ভাষা আন্দোলনের কিছু কথা

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭, ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ

ওয়ালিউর রহমান বাবু


ঊনিশশো সাতচল্লিশ সনে দেশ বিভাগের তিন মাস আগে ১৮ মে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জমান হায়দারাবাদে ইঙ্গিত দিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে। বিষয়টি তেমনভাবে কারও মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করলেও কিছু বাঙালি ব্যক্তিত্বের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। দেশ বিভাগের সময় কলকাতায় থাকা  রাজশাহীর দূরদর্শি নেতা আতাউর রহমান, তখনকার ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বললেন, ‘রাষ্ট্র ক্ষমতা যারা নিচ্ছেন তারা বাংলা ভাষা, বাঙালিদের সু-নজরে দেখবে না।’ তার এ কথাটি সত্য হলো। বাঙালিদের ঐক্য নষ্ট করতে দেশ ভাগের অঞ্চল নিয়েও ষড়যন্ত্র শুরু হলো। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাঙালিদের সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা থাকলেও পাকিস্তানের ক্ষমতায় থাকা পশ্চিমা গোষ্ঠী এর মূল্যায়ণ করলো না। পাকিস্তানের রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো নিয়েও চলতে থাকলো ষড়যন্ত্র। এপারে থাকা গুণিব্যক্তিদের দায়িত্ব নিতে হলো। রাষ্ট্রীয় ভাষা নিয়ে শুরু হলো জটিলতা কারণ সে সময় উচ্চ মহলের ব্যক্তিদের অধিকাংশই উর্দু ভাষা ব্যবহার করে গর্ববোধ করতেন কিন্তু পাকিস্তানের এ অংশে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলা ভাষাভাষি হওয়া সত্ত্বেও সরকার এদিকে সেভাবে নজর দিলেন না। ধর্মীয় কুসংস্কার আর ভুল ব্যাখ্যার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না দেখা দিলেও তখনকার বাঙালি গুণিব্যক্তিরা তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেবার যুক্তি দেখালেন। ঊনিশশো সাতচল্লিশ এর সাত সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও পনেরই সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ও দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের দাবি জানালো। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা এদিকে গুরুত্ব না দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা নিলেন। এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো। এ বছরের ৫ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার খবর ঢাকায় এলে আন্দোলন শুরু হলো।
গঠন হলো ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। আন্দোলনের চাপে পরের বছরে ঊনিশশো আটচল্লিশ এর এক ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা ব্যবহার করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিলেও গভীরভাবে ষড়যন্ত্র চলতে থাকলো। ঊনিশশো আটচল্লিশ সালের তেইশ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস নেতা কুমিল্লার স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার দাবি জানালে মুসলিমলীগ নেতারা এর বিরোধিতা করলো। সরকারের কার্যকলাপের ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে গেলো।
বাংলা ভাষাকে মর্যাদার দাবিতে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো। তারা একজন দুইজন করে সংগঠিত হতে থাকলেন। সভা সমাবেশ অনুষ্ঠানে সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ ইঙ্গিত দিলে এর প্রতিবাদে বিষ্ফোরণ ঘটলো। এর উত্তাপ স্পর্শ করলো সারা দেশের বাঙালি প্রগতিশীল ছাত্র সমাজের মধ্যে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পুনর্গঠিত করা হলো।
পাকিস্তানের জনক কায়দে আজম মোহম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার সিদ্ধান্তে সারা দেশের ছাত্র সমাজের মত রাজশাহী কলেজে সে সময় অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর যারা প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা করতেন তাদের মধ্যে প্রচ- প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো। দেশ বিভাগের মাত্র এক বছরের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হলো। চলতে থাকলো আন্দোলনের নানা কর্মসূচি। ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যার বেড়াজালের কারণে অনেকের মধ্যে এর তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হলে ক্রমে এর প্রতিক্রিয়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকলো । কর্মসূচির অংশ হিসাবে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ডাকে ধর্মঘট পালিত হলো। আন্দোলন ঠেকাতে সরকার সমর্থক বাহিনী এই আন্দোলনকে কমিউনিস্টদের, ভারতের চরদের কাজ বলে প্রচার চালাতে থাকলো। ড. তসিকুল ইসলাম রাজার লেখা “রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন” থেকে জানা যায়, এদিন রাজশাহীতে ধর্মঘট চলাকালে রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা কলেজ গেটের সামনে শুয়ে পড়েন। সারা শহরে পালিত হলো ধর্মঘট। ছাত্র-ছাত্রীরা যখন মিছিল করে ফায়ার বিগ্রেডের দিকে যাচ্ছিলেন তখন সরকারের পেটুয়া বাহিনী অস্ত্র লাঠি নিয়ে তাদের উপর হামলা করলে অনেকে আহত হন। ভাষার দাবিতে রাজশাহীতে প্রথম রক্ত ঝরলো। আবার গুটি কয়েক ছাত্র কৌশলে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুললেন অবশ্য এ ব্যাপারে তারা কারো সমর্থন পেলেন না। ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকলো স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও।
ঊনিশশো আটচল্লিশ সালের পনের মার্চ খাজা নাজিম উদ্দিন বাংলা ভাষা কে মর্যাদা দিতে চুক্তি করলেন কিন্তু একুশ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনকারীদের কমিউনিস্ট ভারতের চর রাষ্ট্রদ্রোহী বললে আন্দোলন তীব্র হতে থাকলো। সরকারি দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্য এ নিয়ে  দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো। ঊনিশশো পঞ্চাশ সালে রাজশাহীতে সাহিত্য সংগঠন দিশারী ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ভূমিকা রাখতে থাকলো। যদিও ধর্মীয় ভুল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক বাঙালি ছাত্রছাত্রী তখনো এনিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় রাজশাহী কলেজ থেকে বহু ছাত্রনেতাকে বহিষ্কার করা হলো। আন্দোলনের কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ এ আদেশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলো। ঊনিশশো বায়ান্ন সালের সাতাশ জানুয়ারি ঢাকায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে প্রতিবাদ সভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে দায়ী করা হলো। ৩০ জানুয়ারি ও  ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আবার ধর্মঘট ডাকা হলো। কর্মসূচি চলাকালে মো. আলী জিন্নাকে কায়দে আজম বলে সম্মানিত না করায় অনেকে মারমুখি হয়ে হৈ চৈ করতে থাকলেন। রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের কর্মসূচি চলতে থাকলো। ঊনিশশো বায়ান্ন সালের বিশ ফেব্রুয়ারি ও পরের দিন একুশ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ধর্মঘট ডাকা হলো। সরকার ধর্মঘট ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি করলে অধিকাংশ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে থাকলেও এ নিয়ে মত পার্থক্য দেখা দিলো। একটি অংশ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিপক্ষে অবস্থান নিলো। সৃষ্টি হলো নেতৃত্বের সংকট, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যও নানা মত দেখা দিলো। ওই রাতে ঢাকা  বিশ্ববিদ্যলয়ের ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্ব পাড়ে অনেকের সাথে মুহম্মদ সুলতান, হাবিবুর রহমান শেলী, আব্দুল মতিন, জিল্লুর রহমান, কামরুদ্দিন, গাজী উল হক, আনোয়ারুল হক খান, এম আর আখতার মুকুল এরকম অনেকে আলোচনায় বসলেন। এই আলোচনায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আইন পরিষদের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া  হলো। পরের দিন একুশ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট চলাকালে রাজনৈতিক নেতারা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে কি হবে না তা নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে সমস্যায় পড়লেন। অনেকে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গাকে ধর্মীয় দিক দিয়ে নাজায়েজÑ এই যুক্তি দেখালে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। তখনকার ছাত্রনেতা গাজী উল হকের পরিচালনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে শুরু হলো সভা। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা না ভাঙ্গা নিয়ে মত পার্থক্য দেখা দিলে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মতিন দশজন দশজন করে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য দিলে ছাত্র নেতা গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে মত দিয়ে একে সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা দিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে তখন উত্তেজনাকর অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোয়াজ্জেম হোসেন পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকলেন। আগের রাতে যারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিপক্ষে ছিলেন তারাও ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে যুক্ত হয়ে গেলেন। মিছিলে অংশ নিতে অনেকেই প্রস্তুত হলেও কোন উদ্যোগ না দেখে অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়লেন।
১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে যারা রাজি তাদের নামের তালিকা করতে ছাত্র নেতা মুহাম্মদ সুলতান এগিয়ে এলেন। আগের দিন রাতে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়া হাবিবুর রহমান শেলী কারো জন্য অপেক্ষা না করে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে নাম লিখিয়ে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে সেøাগান তুললেন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। তখন দুপুর একটা। তার নেতৃত্বে দশ জনের প্রথম গ্রুপটি বেরিয়ে আসতেই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করলো। অন্যান্য গ্রুপ ও ছাত্ররাও রাস্তায় বেরিয়ে আসতে থাকলো। পুলিশ গ্রেফতার করা ছাত্রদের ট্রাকে তুলে তেঁজগা থানায় নিয়ে গেলে। আন্দোলন তখন আরো তুঙ্গে। পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ অনেকে শহিদ হলেন। আহতও হলেন অনেকে। এ খবর শুনে বাজেট অধিবেশন বর্জন করে সাংসদ মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ বাইরে বেরিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অধিবেশনে ফিরে গিয়ে তীব্র স্বরে এর প্রতিবাদ জানালে সরকারের কুনজরে পড়লেন।
রাজশাহীসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও চলছিলো আন্দোলন। ড. তসিকুল ইসলাম রাজার লেখা “রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন” থেকে জানা যায়, ঢাকায় ছাত্রদের গ্রেফতার ও পুলিশের গুলি চালানোর খবর সন্ধ্যার দিকে রাজশাহীতে এলে ছাত্রনেতারা কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় বসলেন। সিদ্ধান্ত হলো কর্মসূচির পাশাপাশি শহিদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির। সারা রাত ধরে চলতে থাকলো রাজশাহী কলেজ হোস্টেল স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কাজ। সাধারণ মানুষের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে গেলো। তাদের অনেকেই বাংলা ভাষার মর্যাদা দেবার আন্দোলনের পক্ষে আন্দোলনরত ছাত্রনেতাদের সহযোগিতা করতে থাকলেন। রাজশাহীতে ছাত্রনেতারা পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি প্রচার করতে গেলে পুলিশ রাজশাহী কলেজ হোস্টেলে  তৈরি করা শহিদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙ্গে দিলো। (ভাষা সৈনিকদের মতে এটিই দেশের প্রথম শহিদ মিনার। কারণ, সে সময় ঢাকা বা অন্য কোথায় এ ধরনের স্মৃতিস্তুম্ভ তৈরির পরিস্থিতি ছিলো না। (এক তথ্যে জানা যায়, ঢাকার স্মৃতি স্তম্ভটি তৈরি হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। দেশের অন্য কোথাও যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয় সেটিও ইতিহাসে স্থান দেয়া উচিত)। রাজশাহী ভুবন মোহন পার্কের প্রতিবাদ সভাটি পুলিশের বাঁধার কারণে না হতে পেরে তা রাজশাহী কলেজ চত্বরে হলো।
ঢাকা তেঁজগা থানা থেকে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের ঢাকা কোর্টে নেয়া হলে কোর্ট চত্বর লোকারণ্য হয়ে উঠলো। পাকিস্তানি সৈন্য ও পুলিশ বাহিনী কোর্ট চত্বর ঘিরে ফেললো। গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান শেলী পাকিস্তানি সৈন্য ও পুলিশদের  ঘটনাটি বোঝানোর জন্য উর্দুতে বক্তৃতা দিলেন। ‘মনিং নিউজ’ সংবাদপত্র পুড়ানো হলো। গ্রেফতারকৃতদের কোর্ট এজলাসে না নিয়ে খুনের চেষ্টা, দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা, সরকারি কর্মচারীদের উপর হামলার চেষ্টা ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা দিয়ে তাদের ঢাকা কারাগারে দেয়া হলো। রাজশাহীর পরিস্থিতিও উত্তপ্ত হয়ে উঠলো।…রাজশাহী ভুবন মোহন পার্কের প্রতিবাদ সভায় মুসলিম লীগের নেতা জননেতা মাদার বখ্শ পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন। যারা ভাষা আন্দোলনে বিরোধী ছিলেন তারা মাওলানা আক্কেলপুরীর মতো সরকারের তীব্র সমলোচনা করে আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন। ক্যাপ্টেন শামসুল হকসহ আরো কয়েকজন বক্তব্য রাখলেন। তবে কেউ কেউ এ আন্দোলন কমিউনিস্টদের আন্দোলন ভারতীয় চরদের আন্দোলন মন্তব্য করতে থাকলেন। ভুবন মোহন পার্কে লাগানো পোস্টার অনেকের সহ্য হলো না। জননেতা মাদার বখ্শসহ অনেকে গ্রেফতার হলেন, রাষ্ট্রভাষার জন্য পৃথিবীর কোন দেশে আন্দোলন হয়নি রক্ত ঝরেনি। ভারতের আসামে এ ধরনের একটি আন্দোলন হলেও তা সফল হয়নি। এমনকি পাকিস্তান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষিদের মধ্যে এ নিয়ে কখনো কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। একুশ প্রতিবাদের, তাই বিগত সেইসব একুশ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ছাত্রসমাজ আন্দোলনের অঙ্গীকারে উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। উনিশশো বায়ান্ন’র একুশ ফেব্রুয়ারি শিখিয়েছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, শিখিয়েছে বাঙালিদের অস্তিত্ব  প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠতে।  একুশের পথ ধরেই এসেছে ৬৯এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়। এটা ছিলো বাঙালিদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। একে নাজায়েজ বলে থামিয়ে রাখা যায়নি।
পাকিস্তানি সৈন্যরা চেতনার এই শহিদ মিনার গুড়িয়ে দিয়ে বাঙালির চেতনা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলো। পারেনি, সেটি গেঁথে ছিলো বাঙালির হৃদয়ে। সেই শহিদ মিনার আমরা আবার গড়ে তুলেছি। একুশ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এজন্যও বাঁধা অতিক্রম করতে হয়েছে। উনিশশো নিরানব্বই সনে প্যারিসের ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এ এইচ এস কে সাদেক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর সাইদুর রহমান খান ১৮৮ দেশের প্রতিনিধিদের বহু যুক্তি দিয়ে একুশ ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব, বাংলা ভাষার গুরুত্ব বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের এই অবদান কম নয়। একুশ এখন বিশ্বজনিন। অনেকে একে উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে থাকেন। তাদের যুক্তি একুশ আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই এই দিনটি উৎসবেরও। একুশের চেতনা কী তা বুঝতে হবেÑ তা না হলে উৎসবের সীমাবদ্ধতায় একুশের মূল চেতনা ধামা-চাপা পড়ে যাবে। বর্তমান প্রজন্ম সরে যাচ্ছে মূল চেতনা থেকে। মূল চেতনাটিকে চাপা দিয়ে উৎসবের মধ্যে দিয়ে দিনটি পালন আত্মাবমাননারই বহিঃপ্রকাশ। দৃষ্টি কুটু লাগে তখন, যখন অকারণে কেউ কেউ ভুল ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে গর্ববোধ করেন। কিংবা অকারণে বিদেশি অপ্রয়োজীয় সংস্কৃতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। এটা গর্বের নয় বরং লজ্জার। বরং শুদ্ধ করে মাতৃভাষা বাংলা বলা অনেক গর্বের। দেশীয় মূল্যবোধ দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা, ধারণ করা, অনেক গর্বের। একুশের চেতনায় বিভিন্ন জাতি তাদের জাতিসত্ত্বা, নিজ নিজ ভাষার মর্যাদা ও সমৃদ্ধির ব্যাপারে ভাবার অনুপ্রেরণা লাভ করছে। একুশের চেতনার প্রেরণাকে হৃদয়ে ধারণ করে তাদের এই ভাবনাকে যথাযথ মূল্যায়ণ করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুযোগ করে দেয়া হোক। ভাষা শফহদের স্মরণে একুশের রাতে রাজশাহী কলেজ হোস্টেলে তৈরি করা শহিদ স্মৃতি স্তম্ভটিকে দেশের প্রথম শহিদ মিনার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভাষা আন্দোলনের বীরদের প্রতি সন্মান জানানো হোক।