মতিহারের সেই চিরতরুণ শিক্ষক জাহিদুল হক টুকু

আপডেট: মার্চ ৭, ২০২৩, ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

আনারুল হক আনা:


জনজীবনের সংযোগ সীমিত। কেনর প্রশ্নে উত্তর আসে রকমফের। একের কথায় বলা যায়, ভালো না লাগা। তবুও যাপিত জীবনের প্রয়োজনকে অস্বীকারের সুযোগ নেই। তার সাথে পেশা ও নেশার তাগিদে তথ্যের অন্বেষণ। অন্বেষিত উপকরণ বর্ণমালায় মিশিয়ে প্রতিবেদনের শরীর নির্মাণ। শরীরগুলো এক সময় মহাকৃতি রূপে হয়ে ওঠে ইতিহাস, উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ।
এভাবে জীবনের মৌলিক প্রয়োজন আর গ্রন্থ নির্মাণের প্রক্রিয়া ভালো না লাগার দেয়ালে সুড়ঙ্গ তৈরি করে ফেলে। যে সুড়ঙ্গ দিয়েই আমার অনিবার্যের পা চলে যায় মানুষের কাছে। মানুষও সেঁধিয়ে আসে। তাঁরা কেউ চেনা, কেউ অচেনা। আসা-যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অচেনারাও চেনা হয়ে ওঠে। কেউ আবার সুড়ঙ্গের অন্ধকার থেকে বাজপড়া আলো ফেলে হৃদয় ঝাঁকিয়ে তোলে। ২০১৮ সালের কোনো এক প্রহরে আমার সেই জীবিকা অন্বেষণের সুড়ঙ্গে এক অচেনা শ্রদ্ধেয়া অতীতের সূর্যালোক নিংড়িয়ে আমাকে ধাঁধিয়ে তুলেছিল। ঘটনার সূচনায় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে একটা নম্বর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ইয়েস বাটনে চাপের সাথে সালাম দিতেই নারীকণ্ঠের উত্তর। নম্র মেজাজ ও ভারিক্কি গলায় তাঁর পরের শব্দ তরঙ্গ, আপনি কি আনারুল হক আনা?
জ্বি।
আপনি কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানরে ছাত্র ছিলেন?
জ্বি।
কোন সময়ে?
১৯৯০-১৯৯১ সেসনে ছিলাম। তবে সেসন জটের কারণে মাস্টার্সের ফল এসেছিলো ১৯৯৮ সালে।
সে সময় আপনার কোনো শিক্ষক কি মৃত্যুবরণ করেছিলেন?
প্রশ্নটা রীতিমত থমকে দেয়। মুহূর্তে দুদশকেরও বেশি সময়ের স্মৃতির আবরণ ঠেলে আমাকে নিয়ে যায় মতিহারের শহীদুল্লাহ কলা ভবনে। তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চেয়ারম্যন সহযোগী অধ্যাপক এম. সাদেকুল ইসলাম। পরবর্তীতে সহযোগী অধ্যাপক মোঃ নজরুল ইসলাম মিয়া। দুজনেই পরবর্তীতে অধ্যাপক হন। অন্যান্য শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর এ.এন. শামসুল হক, অধ্যাপক গোলাম মোর্শেদ, অধ্যাপক আবুল ফজল হক, অধ্যাপক এম. শামসুর রহমান, অধ্যাপক মতিউর রহমান, অধ্যাপক সৈয়দ কামাল মোস্তফা, অধ্যাপক মোঃ আবদুল কাসেম, অধ্যাপক মোঃ মকসুদুর রহমান, অধ্যাপক মোঃ আনসার উদ্দিন, অধ্যাপক ড. কফিল উদ্দিন আহমেদ, ড. জাহিদুল হক টুকু, অধ্যাপক ড. নাসিমা জামান, ড. এটিএম ওবায়দুল্লাহ, ড. জগলুল হায়দার, ড. তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান, ফারাহ দিবা। কর্মচারী ছিলেন শেখ মফিজুর রহমান, ইউনুস খান, মোঃ সারোয়ার হোসেন, আব্দুল মজিদ, তৌফিকুর রহমান। শেখ মফিজুর রহমান হঠাৎ মৃত্যুবরণ করলে অফিস সহকারী হিসেবে আসেন তাঁরই ছেলে শেখ ফজলুর রহমান (ফিরোজ)।
শহীদুল্লাহ কলা ভবনের গ্যালারি কক্ষে দু’সারির কাঠবেঞ্চে আমরা দেড় শতাধিক খুদে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। সামনে লেকচার স্টেঞ্জে হলুদ রঙের কাঠের টেবিল-চেয়ার। দেয়ালে ব্লাকবোর্ড। ওখানে না উঠে মেঝেয় দাঁড়িয়ে, কখনও হেঁটে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জীবন বর্ণনায় সরব শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক জাহিদুল হক টুকু। প্রকাশে স্পষ্ট। বোঝানোই আন্তরিক। তথ্যে সমৃদ্ধ। আলোচনার বিষয় রাজা রামমোহন রায়, চিত্তরঞ্জন দাস, মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একেক দিন একেক দিকপালের জীবন ও কৃতিত্ব সম্পর্কে সরস গল্পের মতো উপস্থাপন। তাঁর বাচন ভঙ্গিমায় আমরা তন্ময়। এভাবে ক্লাস শেষে অনার্স ফাইনালের পরীক্ষাও আসে। তারপর হঠাৎ তিনি পরকালে চলে গেলেন।
এতকাল পর সেই স্মৃতিকে আমি কথায় এনে বলে ফেলি, জ্বি। জাহিদুল হক টুকু স্যার।
এবার নারীকণ্ঠ থেকে পরিচয় আসে, আমি তাঁর ওয়াইফ। নাম শাহারা হক।
টুকু স্যারের ওয়াইফ! বিস্ময় আমাকে থমকে দেয়। অচেনা মানুষ মুহূর্তেই খুব চেনা হয়ে ওঠে। মনের গভীরে শ্রদ্ধার বাষ্প জমে যায়। আমি নীরবই থাকি। শ্রদ্ধেয় শাহারা হক বলে যান, আমাকে আবিস্কারের তথ্য। আমিও অল্প কথায় স্যারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের সংযোগের বর্ণনা দিই। অনুভবে আবেগ ভর হয়ে সেদিনই আরো কিছু কথা হয়। পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকেই স্যার সম্পর্কে আরো জানার সুযোগ হয়।
তবে একাডেমিক চত্বরে সরাসরি টুকু স্যারের সঙ্গে আমাদের সেসনের কানেকসনটা দীর্ঘতার সুযোগ হয়নি। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে তিনি আমাদের কোনো পাঠ দেননি। তৃতীয় বর্ষে এসে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কোর্স নিতে শুরু করেন। স্মৃতির জানালা দিয়ে আজো অনুরণিত হয় তাঁর মুখনিসৃত শব্দমালা। যখন যা পড়াতেন তখন মনে হতো সবই তাঁর মানস দর্পণে। রাজা রামমোহন রায় আর তাঁর কৃতিত্ব বর্ণনায় গিয়ে ব্রাহ্ম সমাজ উপস্থাপন করেছিলেন। কেন জানি আমি ব্রাহ্মণ বর্ণ ও ব্রাহ্ম সমাজের পার্থক্য বুঝতে না পেরে মনের ভিতর গোল পাকিয়ে ফেলেছিলাম। তাই পরের ক্লাসে স্যার জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্ম কি এক?
তাতে স্যার সোজা উত্তরে না গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছিলেন, তুমি কার কাছে ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্ম সম্পর্কে জেনেছো?
প্রশ্নটা স্বাভাবিক হলেও আমি ব্রিবত হয়ে তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়েছিলাম, স্যার মনে নেই।
তবে স্যার বুঝে ফেলেছিলেন, উত্তরটা সঠিক নয়। তিনি আমাকে বসতে বলে স্মাইল ঠোঁটে সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ও আমার কাছ থেকেয় শুনেছে।
আমার কম্পমান মন নীরবে স্বীকার করেছিল, ঘটনা সত্য।
তারপর বুঝিয়েছিলেন, ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্ম এক নয়। ব্রাহ্মণ হিন্দু সমাজের বর্ণ। আর ব্রাহ্ম সমাজ রাজা রামোহনের নেতৃত্বে একেশ্বরবাদী ধর্ম।
স্যারের চরিত্রগত জৌলুস আমাদের কাছে বিশেষ পরিচিত এনে দিয়েছিল। সমস্ত মতিহার চত্বরেই তিনি ছিলেন পরিচিতিতে উজ্জ্বল। কখনও কখনও তাঁকে দেখা যেত স্টেডিয়াম মাঠে। এক সময় ভালো খেলোয়াড় ছিলেন কি না জানা নেই। তবে ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় দায়িত্ব পালন করতেন। সংবাদে তাঁর বিশেষণ আসতো চিরতরুণ। সে সময় তাঁর স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল কিশোর-কিশোরী। বর্তমানে তাঁরা বার্ধক্যের কোঠায়। বার্ধক্যের প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে তাঁরা সেই মতিহারে ছুটে আসে সেই সবুজের স্বাদ নিতে। সেকালের শিক্ষকদের সমবেত করে আলোচনায় মেতে ওঠে। সেই শ্রদ্ধেয় অবয়বের মাঝে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জাহিদুল হক টুকুর উপস্থিতি থাকে না। ১৯৯৬ সালের ৭ই মার্চ পরকালে চলে গেছেন তিনি। তবুও কখনও কখনও তাঁর স্নেহের শিক্ষার্থী স্নিগ্ধা, বাবর, আনোয়ার, মিলি, সোফিয়া, মামুন, সাগরেরা স্মৃতির গভীর থেকে শিক্ষকের লিবারেল ক্যারেক্টারকে অনুভবে এনে স্পর্শ কাতর হয়ে ওঠে।# e-mail:haquercc@gmail.com