ভূমিপুত্রদের আত্মসম্মান বোধ

আপডেট: নভেম্বর ২২, ২০১৬, ১১:৫৮ অপরাহ্ণ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
সাওতাল জনগোষ্ঠি এ দেশে আদিবাসী নামে পরিচিত। মানব সভ্যতার সূচনালগ্নে এ ধরনের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসীরাই চাষাবাদের মাধ্যমে ভূমিকে উৎপাদন উপযোগী করে গড়ে তোলে। মানুষের অন্ন ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের প্রাথমিক উৎপাদন শুরু হয় ভূমি এবং তার উপরিস্থিত বসাবাসরত প্রাণী এবং উদ্ভিদ থেকে। তাই আদিবাসীদেরকে বলা হয় ভূমিপুত্র। কারণ, পৃথিবীতে এরাই প্রথম ভূমিকে ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন করেছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীরা সবাই ভূমিনির্ভর। সেই প্রাচীনকাল থেকে ভূমির কর্তৃত্ব এদের হাতে ছিল। আদিবাসী জনগোষ্ঠি কৃষিনির্ভর জীবন প্রণালিতে অভ্যস্থ। গাইবান্ধার গোবিন্ধগঞ্জের সাহেবগঞ্জের আদিবাসীরা তার ব্যতিক্রম নয়, কৃষিই এদের প্রধান পেশা। তাদের কায়িক শ্রমের বদৌলতে ভরে উঠে বাংলাদেশের শস্য গুদাম।
বৃটিশ আমলে শুরু হয়েছিল নীল চাষ। প্রখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পন নাটকে নীলকরের অত্যাচারসহ সে সময়ের সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে। নীলকর সাহেবরা তৎকালীন প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চালাতো এদেশের কৃষকের উপর। বৃটিশ বিতাড়িত হয়েছে। বৃটিশদের তৈরি করা প্রশাসন যন্ত্রের পরির্বতন হয়নি। শুধু পরির্বতন হয়েছে স্টিয়ারিং ঘুরানো চালাকের। লাল চামড়ার ইংরেজদের পরিবর্তে স্টিয়ারিংটা হাতে নিয়েছে এদেশিয় আমলারা। প্রায়োগিক আচরণের কোন পরির্বতন হয়নি যার নজির ফুটে উঠেছে গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জের সাওতাল পল্লিতে। শাসক আর প্রজা প্রথাটা বৃটিশ আমলে ছিল, শাসকগোষ্ঠি নিজস্বার্থে প্রজাদের উপর অত্যাচার  চালাতো। প্রজাদের বৃটিশদের অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করতে হতো। ওটা ছিল বৃটিশ আমল, শাসক ছিল ইংরেজ। কিন্তু ৩০ লক্ষ মানুষের রক্ত আর দুই লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে কেন শাসক আর প্রজার যোজন যোজন ব্যবধান থাকবে। কেন শাসক শ্রেণির গুলিতে অকাতরে প্রাণ হারাবে এদেশের সাধারণ নাগরিক। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে এই প্রজাতন্ত্রের মালিক জনসাধারণ। সাহেবগঞ্জের সাওতাল অধিবাসীরা এদেশের জনগণ। তারাও এদেশের মালিক। পুলিশ এবং প্রশাসনিক কর্মচারীরা প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী। কিন্তু দুর্ভাগ্য প্রজাতন্ত্রের মালিককে প্রাণ দিতে হচ্ছে তারই অর্থে যে কর্মচারী বেতন নেয় তারই হাতে। মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এখনো প্রশাসন যন্ত্র চলে বৃটিশ স্টাইলে। বৃটিশ আমলাদের ন্যায় আচরণ বিদ্যমান দেশের প্রশাসন কর্মে নিয়োজিত আমলাদের। নীল চাষ ও আখ চাষ দুটোর মধ্যে পার্থক্য ফারাক। তারপরও সাহেবগঞ্জে দেখা গেল, নীল কর সাহেবদের মতো ঔদ্ধত্য আচরণ প্রশাসনের কর্মীদের। চিনিকলের কথিত সম্পত্তি উদ্ধার করতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন নির্বিচারে বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মানুষ হত্যার মতো ঘটনা ঘটায় আদিবাসী সাওতাল পল্লিতে। নীলকর সাহেবদের ঔদ্ধত্য আচরণকে হার মানিয়েছে বর্তমান প্রশাসনের কর্মকা-। সাওতালরাই এদেশের আদি ভূমিপুত্র। তারা ভূমিকে মাতৃরূপে ফলন সম্ভাবনাময় করে তুলে আর ফসল ফলায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ভূমি অধিকার রক্ষায় সাওতাল আদিবাসীরা বার বার বিদ্রোহ করছে। তেভাগা আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, সাওতাল বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তারপর বার বার তারাই ভূমিবঞ্চিত। সাওতাল আদিবাসীরা পরিশ্রমী- শ্রম দিয়ে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে। কোন প্রকার কূটকৌশল বা প্রতারণার আশ্রয় তারা নেয় না। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক কর্মকা- বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাওতাল জনগোষ্ঠি কোন ধরনের দুই নম্বরী কাজে জড়িত নয়। কোন আদিবাসী প্রতারণা করে ভিজিএফ কার্ড বা স্বল্প মূল্যের চাল দেয়ার রেশন কার্ড নিতে শুনা যায়নি। এরা আর্থিক কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করলেও নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দেয় না। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় এই জনগোষ্ঠির অনেকেই শিক্ষা গ্রহণ না করলেও মানবিকতার শিক্ষায় এরা অনেকের চাইতে উচ্চশিক্ষিত।
গাইবান্ধার ঘটনাটি যে সরকার কর্তৃক নির্যাতন, তা নানা দিক বিশ্লষণ করলে তার প্রমাণ মেলে। পুলিশের হয়রানিতে গাইবান্ধার মাদারপুরে সাওতাল পল্লি আজ পুরুষশুন্য। ওখানকার আদিবাসী নারীদেরকেও সম্ভ্রমের ভয়ে থাকতে হচ্ছে আত্মগোপনে। কাদের ভয়ে এই জনগোষ্ঠি আতঙ্কিত? তাদের প্রতিপক্ষ কে ? পুলিশের ভয়ে আজ তাদের এই অবস্থা। যে জনগোষ্ঠির প্রতিপক্ষ সরকার সেই জনগোষ্ঠির মত দুর্ভাগা এ জগতে আর কেউ নেই। গাইবান্ধার মাদারপুর ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জের সাওতাল উপার্জনক্ষম নারীপুরুষের কাজকর্ম বন্ধ। তাই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটছে এই মানুষগুলির। গত  ৭ নভেম্বর দেশের প্রশাসনের সহযোগিতায় বৃটিশ নীলকর সাহেবদের মতো চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাওতাল অধিবাসীদেরকে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের অভিযান চালায়। এই অভিযানে লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ নারীদের নিগৃহিত করার মতো ঘটনা ঘটায় প্রশাসন। চিনিকলের আওতাধীন কথিত এলাকাটিতে প্রায় ২০০ এর অধিক সাওতাল আদিবাসী পরিবার বাস করে আসছে আর তাদেরকে উচ্ছেদ করতে পুলিশের এই নির্মম অভিযান। পুলিশের এই নৃশংস আক্রমণের প্রতিবাদ জানায় আদিবাসীরা। এতে পুলিশসহ ১০ জন তীরবিদ্ধ হয়। পুলিশের নির্বিচারের গুলিতে আহত হয়ে শ্যামল হেমরম নামে একজন আদিবাসী, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পুলিশি তা-বের পর সাহেবগঞ্জের ধান ক্ষেত থেকে টুডু নামে একজন আদিবাসীর মৃতদেহ উদ্বার করা হয়। আর কত লাশ পাওয়া যাবে তাও সঠিক করে কেউ বলতে পারছে না কারণ পুরুষ আদিবাসীরা এলাকায় নেই। দুঃখজনক ঘটনা হলো পুলিশ হামলা চালালো পুলিশের গুলিতে আদিবাসী দুইজনের মৃত্যু এ পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছে। তারপর পুলিশেই আবার ৩০০ থেকে ৪০০ জন আদিবসীকে ঘটনার জন্য দায়ী করে  মামলা করেছে। এই মামলার আসামী হিসাবে পুলিশের আঘাতে আহত বেশ কয়েক জন আদিবাসীকে ইতোমেধ্য পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। তাদের মধ্যে মুমুর্ষ আদিবাসীরা পুলিশের হাতকড়া পড়া অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, সাহেগঞ্জের বিরোধপূর্ণ ভূমিটুকুর উত্তরাধিকার হিসাবে আদিবাসীরা ১৮৪২.৩০ একরের মালিক। পাকিস্তানের শাসনামলে তৎকালীন সরকার এই জমি ইক্ষু চাষ করতে রংপুর সুগারের মিলের জন্য লিজ নেয়। এই লিজ চুক্তিতে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত ছিল। এই চুক্তির শর্তগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল চিনিকলের স্বার্থে এই জমি ইক্ষু চাষে ব্যবহার করা হবে। অন্য কাউকে লিজকৃত জমি লিজ দেয়া যাবে না। বাস্তব অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, চিনিকল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এই জমিতে ধান পাট, নানা ধরনের ফসল তৃতীয় পক্ষ চাষ করছে। তাছাড়া পুকুর খনন ও বসতি স্থাপনও করা হয়। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে পুরো ভূমিটাই গ্রাস করার চেষ্টায় লিপ্ত। বাংলাদেশের চিনিকলগুলি লোকসান গুণছে দীর্ঘদিন ধরে। তাই লিজ নেয়া এই জমিটা আদিবাসীদের ফিরিয়ে দেয়াটা উচিত। কারণ ১৯৪০ সালের আরএস অনুযায়ী রংপুর চিনিকলের সাড়ে পাঁচ হাজার বিঘা বাগদা ফার্মের সাড়ে চার হাজার বিঘার মালিক সাওতাল  আদিবাসীরা। এই ফার্মটির নামকরণ হয়েছে আদিবাসী বাগদা সরণের নামানুসারে। এই ফার্মটি মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকলের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ আখ উৎপাদনকারী খামার। ফার্ম অংশ বিশেষ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় আদিবাসীরা বসতি গড়ে তুলেছে। গ্রামীণ এই আদিবাসী বসতিতে ঘরবাড়ি ছাড়াও ছিল তাদের পালিত পশুসম্পদ। পুলিশের হামলায় লুট হয় তাদের সকল সম্পদ আর তাদেরকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখতে হয়েছে নিজ আবাস্থল লেলিহান আগুনের শিখায় পুড়ে শেষ হওয়ার দৃশ্যটি। এত বড় অপরাধ যারা ঘটালো তাদের বিরুদ্ধে কোন ফৌজাদারি মামলা পর্যন্ত হয়নি। অপরদিকে এই নির্মমতার ভুক্তভোগী আদিবসীরাই তের শিকের মধ্যে বন্দী। দু ধরনের ক্রুঢ়তার রোষানলে সাহেবগঞ্জের আদিবাসীরাÑ একদিকে সরকারি পুলিশবাহিনী অপরদিকে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকা ভূমিদস্যু। পুলিশের নির্মম আক্রমণ চালানোর পর বসতবাড়ি হারানো পরিবারগুলি যখন খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবন-যাপন করছে তখন সরকারের প্রশাসন রিলিফ নিয়ে হাজির হলেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্যাতিত ১৫০ টি সাওতাল পরিবারের প্রত্যেককে ২ কেজি চাল, ১ লিটার তেল, এককেজি লবণ, দুইটি কম্বল দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। কর্তৃপক্ষের এই আচরণটাকে আদিবাসীরা দেখেছে ‘জুতো মেরে গরুদান’ প্রবাদটির মতো। তাই নির্যাতিতরা সরকারের রিলিফ প্রত্যাখ্যান করেছেন। আদিবাসী নেতা বলেন, একদিকে ত্রাণ দিচ্ছে  অন্যদিকে  কাটাতার দিয়ে জমি দখল করে নিচ্ছে। এই নির্মম আচরণের পর কোন বিবেকবান মানুষ ত্রাণ নিতে পারে। বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা গেছে, এতে দেখা যায় প্রায় দুই শতাধিক বাড়ি ঘর লুট হয়েছে। খুন হয়েছে তিন জন। এই ফৌজাদারি অপরাধের কোন মামলা এখন পর্যন্ত হয় নাই। তাই তাই আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন আদিবাসী ভূমি পুত্ররা সরকারি রিলিফ ঘৃণ্যভরে প্রত্যাখ্যান করে। দেশের শিল্প সচিব বলেছেন, শিল্প দপ্তরের বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে তারা অভিযান পরিচালনা করেছেন। কিন্তু কাগজপত্রে দেখা যায়, ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই একটি চুক্তির মাধ্যমে চার মৌজার ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি চিনিকল ও আখের চাষের জন্য নেয়া হয়। ওই চুক্তির ৫ নং শর্তে বলা আছে, যদি কখনো এই জমিতে আখ ছাড়া অন্য কিছু চাষ করা হয় তাহলে জমি মূল মালিককে ফেরত দেয়া হবে। অধিগ্রহণের ৪০ বছর পর ২০০২ সালে একবার এবং ২০০৪ সালে আরেকবার চিনিকলটি লে অফ (বন্ধ) ঘোষণা দেয়া হয়। মিলটি বন্ধ হলে পাঁচ নং শর্ত অনুযায়ী জমি মূল মালিক আদিবাসীদের ফেরত দেয়ার কথা কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই কথা রাখেনি। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী আদিবাসীদের এই ভূমি নামে বেনামে ইজারা নেয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়,  ১৯৬২ সালে যখন জমি অধিগ্রহণ করা হয়, সেই সময়ে জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ কোন অর্থ আদিবাসীদের দেয়া হয়েছিল কিনা  তারও সঠিক তথ্য নেই।
শিল্প মন্ত্রনালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা এই লিজ নেয়া শর্ত সাপেক্ষের ভূমি নিয়ে যা ঘটনা তা দেখে দেশবাসী হতবাক। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বহু শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সকল শিল্প কারখানার ভূমি বেদখল হয়ে আছে। কোন সময় তো শুনা যায়নি অন্য সব বন্ধ হওয়া মিলের জমি দখলে শিল্প মন্ত্রনালয়ের এ ধরনের আচরণ। মানুষ খুন করে লিজ নেয়া শর্ত সাপেক্ষের ভূমি উদ্ধার করার প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল। প্রকৃতার্থে সার্বিক দিক বিবেচনা করলে সাহেবগঞ্জের চার মৌজার ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমির মূল মালিক আদিবাসী সাওতালরা। সরকার সার্বিক বিষয়গুলি বিবেচনা করে এই জমি আদিবাসীদের কে ফেরত দেবে আর এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটানোর জন্য দায়ী ব্যক্তির যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করবে এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক:- কলামিস্ট