, সেটি হল একটা হার। সোনার সুতোয় মোড়া বহুমূল্য পাথর দিয়ে গাঁথা ছিল সেই হার।
ভারতের ইতিহাসবিদ ও পুরাতাত্ত্বিক সুদেষ্ণা গুহ বলছেন, “সিন্ধু সভ্যতার এলাকায় খননের সময়ে খুব কমই গয়না পাওয়া গিয়েছিল। তাই এই সোনার হারটির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।”
একটি তামার পাত্রের মধ্যে থেকে ওই হারটি উদ্ধার করা হয়েছিল। মনে করা হয়ে থাকে ওই ঘরটি কোনও স্বর্ণকারের ঘর ছিল।
ড. গুহর কথায়, তাম্রযুগের সিন্ধু সভ্যতার খোঁজ পাওয়ার ফলে ভারত সেইসব দেশের সঙ্গে একই সারিতে পৌঁছে গিয়েছিল, যাদের দীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাসের কথা আগেই জেনেছিল পৃথিবীর মানুষ।
আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটির পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের বিশেষজ্ঞ ওয়াজিরা ফাজিলা জামিন্দার বলছেন, “সিন্ধু সভ্যতা খুঁজে পাওয়াটা ভারতেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।”
আর এই সভ্যতা ছিল ভারত-পাকিস্তানের ঐতিহ্য। কারণ ১৯৪৭ সালের আগে দুটো তো এক দেশই ছিল।
কিন্তু ১৯৪৭ সালের জুন মাসে যখন দেশভাগের কথা ঘোষণা হল, তখন থেকে মানুষ ছোট ছোট জিনিসও ভাগাভাগি নিয়ে লড়তে শুরু করল। অথচ এই মানুষরাই হাজার হাজার বছর ধরে একসঙ্গে থেকে এসেছে।
হাঁস-হাতিরও ভাগাভাগি
দেশভাগের কয়েক মাস আগে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা ৬০টি হাঁসও দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল।
বন বিভাগের সম্পত্তি জায়মুণি নামের একটি হাতিকে পূর্ব পাকিস্তানকে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। তা নিয়ে ভারতের মানুষের মধ্যে বেশ ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। ওই হাতিটির মাহুত অবশ্য ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এমন সব জিনিসের ভাগাভাগি হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে, যা হয়তো কল্পনাও করা যায় না।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২১টি টাইপরাইটার যন্ত্র, ৩১টি কলমদানি, ১৬টি সোফা, ১২৫টি কাগজপত্র রাখার আলমারি আর অফিসারদের বসার জন্য ৩১টি চেয়ার পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল।
যে দিল্লি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের রাজধানী ছিল, সেই দিল্লিই স্বাধীন ভারতের রাজধানী হল। আর পাকিস্তান সিদ্ধান্ত নিল করাচীকে তাদের রাজধানী করার।
করাচী সেই সময়ে ছিল একটি প্রদেশের রাজধানী। একটা দেশ পরিচালনা করার জন্য যত দপ্তর প্রয়োজন, তা তো ছিলই না করাচীতে- এমনকি দপ্তরের জায়গাও ছিল না। সরকারি অফিস চালানোর মতো প্রয়োজনীয় সামান্য জিনিসও ছিল না সেখানে।
পাকিস্তানের নতুন সরকারের তখন কাগজ, ফাইল, কলম, এমনকি পিন পর্যন্ত যোগাড় করতেও হিমশিম অবস্থা।
দুটো দেশ যখন পেন-পেন্সিল আর পিনের মতো সাধারণ জিনিসপত্র নিয়ে ভাগাভাগি করছে, তখন ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো ভাগ করা নিয়ে যে কী হয়ে থাকতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
কোনও দেশের অস্তিত্বের জন্য তার ইতিহাসটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারত আর পাকিস্তানের তো আলাদা কোনও ইতিহাসই নেই। যৌথ সেই ইতিহাস কী করে ভাগ করা হবে!
কিন্তু দেশভাগের ফলে সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র মহেঞ্জোদারো চলে গেল পাকিস্তানের ভাগে।
পাকিস্তানের যেহেতু পৃথক ইতিহাস ছিল না, তাই সিন্ধু সভ্যতাকে ভারতের ইতিহাস থেকে আলাদা করে নিজেদের ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠিত করা তাদের কাছে জরুরি হয়ে পড়েছিল।
ওয়াজিরা জামিন্দার বলছেন, দেশভাগের পরেই সিন্ধু সভ্যতাকে নতুনভাবে বর্ণনা করার, সেটিকে পাকিস্তানের সম্পত্তি বলে প্রচার করার চেষ্টা শুরু হল।
লক্ষ্য এটাই ছিল যে ভারতের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা মর্যাদাপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে পাকিস্তানের- যে ইতিহাস হিন্দু-প্রধান ভারতের নয়, বরং মুসলিম পাকিস্তানের ইতিহাস।
সেজন্যই দেশভাগের পরে পাকিস্তানের ৫,০০০ বছরের পুরনো ইতিহাসের মতো বই লিখে সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে- যে ইতিহাস কখনও ছিলই না।
কে কী পেল?
ইতিহাসবিদ সুদেষ্ণা গুহ বলছেন, দেশভাগের প্রক্রিয়া যখন চলছে, সেই সময়ে সিন্ধু সভ্যতা খনন করে যে হাজার খানেক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল, ভারতও সেগুলো দাবি করে।
ভাগাভাগির যে ফর্মুলা তৈরি হয়েছিল, সেই অনুযায়ী ৬০ শতাংশ জিনিস ভারতের আর বাকি ৪০ শতাংশ পাকিস্তান পাবে।
মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া নর্তকীর মূর্তি, ধ্যানরত পূজারীর মূর্তি যেমন সেই সব নিদর্শনের মধ্যে ছিল, তেমনই ছিল অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ সেই সোনার হারটিও।
নর্তকীর মূর্তিটি ভারতের ভাগে গেল, আর পাকিস্তান পেল পূজারীর মূর্তি।
কিন্তু সোনার হার ভাগ করার সময়ে তৈরি হল অচলাবস্থা- ওটাই মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া একমাত্র অক্ষত নিদর্শন ছিল।
হারের ব্যাপারে যখন ঐকমত্যে পৌঁছানো গেল না, তখন কর্মকর্তারা ঠিক করলেন হারটিকে দুইভাগ করে ফেলা হোক- ঠিক যেভাবে দুটো দেশকে ভাগ করে আলাদা করা হয়েছিল।
এই অসাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটিকে আধা-আধি ভাগ করে দুই দেশ একেকটি ভাগ নিয়ে নিল।
ভারত যে ভাগটা পেয়েছিল, সেটা দিল্লির জাতীয় সংগ্রহশালায় রয়েছে।
ইতিহাসবিদ সুদেষ্ণা গুহর কথায়, “এই হারটি ভাগ করা এক ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা। ইতিহাসকে কেটে দু’টুকরো করে ফেলা হল। আফসোস এটাই যে এই ঘটনার জন্য কেউ লজ্জিতও হল না!”
আমেরিকায় একটি প্রদর্শনীর জন্য হারটির দু’টো টুকরোকে এক করার প্রস্তাব এসেছিল একবার। কিন্তু ভারত যে টুকরোটা পেয়েছিল, সেটি দিতে তারা অস্বীকার করে।
ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে ইতিহাস ভাগ করার সবচেয়ে বড় সাক্ষী থেকে গেছে মহেঞ্জোদারোর এই হারটির দুটো টুকরো।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ