মধ্যযুগে বাংলার বাণিজ্য ব্যবস্থা

আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০১৭, ১২:০১ পূর্বাহ্ণ

কাক্সিক্ষতা নিসর্গ ইসলাম


বাংলাদেশ নদীমাতৃক-পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার অঞ্চলগুলোতে যাতায়াত ব্যবস্থা প্রাচীন ও মধ্যযুগে নৌকাযোগেই প্রশস্ততর ছিল। এই নদ-নদী ও তাদের শাখা-প্রশাখা চেয়ে অসংখ্য জলপথের সৃষ্টি হয়েছিল। মধ্যযুগে প্রাপ্ত অসংখ্য লিপি ও সাহিত্য এই সকল জন¯্রােত ও জলোযানের প্রচুর উল্লেখ রয়েছে। নদ-নদীর প্রবাহই প্রাচীন ও মধ্যযুগে এবং এখনও জলপথ নির্ণয় করত। বাংলাদেশের বাণিজ্য সমৃদ্ধি চিরদিনই দেশ ও বিদেশে খ্যাত ছিল। বিভিন্ন স্থল এবং জলপথ দিয়ে তৎকালীন বাংলা তথা সমগ্র ভারতেই বাণিজ্যিক আদান-প্রদান চলত।
বংশীদাসের মনসামঙ্গল এবং মুকুন্দরামের চ-ীমঙ্গল কাব্যে বাঙালির অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের যে চিত্র পাওয়া যায় তা অতিরঞ্জিত হলেও বাঙালির সমৃদ্ধ বাণিজের স্মৃতি বহন করে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বাংলা থেকে উৎপাদিত পান-সুপারি, নারিকেল, আখ, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলাদ্রব্য। লবণ, হীরা ও মনিমুক্তার বিনিময়ে বাংলাদেশের বণিকগণ বিপুল ধন সম্পদ লাভ করতেন। ঐতিহাসিক প্লিনির উক্তি থেকে বাংলার বস্ত্রশিল্পের সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকেই ভারতবর্ষ থেকে যে পণ্য নিয়ে যেতো তার বার্ষিক মূল্য ছিল প্রায় লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা। বিদেশ থেকে নিয়ে আসা এই বিপুল অর্থের একটি অংশ ছিল বাংলাদেশের প্রাপ্য।১
গঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত গঙ্গাবন্দর, অ¤্রলিপ্ত ও কর্ণসুবর্ণের বাণিজ্য সমৃদ্ধির উল্লেখ হিউ-এন-সঙ্গ এর বিবরণীতে পাওয়া যায়। তাঁর লেখনি থেকে আরও জানা যায় যে, অ¤্রলিপ্ত বন্দরে বহু মূল্যবান দ্রব্য ও মনিরতেœর প্রচুর সমাগম হত। আর সে কারণেই তা¤্রলিপ্তের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল ঐশ্বর্যশালী ও বিত্তবান। কথাসরিৎসাগর থেকে জানা যায়, তা¤্রলিপ্ত ছিল বিত্তবান বণিকদের কেন্দ্র তাঁরা সিংহল, সুবর্ণদ্বীপ ও অন্যান্য দেশের সাথে সামদ্রিক বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন।
বাংলার সমৃদ্ধি ছিল বাণিজ্যপ্রসূত। বাণিজ্যের ফলে এই সকল শ্রেষ্ঠ ও বণিকদের হাতে প্রচুর অর্থের সমাগম হতো। সেই অর্থ দ্বারা তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে অধিপত্য লাভ করতেন। পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত ভূমি দান-বিক্রয়ের লিপিগুলোতে উল্লিখিত প্রধান পাঁচজন রাজ কর্মচারী হলেন-বিষয়পতি প্রথম কায়স্থ। নগরশ্রেষ্ঠ  শ্রেষ্ঠী গোষ্ঠীর প্রধান), প্রথম সার্থবহ (বণিকগোষ্ঠীর প্রধান) এবং প্রথম কুলীন (শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি)। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রে বণিক ও ব্যবসায়ীদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে এই বাণিজ্য সমৃদ্ধির সূচনা হয়েছিল। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই বাণিজ্য প্রবাহ অব্যাহত ছিল। কিন্তু, সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম ধর্মের উদ্ভব ও প্রসারের ফলে নবজাগ্রত আরব জাতি প্রবল উৎসাহে পূর্ব ও পশ্চিমে অভিযান আরম্ভ করে। জলপথে তারা একদিকে স্পেন থেকে ভারতের পূর্ব জলসীমান্ত পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রভূত্ব এবং বাণিজ্যিক অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ভূ-মধ্যসাগর থেকে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চল পর্যন্ত বাণিজ্য ছিল রোম ও মিসরীয় বণিকদের করতলগত। পরবর্তীতে, এই সমৃদ্ধ বাণিজ্যের অধিকারী হয় আরব বণিকগোষ্ঠী। খৃষ্টীয়-সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এই পরিবর্তন সংঘটিত হয়। আর এ সময় থেকে বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্যে উত্তর ভারতীয়দের প্রভাব খর্ব হতে আরম্ভ করে। প্রথমে পশ্চিম ভারতের বাণিজ্য বন্দরগুলো আরবদের দখলে চলে যায় এবং পূর্ব ভারতের বন্দরগুলোও আরবরা অধিকার করে নেয়। দক্ষিণের চোল-পল্লব রাজ্যগুলো ত্রয়োদশ-চতুর্থদশ শতক পর্যন্ত বাণিজ্যে তাদের প্রভাব অক্ষুণœ রাখলে ও পরবর্তীকালে তা নষ্ট হয়ে যায়। মুঘল যুগে ভারতীয় সমুদ্র বাণিজ্যের অধিকাংশই আরব ও পারস্য দেশিয় বণিকদের হস্তগত হয়।২
ভারতের এই বাণিজ্য বিপর্যয় বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করে। ফলে, সমৃদ্ধ সামুদ্রিক বাণিজ্যে বাংলার প্রতিপত্তি ও নষ্ট হয়ে গেল। সপ্তম শতকে হিউয়েন সাঙ ও ইৎসিঙ তা¤্রলিপ্তের বাণিজ্য সমৃদ্ধির কথা বরাবার উল্লেখ করলে ও অষ্টম শতাব্দীতে কোন উৎস থেকেই তা¤্রলিপ্তের অথবা কোন সমৃদ্ধ বাণিজ্য বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায় না। পলল সঞ্চিত হয়ে সরস্বতী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে গেল নদীটির গতি পথ পরিবর্তিত হল এবং সেই সাথে তা¤্রলিপ্ত বন্দর ও তার সমৃদ্ধি হারালো। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বাংলায় আর কোন সমৃদ্ধশালী বন্দরের উত্থান ঘটেনি। চতুর্দশ শতকে ভাগীরথী নদীর তীরে সপ্তগ্রাম এবং বাংলার পূর্ব উপকূলে চট্টগ্রামে বন্দরের পত্তন হলেও সামুদ্রিক বাণিজ্যের বাংলার গৌরব পুনরুদ্ধার হয়নি। যদিও অন্তর্বাণিজ্যে বাংলার প্রভাব কিছুটা হলেও অক্ষুণœ ছিল।৩
বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সপ্তম খৃষ্টাব্দ থেকেই ভারতের উপকূলে আগমন করে আরবগণ। বাংলায় বখতিয়ার খলজীর আগমণের পূর্বেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে অল্পসংখ্যক আরব বসবাস আরম্ভ করে। অনেক সময় বাংলার অভ্যন্তরে ও আরব ও তুর্কীগণ অশ্ব, বস্ত্র ও শুল্ক ফল বিক্রয়ের জন্য আগমন করত।
ব্যবসা বাণিজ্যের অভনতির সাথে সাথে বাংলায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সমাজেও বহুপরিবর্তন দেখা দিল। বাণিজ্যে অবনতির সাথে সাথে সমাজে বণিক গোষ্ঠীর প্রভাবও হ্রাস পায়। অষ্টম শতক থেকেই বাংলার সমাজও হয়ে পড়ে কৃষিনির্ভর এবং ভূমিই হয় বাঙালি জাতির প্রধান সম্পদ। ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঙালি সমাজ ছিল প্রথমত এবং প্রধানত কৃষি ও শিল্পনির্ভর। আর এই যুগে সামন্ত প্রথা ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ে।৪ সুতরাং এই যুগের সমাজ ব্যবস্থায় এক প্রান্তে দেখা যায়, সুবিশাল সম্পত্তির অধিকারী মহামান্ডলিক ও মহাসামন্ত এবং অন্য প্রান্তে ভূমিহীন অসংখ্য প্রজা। এরই মধ্যভাগে দেখা যায়, ভূ-সম্পত্তির স্তর অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণি। এভাবে, শিল্প ও কৃষির সমন্বয়ে বাংলা স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠে এবং সাথে সাথে সৃষ্টি হয় একটি রাজকর্মচারী শ্রেণির। এই শ্রেণির মধ্যে বিভিন্ন স্তর দৃষ্ট হয়। এর মধ্যে রয়েছে মহাসেনাপতি, মহধর্মাধ্যক্ষ প্রভৃতি উর্ধ্বতন গোষ্ঠী এবং সাধারণ রাজকর্মচারী। এখানে রাজঅনুগ্রহ প্রাপ্ত একটি শ্রেণিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শ্রেণিতে ছিল ভূমিসম্পদ নির্ভর স্তর এবং বিদ্যাবুদ্ধি সম্পন্ন জ্ঞানজীবী ও ধর্মজীবী। ধর্মজীবী শ্রেণির এক দিকে ছিল ব্রাহ্ম প-িত এবং অন্যদিকে ছিল রাজপন্ডিত বা পুরোহিত যারা অধ্যাপনার সাথে জড়িত ভূ-সম্পত্তির অধিকারী। ভূমিহীন শ্রমিকগোষ্ঠীও সংখ্যায় নগন্য ছিল না। তারা অধিকাংশ ছিল অন্ত্যজ বা, অস্পৃশ্য। পালযুগের উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা অবহেলিত হয়নি। কিন্তু সেনযুগে বাংলার সমাজে প্রবল ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের ফলে সমাজে তারা ছিল অবহেলিত ও নিপীড়িত ব্রাহ্ম পৃষ্ঠপোষক সেনযুগে বৌদ্ধগণ বাংলার সমাজে প্রতিপত্তিহীন হয়ে পড়ে এবং তারাও হয়ে যায় অস্পৃশ্য। বাংলার এই নিপীড়িত শ্রেণিগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে মুসলিম বিজয়ের সাথে সাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। বৌদ্ধ বিদ্বেষ ও শ্রেণিবৈষম্য বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের অন্যতম কারণ। ভূমি অধিকারী সামন্ত শ্রেণিকে বিক্ষুদ্ধ বৌদ্ধ জনতা সানন্দে গ্রহণ করতে পারেনি। সুতরাং, তারা মুসলিম আক্রমণকারীদের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ সমর্থন বা সহায়তা করবে, না হলেও সক্রিয় প্রতিরোধ করবে না, তাতে বিস্মিত হবার কোন কারণ নেই।
লেখক:  এম ফিল গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।