ভোট বিমুখ পদ্মা চরের নারী!

আপডেট: জানুয়ারি ২২, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

ফাইল ফটো

শাহিনুল ইসলাম:


দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীদের ভোট বিমুখিনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। রাজশাহীর তিনটি আসন এলাকার পদ্মাচরের নারীদের মধ্যে ভোটদানে অনাগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। ওই এলাকাগুলোতে ১৬টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৮ হাজার ৪৩৩ জন। নারী ভোটার সংখ্যা ১৪ হাজার ৪২ জন ও ১৪ হাজার ৩৯২ জন পুরুষ ভোটার। এবার চরের তিন আসনের মোট ১৬টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১০ হাজার ৫৯৪। এরমধ্যে নারীরা ভোট দিয়েছে প্রায় পৌনে ৫ হাজার। সেই জায়গা থেকে নারীদের ভোট প্রদানের হার কম।

চর এলাকার কেন্দ্রগুলোতে দেওয়া মোট ভোটের হিসাবেও রয়েছে ভোটের প্রতি চরজনগোষ্ঠীর অনাগ্রহের চিত্র। নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে প্রারম্ভিক বিশ্লেষণে এমন মূল্যায়ন ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর নাগরিক জীবনের বহুমুখী বঞ্চনা, ভোটাধিকার সম্পর্কে অজ্ঞানতা, যাতায়াতের দুর্ভোগ এবং অতি দারিদ্র্য ভোটে অনাগ্রহের অন্যতম কারণ।

জেলার নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মতে, রাজশাহীর ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে তিনটির পাশ দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদী। সদ্য সমাপ্ত ভোটের হিসেবে অন্য তিনটি আসনের তুলনায় চর সংগল্ন আসনগুলোতে ভোট পড়েছে কম। এর মধ্যে চরের কেন্দ্রগুলোতে দেওয়া ভোটের অংক ছোট। তার চেয়েও ছোট হয়েছে চরের নারীদের ভোটের হিসাব।

রির্টানিং কর্মকর্তার দপ্তরের তথ্যের বরাত দিয়ে বিশ্লেষকরা জানান, অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জেলার ছয়টি আসনে গড়ে ভোট পড়েছে ৪২ শতাংশ। চরমুক্ত আসনগুলোতে এ হার প্রায় ৫০ শতাংশ হলেও চরসম্পৃক্ত আসন তিনটিতে তা নেমেছে ৩৫ শতাংশের নিচে।

নির্বাচন কমিশনের হিসেবে, এবার চরের তিন আসনের মোট ১৬টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১০ হাজার ৫৯৪। যা মোট ভোটারের ৩৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ নিতান্তই কম ছিলো বলে জানিয়েছেন ভোটগ্রহণ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা। একটি কিংবা দুটি নয়, এবারে চরের প্রায় সবগুলো কেন্দ্র নারী ভোটারদের উপস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় কম ছিলো জানিয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোনো কেন্দ্রে মোট দেওয়া ভোটে নারীদের অংশগ্রহণ ১০ শতাশের নিচে ছিলো বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

রাজশাহী জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে পদ্মার চর এলাকায় ভোট কেন্দ্র ছিলো পাঁচটি। তার একটি দিয়াড় মানিকচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এ কেন্দ্রের মোট ৩ হাজার ২৮৩ ভোটারের মধ্যে নারী ১ হাজার ৪৯১ জন এবং পুরুষ ভোটার ছিল ১ হাজার ৭৯২ জন। কিন্তু ভোট পড়েছে মাত্র ৬৪২টি। যা কেন্দ্রের ভোটের ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যতঃ এক তৃতীয়াংশের মত হোতে পারে বলে নিজের ধারণা ব্যক্ত করেছেন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মশিউর রহমান।

একইভাবে দিয়ার মানিকচক নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার ছিল ১ হাজার ৪৭৯ জন। এরমধ্যে নারী ৭০৫ জন ও পুরুষ ৭৬৯ জন। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ২৬১টি। যা শতকরা হিসেবে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ কেন্দ্রে নারীদের উপস্থিতি এতই কম ছিলো যে দিনোর কোন সময়েই ভোট দিতে কাওকে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি বলে জানিয়েছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী।

চর আষাড়িয়াদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৪১৪ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ হাজার ৫৫৭ জন। ভোটের সংখ্যায় নারী পুরুষ সমানে সমান হলেও ভোটের লাইনে নারীদের উপস্থিতি হতাশাজনক ছিলো বলে জানিয়েছেন আনছার সদস্য মোতালেব।

রাজশাহী-৩ আসনে চরনবীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৩২০ জনের মধ্যে ভোট দিয়েছে ৭২২জন। এরমধ্যে নারী ১ হাজার ৫৮৯ জন এবং পুরুষ ভোটার ছিল ১ হাজার ৭৩১। ভোট পড়ার হার ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া চরখিদিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ হাজার ৭৮৬ জনের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২৪০জন। এরমধ্যে নারী ১ হাজার ৩২৮ জন এবং পুরুষ ভোটার ছিল ১ হাজার ৪৫৮। শতকরার হিসেবে ভোট পড়েছে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।

রাজশাহী-৬ আসনের বাঘা উপজেলার পদ্মার চরে এবার নয়টি ভোট কেন্দ্র ছিল। তার মধ্যে লক্ষ্মীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ১ হাজার ১৮৮ জনের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৫৬৫ জন। এখানে সারাদিনে শ’দেড়েক নারী ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা।

পূর্ব চকরাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০৭ ভোটারের মধ্যে নারী ২৫৮ ও পুরুষ ২৪৯ জন ভোটার। আর ভোট দিয়েছে মাত্র ১৬৫ জন। এ কেন্দ্রে দেওয়া ৩২ দশমিক ৫৪ শতাংশ ভোটে নারীর অংশগ্রহণ ১০ শতাংশেরও কম ছিল বলে মন্তব্য করেছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর এক পুলিং এজেন্ট।

চর সংশ্লিষ্ট আসনগুলোয় এবার কম ভোট পড়ার তথ্য সরেজমিনে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চরের নারী ভোটারদের মুখে মুখে বঞ্চনা, হতাশা আর ক্ষোভের চিত্র উঠে এসেছে। কথা হয়েছে পৃথক পৃথক চরবাসীর বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ভোটার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে।

তাদের মধ্যে চর খিদিরপুরের চলিশোর্ধ্ব ভোটার রাজিয়া বেগম বলেন, ‘ঘর সংসারের নিত্যকার সব কাজ ফেলে ভোট দিতে সকালে বের হয়েছি। কেন্দ্রে এসে ভোট দিয়েছি। কিন্তু ভোটের লাইনে হাতে গোনা নারী দেখে অবাক হয়েছি। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি আশেপাশের অনেকেই ভোট দেয়নি।’ রাজিয়া জানান, ‘ভোটের সময় প্রার্থীরা চরে এসে ভালো ভালো কথা বলে, ভোট শেষে তারা আর কখনো চরে আসেন না, চরের মানুষের খবরও রাখেন না। তাই কাজ ফেলে নিজের টাকা আর সময় নষ্ট করে অনেকেই ভোট দিতে যায় না। ভোট নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই চরের লোকদের।’
তার অভাব তো রয়েছেই। তার মতে, সার্বিকভাবে ভোটে তার সুফল পড়েছে।

চর আষাঢ়িয়াদহের ভোটার রফিয়া বেগম বলেন, নির্বাচন এলে আমরা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিই, কিন্তু ভোটে জিতে তারা আমাদের কিছুই দেয় না। তবুও আমি আবার ভোট দিলাম। কিন্তু আমার আশেপাশের অনেকেই ভোট দিতে যায়নি। বাড়িতে বসে যে যার কাজ করেছে।

চরের ভোটের বিষয়ে চরখিদিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খন্দকার মো. বাতেনুর রহমান বলেন, নির্বাচন চরবাসীর জীবন মানে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। তাই ভোট নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। এর অনেক কারণের মধ্যে অন্যদম হচ্ছে নাগরিক অধিকার বঞ্চনা। জীবন জীবিকার লড়াইয়ের দীক্ষা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব ভোটার হয়েও ভোট দিতে না যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন এই শিক্ষক।

চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম ভোলা বলেন, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে চর জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ ভোট দিতে যায় না। এ অবস্থা নারীদের ক্ষেত্রে আরো প্রকট বলেও মনে করেন স্থানীয় সরকারের এই জনপ্রতিনিধি। তিনি অকপটে জানালেন, চরের কেন্দ্রগুলোতে যে সংখ্যক ভোট পড়েছে তার মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ এক তৃতীয়াংশেরও কম।

এ বিষয়ে বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রির্টানিং কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, তুলনামূলক পুরুষের তুলনায় নারীরা বাইরে কম আসে। এবারের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের কারণে আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় এবার চরের কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বেশি। তবে পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারের উপস্থিত কম বলে উল্লেখ করলেও কারণ সম্পর্কে বলেননি কিছুই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাবির পলিটিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক সুলতান মাহমুদ বলেন, রাজশাহী চরাঞ্চলের মানুষ পিছিয়ে আছে সবদিক থেকে। পিছিয়ে থাকলেও বিশেষ করে নারীরা ভোটদানের ক্ষেত্রে উৎসাহী হওয়ার কথা না। ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপারটি যথাযথভাবে জানে না বা বুঝে না। পাশাপাশি তাদেরকে নানাভাবে মোটিভেটেড করা যায়। তারা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে সিদ্ধান্ত নিতে হলে আত্মসচতেনার লেভেলটি বেশি থাকতে হয়। চরাঞ্চলের নারীদের শিক্ষার ঘাটতি আছে। শিক্ষার হারও কম।

রাজশাহী জেলা প্রশাসকের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) সরকার অসীম কুমার বলেন, চরে পুরুষের তুলনায় নারীদের ভোট কম পড়েছে। তবে খুব বেশি নয় দুই শতাংশ কম হতে পারে।

সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক জেলা সভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বঞ্চনায় ভরা চরের মানুষের জীবন জীবিকা দেখে তাদের ভিনদেশের নাগরিক বলে মনে হয়। নির্বাচন এলেই প্রার্থীরা চরের জনগোষ্ঠীকে প্রতিশ্রুতির জেয়ারে ভাসায়। ভোট শেষে তা ভাটার টানে হারিয়ে যায়। চর এলাকা বা চরবাসীর স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়। যুগযুগ ধরে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার কারণে কেউ কেউ ইচ্ছা সত্ত্বেও ভোট দিতে যেতে পারেন না, বিশেষ করে বয়স্ক ভোটারররা। তুলনামূলক সচেতন চরের ভোটার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার বঞ্চনার ক্ষোভ আর হতাশা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগে বিরত থাকেন। পাশাপাশি শিক্ষা ও সচেতন