বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
ড. কানাই লাল রায়
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি (বাংলা ১২৩০ সালের ১২ই মাঘ) যশোর জেলার সদর মহকুমার কেশবপুর থানার কপোতাক্ষ নদ তীরবর্তী সাগরদাঁড়ি গ্রামে এক বনেদি দত্ত পরিবারে বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্তক কবি মধুসূদনের জন্ম হয়। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতা সদর দেওয়ানি আদালতের একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠ উকিল। মাতা জাহ্নবীদেবী ছিলেন খুলনা জেলার কাটিপাড়ার জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা। তিনি একজন ভক্তিমতী সেবাপরায়ণা ¯েœহময়ী রমণী ছিলেন। মধুসূদন মনে মনে মাকে দেবীর আসনে বসিয়েছিলেন। রাজনারায়ণ দত্তের তিন ছেলের মধ্যে মধুসূদনই বড়ো। তাঁর অন্য দুটি ছেলের শৈশবেই মৃত্যু হয়। কাজেই মধুসূদন ছিলেন পিতা-মাতা উভয়েরই অতিশয় ¯েœহের পাত্র। রাজনারায়ণ বছরের বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন ওকালতি উপলক্ষ্যে কলকাতায়। তাই বালক মধুসূদনের যা কিছু আদর-আবদার তা ছিল মায়ের কাছেই। মায়ের কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন প্রাথমিক পাঠ। তাঁর কাছে বসেই তিনি কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত, কবিকঙ্কন চ-ী, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থ পড়তে শিখেছিলেন। এসব গ্রন্থ তাঁর পরবর্তী লেখক জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল।
বালক মধুসূদন মাতা জাহ্নবী দেবী ও জন্মভূমি সাগরদাঁড়ি গ্রামÑ উভয়কেই ভালোবেসেছিলেন নিবিড়ভাবে। ক্ষীণ¯্রােতা কপোতাক্ষ এবং সাগরদাঁড়ির মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁর হৃদয়পটে এক আশ্চর্য প্রভাব সঞ্চার করেছিল। নদীতীরের বট গাছটিÑ যার সুশীতল ছায়ায় তিনি ছেলে বেলায় খেলাধুলো করতেনÑ তার স্মৃতি তাঁর বালক মনে এমনি গভীর রেখাপাত করেছিলো যে, দূর প্রবাসে জন্মভূমি থেকে বহুক্রোশ দূরে অবস্থান কালেও তা তিনি কখনই ভুলতে পারেন নি।
মধুসূদনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল বাড়িতে ও গ্রামের পাঠশালায় গুরু মশাইয়ের কাছে। একটু বড়ো হলে তাঁকে কলকাতায় এনে প্রথমে খিদিরপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে এবং পরে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজে ভর্তি করা হয়। এখানেই মধুসূদন সহপাঠীরূপে পান ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে। জুনিয়র স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজের সিনিয়র ডিপার্টমেন্টে প্রবেশ করেন। মধুসূদন যখন ২য় সিনিয়র শ্রেণীর ছাত্র, সেই সময় স্ত্রী-শিক্ষা সম্পর্কে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় ছাত্রদের মধ্যে শীর্ষ স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ভূদেব দ্বিতীয় হয়ে রৌপ্যপদক পান। মধুসূদন হিন্দু কলেজের মেধাবী ও কৃতী ছাত্র ছিলেন। হিন্দু কলেজে পড়বার সময় তিনি বহু ইংরেজি কবিতা রচনা করেন। এই সময়েই তাঁর মধ্যে কবিত্বশক্তির উন্মেষ ঘটে। এখানে পাঠকালে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ জন্মে এবং মহাকবি হবার ও বিলাত যাবার বাসনা তাঁকে ব্যাকুল করে তোলে। সতেরো বছর বয়সে লেখা একটি ইংরেজি কবিতায় তাঁর এই ব্যাকুলতার পরিচয় আছেÑ
“ও ংরময ভড়ৎ অষনরড়হ’ং ফরংঃধহঃ ংযড়ৎব,
ওঃং ারষষধমবং মৎববহ, রঃং সড়ঁহঃধরহং যরময,
ঞযড়’ ভৎরবহফং, ৎবষধঃরড়হং ও যধাব হড়হব
ওহ ঃযধঃ ভধরৎ পষরসব, ুবঃ ড়য’ ও ংরময
ঞড় পৎড়ংং ঃযব াধংঃ অঃষধহঃরপ ধিাব
ঋড়ৎ মষড়ৎু ড়ৎ ধ হধসবষবংং মৎধাব”
মধুসূদনের উচ্চাশার অন্ত ছিল না। তিনি নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও পাশ্চাত্য সাহিত্যের বহু গ্রন্থ পাঠ করেন। এমন কি, ওই বালক বয়সেই মধুসূদন ইংল্যা- থেকে প্রকাশিত ব্লাক উড্’স ম্যাগাজিন ও বেন্টলি’স মিসেল্যানিতে কবিতা পাঠাতে আরম্ভ করেন। প্রথম দিকে বায়রন ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। পরে ক্রমান্বয়ে হোমার, ওভিদ, দান্তে, টাসো, মিলটন প্রমুখ ইউরোপীয় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাধকদের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ জন্মে।
হিন্দু কলেজে পড়বার সময় দুইজন ইংরেজ অধ্যাপকের প্রভাব মধুসূদনের ওপর বিশেষভাবে পড়েছিলÑ এঁদের একজনের নাম ডিরোজিও, অন্য জনের নাম রিচার্ডসন। যদিও সে সময় ডিরোজিও হিন্দু কলেজ ত্যাগ করেছেন, তথাপি ছাত্র মহলে তিনি যে বিপ্লব-তরঙ্গের সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন তার দ্বারা মধুসূদন অত্যন্ত প্রভাবান্বিত হন। তাই প্রত্যক্ষভাবে ডিরোজিওর ছাত্র না হলেও, ডিরোজিওর শিক্ষা ছিল মধুসূদনের আদর্শ স্বরূপ। তাঁর কাছে রিচার্ডসন এতো প্রিয় ছিলেন যে তিনি তাঁর গুণগুলোর অনুকরণতো করতেনই, এমনকি তাঁর দোষগুলোও অনুকরণ করতে ভালো বাসতেন। রিচার্ডসনের শিক্ষার মূল কথাই ছিল আত্মশক্তির বিকাশ সাধন। তাই বালক-বয়সে প্রকৃতির লীলাভূমি কপোতাক্ষ নদের তীরে লালিত-পালিত হয়ে এবং রামায়ণ-মহাভারত পাঠ করে মধুসূদনের অন্তরে যে কবিত্বশক্তির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল, রিচার্ডসনের শিক্ষায়, আদর্শে ও অনুপ্রেরণায় তা স্ফূর্তি লাভ করে। বস্তুত, এই রিচার্ডসনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই মধুসূদন হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালে ইংরেজি কবিতা রচনা করতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, কালক্রমে তাঁর মনে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিক হোমার, ভাজিল, টাসো, মিলটনের সমপর্যায়ভুক্ত হবার আকাক্সক্ষা তাঁকে পেয়ে বসে এবং বিলাত যাবার আকাক্সক্ষাও তাঁকে এ সময় থেকে পাগল করে তোলে। এই আকাক্সক্ষা পূরণের উদ্দেশ্যেই মূলত তিনি ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে উনিশ বছর বয়সে হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালেই মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনের প্রবল আপত্তি ও কাতর অনুনয় সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। খ্রিস্টান হবার পর তাঁর নাম হলো মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর হিন্দু কলেজে মধুসূদনের আর স্থান হলো না। তাই তাঁকে বাধ্য হয়ে হিন্দু কলেজ ত্যাগ করে শিবপুরের বিশপ্স কলেজে ভর্তি হতে হলো। এমন কি, অচিরে বিলাত গমনেরও কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না। কিন্তু এর পরেও এবং মা-বাবার পুনঃপুন অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন নি। তা সত্ত্বেও, তাঁর ¯েœহপ্রবণ মা-বাবা মধুসূদনকে একেবারে পরিত্যাগ করতে পারেন নি। ধর্মান্তর গ্রহণের পর চার বছর ধরে বিশপ্স কলেজে অধ্যয়নের সময় মধুসূদনের যে-টাকা ব্যয় হয়েছিল, তার সবটাই বাবা বহন করেছিলেন। পরে অভিমানবশত সম্ভবত রাজনারায়ণ অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেন।
হিন্দু কলেজের ন্যায় বিশপ্স কলেজও মধুসূদনের ভবিষ্যৎ জীবন গঠন করতে অনেকটা সহায়তা করেছিল। হিন্দু কলেজে ঘটে মধুসূদনের ভাব-প্রবণতা, কবি প্রতিভা ও কবিত্ব শক্তির উন্মেষ আর বিশপ্স কলেজ তাঁর ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্র। এই কলেজে অধ্যয়নকালে অসাধারণ প্রতিভাধর মধুসূদন প্রায় বারোটি ভাষা আয়ত্ত করেন। এগুলো হলোÑ বাংলা, ইংরেজি, ফারসি সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, ল্যাটিন, গ্রিক হিব্রু, ফরাসি, জার্মানি ও ইটালিয়ানÑ যা যে-কোনো অতি প্রতিভাবান ছাত্রের পক্ষেও দুঃসাধ্য সাধন বলতে হবে। আর শুধু ভাষা শিক্ষাই নয় এসব ভাষায় রচিত বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য গ্রন্থ বিশেষত গ্রিক সাহিত্যের মধ্যেই তিনি মনের আশ্রয় খুঁজে পান। তাই হোমার মধুসূদনের সবচেয়ে প্রিয় কবি এবং ঈস্কিলাস, সোফোক্লিস, ইউরিপিদেস প্রভৃতি গ্রিক ট্রাজেডি রচয়িতাদের সঙ্গে তাঁর সহধর্মিতা লক্ষ্য করা যায়।
পিতার অর্থ সাহায্য বন্ধ হলে মধুসূদন ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ২৪ বছর বয়সে দক্ষিণ ভারতের কয়েকজন ছাত্র বন্ধুর সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে যান। স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাহায্যে তিনি প্রথমে মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান স্কুল ও পরে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাইস্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। মাদ্রাজে অবস্থানকালে সেখানকার বিবিধ ইংরেজি পত্রিকায় প্রবন্ধাদি লিখে কিছু অর্থোপার্জন করেন, সঙ্গে সঙ্গে কিছু খ্যাতিও লাভ হয়। এ সময় তিনি বহু ইংরেজি কবিতা লিখেছেন। ‘টিমোথি পেন পোয়েম (ঞবসড়ঃযু চবহঢ়ড়বস)’ ছদ্ম নামে তাঁর অনেক কবিতা মাদ্রাজ সার্কুলার, মাদ্রাজ স্পেকটেটর ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি কিছুদিন মাদ্রাজে ঊংঃবৎহ এঁধৎফরধহ, গধফৎধং ঈরৎপঁষধঃড়ৎ ধহফ এবহবৎধষ ঈযৎড়হরপষব ও ঐরহফঁ ঈযৎড়হরপষব পত্রিকায় সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি মাদ্রাজ স্পেকটেটর পত্রিকারও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৫২ সালে তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইস্কুল বিভাগে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মাদ্রাজে আসার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৪৯ সালে মধুসূদনের ‘ক্যাপটিভ লেডি’ প্রকাশিত হয়। ওই কাব্যের সঙ্গে সঙ্গে ‘দি ভিশনস্ অব দি পাষ্ট’ নামক একটা অসম্পূর্ণ কবিতাও প্রকাশিত হয়। ‘রিজিয়া’ নামে একটা নাট্য কবিতাও এ সময় তিনি রচনা করেন। মধুসূদন একখ- ‘ক্যাপটিভ লেডি’ ‘কাউন্সিল অব এডুকেশনের সভাপতি ড্রিংক ওয়াটার বিটনকে উপহার দিয়েছিলেন। বিটন মধুসূদনের প্রতিভার প্রশংসা করেন, কিন্তু উপদেশ দেন যে মধুসূদন যদি কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে চান, তবে তাঁর কর্তব্য হবে মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার চর্চা করা। গৌরমোহন, ভূদেব প্রমুখ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবও তাঁকে বাংলা ভাষায় কাব্যগ্রন্থাদি রচনা করতে উপদেশ দিয়েছিলেন।
মাদ্রাজে থাকাকালীন কবি রেবেকা ম্যাকটাভিস নামে একজন খ্রিস্টান স্কচ নারীকে বিবাহ করেন। কিন্তু তাঁর এই বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। সাত বছর পর রেবেকার সঙ্গে কবির বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরে তিনি ১৮৫৬ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অধ্যাপকের কন্যা এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া নামে একজন ফরাসি নারীকে বিবাহ করেন। ইনিই সাধারণের কাছে কবি-পতœী রূপে পরিচিতা। এই মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখে-দুঃখে সমানভাবে কবির পাশে থেকে জীবন কাটিয়েছেন।
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন কলকাতায় আসেন বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। অর্থাভাবে তিনি পতœীকে মাদ্রাজে রেখে আসেন। পুলিশ মাজিস্ট্রেট বন্ধু কিশোরীচাঁদের অনুগ্রহে একটা মাথা গুঁজবার ঠাই এবং পুলিশ অফিসে কেরানী গিরির চাকরি জুটলো। মাইনে মাত্র চল্লিশ টাকা। দু’বছর এ চাকরি করার পর তাঁর উন্নতি ঘটে দোভাষী পদে, একশ বিশ টাকা মাইনেতে। অথচ মধুসূদনের বদ্ধমূল ধারণা ছিল এই যে, বছরে অন্তত চল্লিশ হাজার টাকার কমে কোনো ভদ্রলোকের চলতে পারে না।
সে সময় মধুসূদনকে পিতার সম্পত্তি উদ্ধার করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। তবে বন্ধুদের চেষ্টা ও যতেœ তিনি শেষ পর্যন্ত সম্পত্তি উদ্ধার করলেন বটে, কিন্তু পঁচাত্তর হাজার টাকার সম্পত্তি তাঁর বিলাস-বহুল জীবনে অতি অল্পদিন মাত্রই স্থায়ী হয়েছিল।
মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে আসার দু’বছর পর অত্যন্ত আকস্মিকভাবে মধুসূদন বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে অবতরণ করলেন। ইতঃপূর্বে বাংলা সাহিত্যের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল বটে মা এবং গ্রামের পাঠশালার গুরু মশাইয়ের চেষ্টা ও যতেœ, কিন্তু সে পরিচয় নিবিড় হবার আগেই কলকাতায় এসে হিন্দু কলেজে ভর্তি হবার পর কালক্রমে চর্চার অভাবে সে যোগসূত্রটি ছিন্ন হয়ে যায়। হিন্দু কলেজের ছাত্রাবস্থায় ও মাদ্রাজ প্রবাসের চাকরি জীবনে তিনি যে সকল কবিতা রচনা করেন, তা প্রায় সবই ইংরেজিতে। অতঃপর দীর্ঘকাল পরে কবির বয়স তখন চৌত্রিশ অর্থাৎ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার বাংলা সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ করলেন। পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়ার বাগান বাড়িতে একটি সখের নাট্যশালা ছিল। তাঁরা রামনারায়ণ তর্করতেœর ‘রত্মাবলী’ নাটক যখন অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন, তখন মধুসূদনকে রত্মাবলীর ইংরেজি অনুবাদ করতে বলা হয়। উদ্দেশ্য, অভিনয়ের দিন আহুত ইংরেজ বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করা। অনুবাদ প্রকাশিত হলো। এতদিন পর্যন্ত মধুসূদন বাংলা ভাষায় কোন গ্রন্থ প্রণয়ন করেন নি। রত্মাবলী নাটক অনুবাদ করতে গিয়ে এবং তার অভিনয় দেখে মধুসূদনের মনে নাটক লিখবার সংকল্প জাগে। ১৮৫৮ সালে ‘শর্মিষ্ঠা’ প্রকাশিত হলো। বস্তুত, রঙ্গালয়ের সম্পর্কে থেকেই মধুসূদনের বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগের সূত্রপাত। এদিক দিয়ে মহাকবি ও নাট্যকার শেক্সপিয়রের সঙ্গে তাঁর মিল আছে।
তাই বাংলা কাব্যক্ষেত্রে মধুসূদন সত্যিকার বিপ্লবী কবি। তিনি যা কিছু রচনা করেছেন তাতেই অভিনবত্ব এনেছেন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন। তখনকার বাংলা সাহিত্যে রচনার শৈলীগত এবং বিষয়ভাবনাগত যে আড়ষ্টতা ছিল, মধুসূদন তা অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতাগুণে দূরীভুত করেন। তিনিই বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ এবং সনেটের প্রবর্তন করেন। বাংলার প্রথম আধুনিক কমেডি ও ট্রাজেডির ¯্রষ্টাও তিনি। তাঁর সাহিত্যিক জীবন মাত্র তিন চার বছরের (১৮৫৯-৬২)। এই স্বল্পকালের মধ্যে তিনি যা রচনা করেছেনÑ একটি মহাকাব্য (মেঘনাদবধ), দু’টি প্রহসন (একেই কি বলে সভ্যতা এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ). তিনটি নাটক (শর্মিষ্ঠা, পদ্মবতী ও কৃষ্ণকুমারী) এবং তিনটি কাব্য (তিলোত্তমাসম্ভব, ব্রজাঙ্গনা ও বীরাঙ্গনা) তা বিস্ময়কর। তবে মেঘনাদবধ কাব্যই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। বিস্ময়ের বিষয়, তিনি একই সাথে একাধিক গ্রন্থ রচনা করতেন। রচনা করতেন বলাটা ঠিক হবে না। কেননা, তিনি বলে যেতেন এবং প-িতেরা তা টুকে নিতেন। আরও একটা কথা, যে ভাষা ও ছন্দে তিনি তাঁর গ্রন্থাদি রচনা করেছেন, তাও তাঁরই সৃষ্টি। পদ্যও যে গদ্যের মতো জোরালো ভাব প্রকাশের বাহন হতে পারে অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করে তিনি তা দেখিয়েছেন।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন মাত্র এক রাতে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করণ। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ড গমন করেন। পাঁচ বছর পর ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি ব্যবসা শুরু করেন। ইউরোপে থাকাকালে তিনি প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে যান এবং সেখানে প্রায় দু’বছর অবস্থান করেন। ইউরোপে অবস্থানকালেই তিনি চতুর্দশ পদী কবিতাবলী রচনা করেন। বাংলা ভাষায় এই শ্রেণির রচনার তিনিই পথ প্রদর্শক।
ব্যারিস্টারিতে কবি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। তিনি ১৮৭০ সালে মাসিক এক হাজার টাকায় হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে যোগদান করেন। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কিছুদিন পঞ্চকোটের মহারাজার ম্যানেজারও নিযুক্ত হন। কিন্তু অল্পকাল পরেই সেই কাজ পরিত্যাগ করেন এবং পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবার তিনি সফল হন।
ছেলেবেলা থেকেই মধুসূদন অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় সারা জীবন দু’হাতে টাকা উপার্জন করেও তাঁকে অর্থকষ্টে মনোবেদনা পেতে হয়েছে। বিশ্বস্ত বন্ধু গৌরমোহন বসাক ছিলেন তাঁর একমাত্র সহায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও তাঁকে বহুবার অর্থ সাহায্য করেছেন। ফ্রান্সে সস্ত্রীক থাকাকালে একবার তাঁকে অর্থাভাবে ভীষণ বিপদে পড়তে হয়। এ সময় ঈশ্বচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে নিজ বসতবাটি বন্ধক রেখে টাকা পাঠানোর ফলে তিনি স-সম্মানে ঋণমুক্ত ও দেশে ফিরতে পেরেছিলেন। ইউরোপ থেকে দেশে ফেরার পরে কবি ছ’বছরের মতো বেঁচে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে কবি একটি গদ্য গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেনÑ নাম হেক্টর বধ। আসলে সাহিত্য সৃষ্টির পক্ষে যে মানসিকতা, পরিবেশ ও অবসরের দরকার সারাজীবনে কবি তা খুব কমই পেয়েছেন।
মধুসূদনের শেষজীবন বড়োই দুঃখময়। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিসহ। জীবনের শেষদিকে তাঁকে কপর্দক শূন্য অবস্থায় আলিপুর দাতব্য চিকিৎসালয়ে অনাথ-আতুরের জন্য নির্দিষ্ট শয্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়। কবির মৃত্যু হয় ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে জুন রোববার বেলা ২ টায়। কবির দীর্ঘদিনের সুখ-দুঃখের সাথী মমতাময়ী স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যু এর দু’দিন আগেই হয়েছিল। মৃত্যুদিনে কবির শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন তাঁর আবাল্যের সহচর দরদী বন্ধু গৌরমোহন বসাক। তাঁরই হাতে কবি তাঁর সন্তানদের তুলে দিয়ে যান। এইভাবে ভাগ্যবিড়ম্বিত এই মহাকবি ও নাট্যকারের জীবনাবসান হয়।
লেখক: প্রফেসর (অব.), ভাষা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।