মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
গুরুদাসপুর প্রতিনিধি
দশ লিটার খেজুর রস। তাতে দুই কেজি চিনি। রয়েছে সোডা, ফিটকারি, ধানের গুঁড়া, ভুট্টার আটার সঙ্গে অন্য কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গ্রাম বাংলার চিরায়ত খেজুর রসের গুড়। দশ লিটার খেজুর রসে এক কেজি চিনির মিশ্রণে গুড় উৎপাদন হচ্ছে চার কেজি।
স্বাদ গন্ধহীন এই ভেজাল গুড়েই সয়লাব হচ্ছে গুরুদাসপুরের হাট-বাজার। দিন বদলের সঙ্গে বাড়ছে চাহিদা। পক্ষান্তরে কালের বিবর্তনে আশঙ্কাজনক হারে কমছে খেজুর গাছের সংখ্যা। কমছে রসের উৎপাদনও। আর সেই সঙ্গে মজুরি ও জ্বালানি খরচ বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে ভেজালের প্রবণতা।
গুড় উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কার্ত্তিক মাসের মধ্যভাগ থেকে চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তা জুড়ে চলনবিল অঞ্চলের নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, লালপুর, পাবনার চাটমোহর উপজেলায় বিকল্প আয়ের পথ হিসেবে খেজুর গুড় উৎপাদন হয়ে থাকে।
গুড় বিক্রি করতে আসা হাফিজ উদ্দিন, আবদুল মান্নান ও ফজর আলী জানান, উৎপাদন খরচ বাদে বাড়তি লাভের আশায় খেজুর গুড়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন তারা। কিন্তু চাঁচকৈড় বাজার ও নাজিরপুর বাজার এলাকায় অন্ততপক্ষে ১০ জন অসাধু ব্যবসায়ী কারখানা খুলে হাজার হাজার মণ ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। তারা বাজার থেকে কম দামে নি¤œমানের ঝোলা ও নরম গুড় কিনে ও গলিয়ে তাতে চিনি, রং, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকারি ও বিশেষ গাছের ছাল গুড়া তৈরি করে গুড় তৈরি করছেন। সেই গুড় স্থানীয় হাট-বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রাক ভরে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এ ভেজালের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
উপজেলার গুড়ের বড় মোকাম চাঁচকৈড় ও নাজিরপুর হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানভেদে প্রতি কেজি খেজুর গুড় ৮০-৯০ টাকা ও ঝোলাগুড় ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মৌসুমি গুড় উৎপাদনকারিরা এসব গুড় বিক্রি করছেন।
উপজেলার চাঁচকৈড় হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা প্রান্তিক গুড় উৎপাদনকারী রওশন আলী, খবির প্রামানিক ও কোরবান আলী জানালেন, তারা প্রতিটি গাছের জন্য মালিককে মৌসুম ভিত্তিক (খাজনা) ২শ থেকে ৩শ টাকা দিয়ে থাকেন। মজুরি, জ্বালানি খরচ করে উৎপাদন খরচ ওঠে না। খাঁটি গুড়ের উৎপাদন খরচ পড়ে গড়ে ১শ টাকা। কিন্তু বাজারে এত দামে বিক্রি করা যায় না। তাই গুড়ের চাহিদা ও উৎপাদন খরচ পুষিয়ে নিতে প্রতি ১০ লিটার রসে দুই কেজি চিনি মেশান তাঁরা। গুড়ের রং ফর্সা ও শক্ত করতে চিনি মেশাতে বাধ্য হন তারা। চিনি মেশানো এই গুড়ে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ থাকে না ঠিকই তবে চিনিমুক্ত গুড়ে রং হয় কালো। তাতে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ অটুট থাকে। এই গুড় প্রতিকেজি ১শ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
এসব গুড় উৎপাদনকারী ও বিক্রেতাদের ভাষ্যমতে, প্রতি ১০ লিটার খেজুর রসে এককেজি গুড় উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতি কেজি গুড় উৎপানে খরচ হয় (জ্বালানি, মজুরিসহ) ৭০ টাকা। পক্ষান্তরে ১০ কেজি রসের সঙ্গে দুই কেজি চিনি মেশালে গুড় বেড়ে হয় দ্বিগুণ। ৫ কেজি গুড়ের গড় দাম ৮০ টাকা কেজি হলে ৪শ টাকা হয়। সেক্ষেত্রে দুই কেজি চিনিতে চার কেজি বেশি গুড় উৎপাদন হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ৬০ টাকা। ভেজাল গুড় তৈরি করে ৩৩২ টাকার মধ্যে চিনির ১২০ টাকা বাদ দিলে মুনাফা থাকে ২১২ টাকা।
ঢাকা থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী হানিফ আলী ও সিরাজগঞ্জের উল্লাহপাড়া থেকে আসা আসমত ব্যাপারী জানালেন. খেজুর গুড়ের সেই ঐতিহ্য আর নেই। প্রান্তিক পর্যায়ের মৌসুমি গুড় উৎপাদনকারী ও মহাজন সকলেই ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। গুড়ের রং ফর্সা ও শক্ত করতে তারা যথেচ্ছাভাবে চিনির সঙ্গে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন।
খেজুর গাছ নিধনের কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলছেন, গত প্রায় দেড় দশক ধরে যথেচ্ছাভাবে খেজুর গাছ কেটে ইটভাটার জ্বালানির চাহিদা মেটানো, আবাদী জমি কেটে পুকুরকাটা, আম-লিচুর বাগান তৈরি করায় খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে। নিধনকৃত গাছের অভাব পূরণে নতুন করে গাছ লাগানো হচ্ছে না। আবার যেসব গাছ রয়েছে সেসব গাছ সংরক্ষণেরও নেই কোন উদ্যোগ।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুল করিম জানান, উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ৬৮ হাজার ৮৯০টি খেজুর গাছ রয়েছে। এরমধ্যে রস দেয়ার উপযোগী গাছের সংখ্যা রয়েছে ৪১ হাজার ৮১০টি। পরিসংখ্যান মতে, প্রতিটি গাছ বছরের শীত মৌসুমে ১৮০ লিটার রস দেয়। (প্রতি ১০ লিটারে ১ কেজি গুড় হয়)। ওই হিসাবে ৭২০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন হয়। বাজারে প্রতি কেজি গুড়ের উৎপাদক পর্যায়ে ৭০ টাকা কেজি দরে আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ছয় কোটি টাকার ওপরে। তবে ইটভাটার কারণে খেজুর গাছের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক রবিউল করিম জানান, খেজুর গুড়ে চিনি, রং, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকারি মিশ্রণের কারণে খাদ্যনালীতে ক্যান্সার, কিডনী ড্যামেজ, লিভারে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. ইয়াসমিন আক্তার বলেন, এখানকার খেজুর গুড়ের অনেক সুনাম রয়েছে বলে শুনেছি। গুড়ে ভেজাল মেশানোর বিচ্ছিন্ন অভিযোগ এসেছে। ভেজাল রোধে দ্রুত অভিযানে নামা হবে।