মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
রাবি প্রতিবেদক:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে আবারও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। রামদা, রড ও দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে এক পক্ষ। সোমবার (১৩ মে) দিবাগত মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী ও মাদার বখস হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
এই অবস্থার নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ না দেখায় প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া কাম্য নয়। এতে শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। অবিলম্বে এই বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছেন, এখানে রাজনৈতিক বিষয় আছে। এটা রাজনৈতিক ব্যক্তি বা, লোকাল মুরব্বিদের মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে দেশীয় অস্ত্র অন্যরা দেখলেও, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে যাওয়ার সময় এমন কিছু দেখে নাই। তবে পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সোমবার (১৩ মে) রাত দেড়টার দিকে ২০-২৫ জন নেতাকর্মী নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে প্রবেশ করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের য্গ্নু সাধারণ সম্পাদক নিয়াজ মোর্শেদ। তিনি ওই হলের বর্তমান সভাপতির দায়িত্বেও আছেন। নিয়াজ হলে প্রবেশের কিছুক্ষণ পরে ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান হল থেকে বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের বলেন, নিয়াজ তার হাত-পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেয়।
এরপর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে বিভিন্ন হল হতে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ-সম্পাদকের অনুসারী ২ শতাধিকের বেশি নেতাকর্মী মাদার বখস হলের সামনে জড়ো হয়। এসময় অধিকাংশের হাতে রামদা, রড, লাঠি, ব্যাট, স্ট্যাম্পসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ছিলো। তারা মাদার হলের সামনের লাইটও বন্ধ করে দেন। মতিহার থানা পুলিশের উর্ধ্বতনরা ঘটনাস্থলে আসেন এবং অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করেন।
রাত দুইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে আসেন প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা ও জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক। তারা পুলিশ, শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু কোনো সমাধান না হওয়ায় রাত চারটার দিকে বহিরাগতদের শনাক্ত করতে পুলিশ ও হল প্রশাসনসহ হলে অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয় হল কর্তৃপক্ষকে। প্রায় দুই ঘন্টার অভিযান শেষে রাত সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তারা। এসময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও ঘটনাস্থল থেকে চলে যান।
আতিকুর রহমানকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন। তারা পরবর্তী সম্ভাব্য পদপ্রার্থীদের বিতাড়িত করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান। এজন্য তারা হলের চলমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের পরিবর্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার পদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিকভাবে অন্যদের হেয় করছেন। আমাদের নেতাকর্মীদের ডেকে ডেকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে অভিযোগ তুললে উল্টো বিভিন্ন ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। পরিকল্পিত না হলে এমন হতো না।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, কাউকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করা হচ্ছে না। বরং তিনিই (নিয়াজ) দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছেন।
অস্ত্রের মহড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বহিরাগত নিয়ে হলে কোনো বিশৃঙ্খলা যাতে না করতে পারে, সেজন্য আমরা অবস্থান নিয়েছি। সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে অবহিত করা হয়েছে। তাদের নির্দেশনা অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে পদার্থ বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র মোটেও কাম্য নয়। তাছাড়া দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনকে যেভাবে দেখা হয়, অন্যদের সেভাবে দেখা হয় না। ফলে সরকার সমর্থিতরা প্রকাশ্যে লাঠিসোঁটা নিয়ে বিশৃঙ্খলা করলেও ছাড় পেয়ে যায়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷ ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তায় অবিলম্বে প্রশাসনের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
হল প্রাধ্যক্ষ ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশসহ হলকক্ষগুলোতে অভিযান চালিয়ে অনাবাসিক ২০ শিক্ষার্থীকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে বিকেলে (মঙ্গলবার) হল প্রশাসনের সভা হবে। এতে তদন্ত কমিটি গঠন সহ অন্যান্য সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সাউদ বলেন, এরকম পরিস্থিতি হলে শিক্ষার্থীরা বিরক্ত হয়। আমরা চেষ্টা করছি সমাধানের। এটা একটা সংগঠনেরই দুই পক্ষের ব্যাপার। হয়তোবা কয়েকদিন সময় লাগবে।
অভিযান শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, বিভিন্ন সোর্স থেকে পাওয়া কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা হলে এসেছিলাম। আমরা রেইড দিয়েছি। একটা চায়নিজ কুড়ালের অংশবিশেষ পাওয়া গিয়েছে। কিছু অনাবাসিক শিক্ষার্থীর খোজঁ পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি হল কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া, তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
হলে রেইড দিলেও বাইরে থাকা অধিকাংশ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে দেশীয় অস্ত্র দেখা গিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেনো জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা হয়তো আপনাদের চোখে পড়েছে। কিন্তু আমি যখন আসি, তখন আমি এমন কিছু দেখি নাই। গত কয়েকদিন থেকে এখানে পুলিশ আছে। আজকেও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিলো। তাদেরকে আমরা বলেছি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। হয়তো ২-৪টা রামদা নিয়ে কিছু ছেলেপেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা আপনারা বা অন্য কেউ দেখলেও, আমরা আসার সময় হয়তোবা লুকিয়ে ফেলেছে।
এই অবস্থা সমাধানের উপায় কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে কিছু রাজনৈতিক বিষয় আছে। সেটা রাজনৈতিক ব্যক্তি বা, লোকাল মুরব্বিদের মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। আর ছাত্রদের নিরাপত্তার বিষয়টা অবশ্যই আমরা খেয়াল রাখবো।
এর আগে, গত ১১ মে শহিদ সোহরাওয়ার্দী হলের অতিথি কক্ষে বসাকে কেন্দ্র করে রাতভর সংঘর্ষে জড়ায় শাখা ছাত্রলীগের দু’পক্ষ। এসময় তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র দেখা যায়। এছাড়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ সহ ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে সাত ছাত্রলীগকর্মী আহত হয়। এ ঘটনায় ১৩ মে সভা ডেকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলেই ক্ষান্ত থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।