ভ্যাট আইন’১৭ বাতিল করলেও বাজেটে ঘাটতি হবে না: প্রসঙ্গকথা

আপডেট: জুলাই ৩১, ২০১৭, ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

ফিকসন ইসলাম


বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এক বক্তৃতায় বলেছেন- ‘ভ্যাট আইন ১৭’ আগামী ২ বছরের জন্য স্থগিত হওয়ায় বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ হাজার কোটি টাকা। নিঃসন্দেহে এটি দেশ ও জাতির জন্য একটি ভয়াবহ সংকট। বিশেষ করে ২০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হলে জাতীয় বাজেট (২০১৭-২০১৮) বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হবে। এমনিতেই চলতি বছরের বাজেট কে অতি উচ্চাভিলাষী বাজেট হিসেবে নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। ভ্যাট আইন’ ২০১৭ জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পূর্বেই সারা বছরব্যাপি এ বিষয়ে বিভিন্ন পেশা ও সংস্থার বিশেষ করে ব্যবসায়িকদের তোপের মুখে পড়ে। এ নিয়ে সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে, মানববন্ধন হওয়ার পরও অর্থমন্ত্রী গত ১ জুন বাজেট অধিবেশনের বাজেট বক্তৃতায় ভ্যাট আইন ২০১৭ এর রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এরপর থেকেই নানাভাবে আলোচনা সমালোচনার মুখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২ বছরের জন্য ভ্যাট আইন’ ২০১৭ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিলে এনিয়ে আপাততঃ স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু নিন্দুকেরা তো আর বসে নেই- সমালোচকরা ভ্যাট আইন’১৭ স্থগিত করায় এ কথা বলতে শুরু করেছে যে, আগামী সংসদ নির্বাচনে নৌকাকে বিজয়ী করার কৌশল হিসেবে এ পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে ঘটনা যাই হোক না কেন রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে ‘কর’ আদায় করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আর বাজেট বাস্তবায়নে কর আদায়ে সরকার ও সরকারি যন্ত্র যদি সতর্ক হয় কিংবা সততার সাথে কাজ করে তাহলে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করেও তার চেয়ে বেশি কর আদায় করা সম্ভবপর হবে এবং এটার বাস্তবিক প্রয়োজন শুধু সততা।
মহান জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের বাজেট বাস্তবায়নের শুরুতেই বাধার মুখে পড়েছে এবং ইতোমধ্যে বাজেট সংশোধনের ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আল মুহিত। অর্থ বছরের প্রথম মাস হিসেবে জুলাই মাসে যেখানে নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করার কথা সেখানে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ কাটছাটের কথা ভাবতে শুরু করেছে অর্থ বিভাগ। ফলে ভুল নীতি প্রণয়ন আর প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে অর্থ বছরের শুরুতেই বাধার মুখে পড়েছে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের কার্যক্রম। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চলতি বছরের বাজেট সংস্কার করা হবে। ভ্যাট আইন ২০১৭ দু’বছরের জন্য স্থগিত করার ফলে বিশাল আকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। যার প্রভাব পড়বে উন্নয়ন কর্মকা-ে। এ জন্য বাজেট বাস্তবায়ন করা খুব একটা সহজ হবে না। ফলে নতুন বাজেটে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলির বরাদ্দ হেরফের করার কথা ভাবা হচ্ছে। এমনকী অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) তালিকা থেকে বাদ দেবার কথা ভাবা হচ্ছেÑ বাদ দেয়া হতেও পারে।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়য়ের অর্থ বিভাগের একটি সূত্র মতে জানা যায়, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে জনভোগান্তি বেড়ে যেতে পারে। এমন ভুল নীতি বাজেট পাশের আগেই বুঝতে পারায় সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। কিন্তু ওই বিতর্কিত আইনটি স্থগিতের সিদ্ধান্তই এখন বাজেট বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে অর্থ বছরের শুরুতেই বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে মহাচিন্তিত অর্থমন্ত্রী একারণে আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলন নতুন করে ঠিক করতে পরিকল্পনার কথা ভাবতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ববোর্ড (ডইজ) এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাথে আলোচনাও করেছেন। এজন্য সংশোধিত বাজেটের (জবারংবফ ইঁফমবঃ) বিষয়ে জাতীয় সংসদে বিশাল পরিকল্পনা তুলে ধরার চিন্তা-ভাবনার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে ভ্যাট আইন স্থগিতের ফলে বাজেট বাস্তবায়ন যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে এটা স্পষ্ট।
আমাদের জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ আদায় হয়ে থাকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বা ওজউ বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে। কিন্তু নানাবিধ অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অদক্ষতার কারণেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয় না। আর এর পেছনে রয়েছে রাজস্ব বোর্ডের অসততা ও দুর্নীতি। এই একটি সরকারি দপ্তর তথা এনবিআর যদি সততার শতকরা ৬০ ভাগ নিশ্চিত করতে পারে তাহলে ভ্যাট আইন এর প্রয়োজন নেই। প্রকৃত পক্ষে ঠঅঞ শব্দের অর্থ ঠধষঁব ধফফবফ ঞধী বা মূল্য সংযোজন কর। অর্থাৎ কর আদায়ে এনবিআর এর প্রশাসনযন্ত্র যদি  সততার নিদির্শন স্থাপন করতে পারে তা হলে বাজেটে কোন ঘাটতি হবে না এটা নিশ্চিত। বিশেষ করে অংক কষে তা দেখানো যাবে। তবে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা আর কর বিভাগের সততা। যেখানে সর্ষেয় ভূত সেখানে কী সেটা করা সম্ভব সেটাই ভাবনার বিষয়। এ বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাবনা উল্লেখ করে বছর খানেক পূর্বে বাজেট এনবিআরে-এর চেয়ারম্যানের সাথে আলোচনা করে একটা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলাম। তিনি আমার সাথে একমত পোষণ করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সেই লিখিত প্রস্তাবনাটি আদৌ তাঁর কাছে পৌঁছেছিল কিনা সেটা অদ্যবধি জানা যায়নি। তবে আমার মতে প্রস্তাবনাটি বাস্তবায়ন খুবই সম্ভব।
এনবিআর এর চেয়ারম্যান এবং অভ্যন্তরীণ বিভাগের সচিব মহোদয়কে দেয়া আমার প্রস্তাবনাটি উপস্থাপনের পূর্বে আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি গল্প করা প্রয়োজন। আমেরিকা প্রবাসী জনৈক কৃষি বিজ্ঞানী সম্প্রতি রাজশাহী এসেছিলেন। তিনি নগরীর উপশহরস্থ পৈত্রিক জমিতে একটা বহুতল বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করে তা বিক্রির ব্যবস্থা করবেন। তাঁর কাছে জানতে পারলাম ওই প্রস্তাবিত ভবনের একটি ফ্লাট নগরীর সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক ক্রয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ওই শিক্ষক ইতোমধ্যে উপশহর এলাকায় আরো দু’টি ফ্লাট ক্রয় করেছেন। তবে নিজের নামে কিনেছেন কিনা জানি না। অবশ্য সেটা জানার সুযোগ নেই। প্রশ্ন হলো একটি সরকারি কলেজে চাকরি করে কীভাবে দুটি ফ্লাট ক্রয় করেছেন? তিনি কি ফ্লাট ক্রয়ের পূর্বে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধি ১৯৭৯ অনুযায়ী সরকারের অনুমতি গ্রহণ করেছিলেন। বেতনের অতিরিক্ত বাড়তি আয় দিয়েই তিনি দুটি ফ্লাট কিনেছেন এবং আরো একটি ফ্লাট ক্রয়ের কথা ভাবছেন। তিনি যে, সরকারি চাকরির বাইরে ‘প্রাইভেট’ পড়িয়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করেছেন তা নিশ্চিত। কিন্তু এক্ষেত্রেও তিনি যে কথিত আচরণ বিধি ‘১৯৭৯ ভঙ্গ করেছেন সেটাও স্পষ্ট। উক্ত আচরণ বিধিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে কোন সরকারি কর্মচারী চাকরির বাইরে কোনো ব্যবসার সাথে তিনি বা তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যা জড়িত হতে পারবেন না। কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট পড়ানো ব্যবসা হিসেবেই পরিগণিত হবে। ফলে সরকারি কলেজের ওই অধ্যাপক সাহেব কেবলমাত্র সরকারের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে সম্পদ আহরণ করেছেন তা নয়, বেতনের বাইরে যে বিশাল অর্থ উপার্জন (প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টার করে) করেছেন তার উপর ধার্যকৃত আয়কর প্রদান করেছিলেন কি?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে প্রস্তাবিত ধারণার একটি অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরছি। বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের অন্যতম সমস্যাই হচ্ছে নিয়মমাফিক আয়কর (ওহপড়সব ঞধী) আদায় না হওয়া। কারণ যারা আয়কর প্রদান করবেন বা করছেন আর যারা আদায় করছেন উভয়ের মধ্যে বিশাল ফাঁক ফোকর থাকায় নিয়মিতভাবে ও সঠিকভাবে আয়কর আদায় হচ্ছে না। প্রাথমিক ভাবে ৩/৪টি খাত নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রকৃতভাবে আয়কর আদায় করা যেতে পারে সে বিষয়ে ঈড়হপবঢ়ঃ বা ধারণা উল্লেখ করা হয়। এ খাতগুলি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন এবং জমি ও ফ্লাট ক্রয় বিক্রয় সংক্রান্ত। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব সেটাও বর্ণনা করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন কেবল সততা ও নিষ্ঠা।
(ক) ধারণাগত প্রস্তাবনা-০১ স্বাস্থ্য: যে সকল চিকিৎসক সরকারি চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট প্রাকটিস করছেন তাঁরা বিপুল পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন। যার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। দৈবচয়নের মাধ্যমে নগরীর বা দেশের যে কোনো অঞ্চলে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলি সরেজমিনে তদন্ত করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। যে কোনো একটি ক্লিনিক বা হাসপাতালে একজন সৎ পরিশ্রমি ও নির্লোভ কর্মচারী (এ ক্ষেত্রে যে কাউকে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে) কমপক্ষে ১ মাস ওই ক্লিনিকে অবস্থান করবে, যে কোনো বিশেষজ্ঞ-অবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে। প্রতিদিন প্রকৃত অর্থে ওই চিকিৎসক মোট কতজন রোগিকে অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা দিচ্ছে বা ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছে সেটা প্রতিদিন লিপিবদ্ধ করতে হবে। এভাবে ৩০ দিন বা ১ মাসের হিসাব নিয়ে প্রকৃত আহরিত অর্থের হিসাব করতে হবে। তাহলে এক বছরে কেবলমাত্র রোগী দেখে বা প্রাইভেট প্রাকটিস থেকে কত টাকা বাড়তি আয় হলো তার হিসাব পাওয়া যাবে। এর সাথে যোগ হবে পরামর্শ স্লিপে (চৎবংপৎরঢ়ঃরড়হ) কী কী পরীক্ষা (ঞবংঃ) দেয়া হয়েছে, ওই সকল পরীক্ষা বাবদ কি পরিমাণ কমিশন পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র ব্যবস্থাপত্র লেখা ও টেস্ট থেকে আহরিত সর্বমোট কত টাকা তিনি আয় করেছেন। উক্ত পরিমাণ আয় এর অর্থ তিনি আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন কী না এবং কত পরিমাণ আয়কর প্রদান করেছেন তার বিবরণী দেখলেই প্রকৃত আয়কর ফাঁকির বিষয়টি ধরা পড়বে। শুধু তাই নয়, নিয়ম থাকা সত্ত্বেও রোগিদের নিকট থেকে যে পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয় তার বিপরীতে কোন প্রাপ্তি রশিদ দেয়া হয় না। তবে যে ব্যক্তি বা কর্মচারীকে রোগির হিসাব রাখার দায়িত্ব দেয়া হবে তার বিষয়টি কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য ওই চিকিৎসককে উপঢৌকন বা নগদ অর্থ প্রদান করে সে বিষয়টিও নজরে আনা যেতে পারে। শুধু সরকারি চাকরিজীবী চিকিৎসক নয়, বেসরকারি প্রাকটিশনারদের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম পালন করলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে।
প্রস্তাবনা-০২: শিক্ষা খাত- যে সকল শিক্ষক সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সরকারের রাজস্ব খাত থেকে বেতন ভাতা গ্রহণ করছে তারা শিক্ষা বাণিজ্যের নামে প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং ব্যবসার সাথে কোনো না কোনো ভাবে জড়িত হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও দৈবচয়নের মাধ্যমে যে কোনো একজন শিক্ষককে বেছে নিতে হবে এবং তার বাড়ির সামনে কিংবা পরিচালিত কোচিং সেন্টারে প্রতিদিন কতজন ছাত্র প্রাইভেট পড়ছে তার একটা হিসাব লিপিবদ্ধ করতে হবে। প্রতিদিনের হিসেব থেকে মাসিক ও বার্ষিক আয় উপার্জন (এ ক্ষেত্রে এটি আয় নয় বাড়তি উপার্জন) কী পরিমাণ হচ্ছে তার হিসাব পাওয়া সহজ হবে। তিনি প্রাইভেট পড়িয়ে বা কোচিং ব্যবসা করে যে পরিমাণ অর্থ (সরকারের অনুমতি ছাড়া) আয় বা উপার্জন করছেন সেই আহরিত অর্থের বিপরীতে তিনি প্রকৃতভাবে আয়কর প্রদান করছেন কী না সেটি খতিয়ে দেখলেই প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। কেবল চাকরিজীবী নয়, চাকরির বাইরেও যারা চাকরি না করেও প্রাইভেট পড়িয়ে বা কোচিং ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন তাদেরও ‘আয়কর’ এর আওতায় আনা সম্ভব। এ ভাবে দৈবচয়নের (জধহফড়স) ভিত্তিতে একজন চিকিৎসক, একজন আইনজীবী, একজন প্রকৌশলী, একজন কৃষিবিদ একজন শিক্ষক কে সনাক্ত করে প্রকৃত অবৈধ বা অতিরিক্ত আয় করছেন এবং কী পরিমাণ আয়কর নিয়মিতভাবে ‘ফাঁকি’ দিয়ে চলেছেন তার একটা তথ্য উপাত্ত প্রণয়ন করতে পারলেই হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব।
প্রস্তাবনা-০৩: জমি রেজিস্ট্রি ও ফ্লাট ক্রয় বিক্রয়-বাংলাদেশে জমি ক্রয় বিক্রয়ের সময় প্রচুর পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দেয়া হয়। অসৎ ও অসাধু সাবরেজিস্ট্রারদের ইচ্ছেই এমন অনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই জমির প্রকৃত অর্থ উল্লেখ না করার ফলে সরকার প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যার পরিমাণ বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল সম্পাদনকালীন যে কর্মচারীটি হাতের আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে দলিলে ছাপের ব্যবস্থা করে থাকে সেই কর্মচারী জনপ্রতি ন্যূনতম ২০ টাকা আদায় করে ক্রেতা/বিক্রেতার কাছ থেকে এবং এটি খোদ সাব রেজিস্ট্রার এর চোখের সামনেই ঘটে। অবৈধভাবে কেবল আঙ্গুলের ছাপ মারার থেকে আহরিত অর্থের পরিমাণও কম নয়। সে ক্ষেত্রে জমির প্রকৃত মূল্য অনুযায়ী জমি রেজিস্ট্রি করা হলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ (রাজস্ব) আদায় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, বরিশালে ডেভেলপার কোম্পানিরা যে সকল ফ্লাট বিক্রি করে থাকে সেক্ষেত্রে বিক্রির সময় ফ্লাটের প্রকৃত মূল্য (এমনকী কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচেরও কম) দেখানো হয় না। যে পরিমাণ অর্থ-একজন ক্রেতা প্রদান করে বিক্রেতারা বা দলিলে সেটা উল্লেখ না করে অনেক কম মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এতে করে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারীগণ ফ্লাটের ক্রেতা ও বিক্রেতা অসাধু পন্থায় দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত করছে। এ ক্ষেত্রেও দৈবচয়নের মাধ্যমে যে কোনো একটি ফ্লাট বাড়ির হিসাব নিকাশ করলে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে। বিশেষত রাজধানী ঢাকা শহরে যে সকল ফ্লাট/বাড়ি বিক্রি হয়েছে বা হচ্ছে তার সিংহভাগ ফ্লাটের মালিক সরকারি কর্মচারী নিজে অর্থাৎ অবৈধ অর্থে উক্ত ফ্লাট কিনলেও তিনি কখনো নিজের নামে না কিনে সেটি স্ত্রী বা অন্য নিকটাত্মীয়র নামে কিনে থাকেন। এ ক্ষেত্রে উক্ত ফ্লাটের ক্রেতার অর্থের উৎস খোঁজ করলেই প্রকৃত তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাবে। যিনি বা যার নামে উক্ত ফ্লাট ক্রয় করা হয়েছে তিনি প্রকৃত অর্থে বছরে কত টাকা আয়কর দিচ্ছেন বা দিয়েছেন এ বিষয়টি পর্যালোচনা করলেই আয়কর ফাঁকির প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে। অন্যদিকে ডেভলপার কোম্পানিগুলি প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কম মূল্যে ফ্লাট রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছেন। তিনিই বা কীভাবে চৎড়ফঁপঃরড়হ পড়ংঃ এর কমে ফ্লাট বিক্রি করছেন সে তথ্য পানির মত পরিস্কার হয়ে যাবে।
উপরোক্ত প্রস্তাবনা সমূহ পরিক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে। একজন আইনজীবী তাঁর মক্কেলের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ মামলা চালানো বাবদ গ্রহণ করে থাকেন সে বিষয়টি কখনো জানা যায় না। পরীক্ষামূলকভাবে কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বিষয়টি গোপনীয়তা রক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। তা না হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, আইনজীবীগণ সতর্ক হয়ে যাবে। বাংলাদেশের এমনই দুর্ভাগ্য যে একজন চিকিৎসক তার কর্মস্থলে বা হাসপাতালে বসে রোগিদের চিকিৎসা দিতে পারে না অথচ ক্লিনিকে বা প্রাইভেট প্রাকটিসে বসলে অর্থের বিনিময়ে (এ ক্ষেত্রে বাড়তি অর্থ আদায় করা হয়, যাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেই) রোগিদের চিকিৎসা দিচ্ছে যা অনৈতিক। অন্যদিকে সরকারি বা বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের চেয়ে বাড়িতে বা কোচিং সেন্টারে পড়াতে বেশ আগ্রহী হচ্ছে।)
যে বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনায় নেয়া হলো সে গুলো কেবলমাত্র চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে। এর বাইরেও যারা রয়েছে অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা কীভাবে আয়কর ফাঁকি দিয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে সে বিষয়েও নজর দেয়া যায়। মোট কথা ২০২১ সালে বাংলাদেশের কল্পরূপ বা ঠরংরড়হ ২০২১ বাস্তবায়ন করতে গেলে যে সব ক্ষেত্রে আয়কর ফাঁকির মহোৎসব চলছে (বর্ণনানুযায়ী) সে সকল খাত থেকে আয়কর আদায় করতে পারলে কখনোই নতুন করে ভ্যাট আইন প্রয়োগের প্রয়োজন পড়বে না বলে মনে করি।
লেখক : প্রকৌশলী