বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
মহাকাশে খোঁজ মিলল মহাজাগতিক ‘জীবাশ্মে’র। ছবি: সংগৃহীত।
সোনার দেশ ডেস্ক:
দেখতে দেখতে সবই বদলে যায় না! ভাগ্যিস যায় না। যায় না বলেই আমাদের ব্রহ্মা-ের প্রাচীন কালের অবস্থা জানার জন্য নতুন এক হাতিয়ার পেলেন বিজ্ঞানীরা। একটি ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি। যা ‘ফসিল’ বা ‘জীবাশ্ম’ হয়ে যেন টিকে আছে কয়েকশো কোটি বছর ধরে। এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল বছর আটেক আগেই। কিন্তু কোন ‘স্বর্ণখনি’ এতে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানীদের জন্য, তা জানা গেল সম্প্রতি।
২০১৮ সালে এই ছায়াপথটির হদিস পান বিজ্ঞানীরা। পৃথিবী থেকে দূরত্ব প্রায় ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ (এক বছরে আলো যতটা পথ অতিক্রম করে সেই দূরত্বকে এক আলোকবর্ষ বলে)। ছায়াপথটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কিড্স জে০৮৪২+০০৫৯’। মহাকাশ জরিপ করার সময় ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ছায়াপথটি খুঁজে পান। সেই বিশেষ জরিপ প্রকল্পটির নাম ছিল ‘কিলো ডিগ্রি সার্ভে’ (কিড্স)। সেই থেকেই ছায়াপথের নামকরণ। আবিষ্কারের পর থেকেই আমেরিকার অ্যারিজ়োনায় মহাকাশ পর্যবেক্ষণ স্টেশন ‘লার্জ বাইনোকুলার টেলিস্কোপ’ (এলবিটি) থেকে ছায়াপথটির উপর অবিরাম নজর রাখা শুরু হয়। ছবি ধরা পড়তে থাকে টেলিস্কোপে। আন্তর্জাতিক গবেষকদলের নিরীক্ষণে শেষ পর্যন্ত জানা গিয়েছে, প্রায় ৭০০ কোটি বছর ধরে একই রকম, (প্রায়) অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে ছায়াপথটি। এতেই আগ্রহ বেড়ে গিয়েছে বিজ্ঞানমহলের। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ৭০০ কোটি বছর আগে এই ব্রহ্মা-ের দশা কেমন ছিল, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে উঠতে চলেছে এই ছায়াপথ।
A new Cosmic Fossil discovered by astronomers that remains frozen in time for এই ধরনের ছায়াপথের খোঁজ পাওয়া খুবই বিরল ঘটনা। এগুলিকে বলা হয় ‘মহাজাগতিক জীবাশ্ম’ (কসমিক ফসিল)। ডায়নোসরদের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণী বা বহু হারিয়ে যাওয়া উদ্ভিদের জীবাশ্মই তাদেরকে জানার একমাত্র উপায় এখন। মহাবিশ্বের ‘জীবাশ্ম’-ও তেমনই তার সুদূর অতীতকে জানার অন্যতম বড় উপকরণ। এরা যেন ডায়নোসরের মতোই ‘ফসিল’ হয়ে ‘বেঁচে’ রয়েছে ব্রহ্মা-ে। একটি ডাইনোসরের জীবাশ্ম যদি প্রাণীজগতের বিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে, তবে এই ধরনের ছায়াপথও মহাজাগতিক বিবর্তনের প্রামাণ্য দলিল।
ছায়াপথের জন্ম হয় কী ভাবে
কোটি কোটি নক্ষত্রমন্ডল মিলে একটি ছায়াপথ। কত ছায়াপথ আছে এই ব্রহ্মা-ে? অন্তত ১০ হাজার কোটি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই সংখ্যা ২ লক্ষ কোটিও হতে পারে। ছায়াপথের আদিকাল কেমন ছিল, তা বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট নয়। প্রচলিত ধারণায় বলে, আমরা এখন যে ছায়াপথগুলিকে দেখি, সেগুলি আসলে ছোট ছোট কিছু ছায়াপথ জুড়ে তৈরি হয়েছে। প্রতিটি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রই কোনও না কোনও ছায়াপথের অঙ্গ। যেমন, আমরা থাকি আকাশগঙ্গা (মিল্কি ওয়ে) ছায়াপথে। আমাদের সূর্য এই ছায়াপথের একটি মাঝারি মাপের নক্ষত্র বা তারা মাত্র। আকাশগঙ্গার নক্ষত্রের সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার কোটি। এই সংখ্যা ৪০ হাজার কোটি হতে পারে বলেও বিজ্ঞানীদের অনুমান। বর্তমানে যত বড় বড় ছায়াপথ রয়েছে, সবগুলিই সুদূর অতীতের একাধিক ছায়াপথ মিলে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, বিবর্তিত হয়েছে।
এই ছায়াপথ কেন আলাদা
অন্য ছায়াপথগুলির বিবর্তন হলেও ‘কিড্স জে০৮৪২+০০৫৯’-এর কোনও বিবর্তন নেই। অন্তত গত ৭০০ কোটি বছর ধরে তো নেই-ই, যা একপ্রকার বিরল। এই বিরল ‘গুণে’র কারণেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘কিড্স জে০৮৪২+০০৫৯’। এই ছায়াপথ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে ‘টাইম মেশিনে’র থেকে কম কিছু নয়! ৭০০ কোটি বছর ধরে একই রকম থেকে যাওয়া ছায়াপথটির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে পারলে আদিম গূঢ় রহস্যের অনেক কিছু বিজ্ঞানীদের নাগালে চলে আসতে পারে। ‘বিগ ব্যাং’ বা ‘বিরাট বিস্ফোরণ’ তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ব্রহ্মা-ের জন্ম প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে। ‘কিড্স জে০৮৪২+০০৫৯’ ৭০০ কোটি বছর ধরে অপরিবর্তিত। অর্থাৎ স্থানকালের জন্ম থেকে এই পর্যন্ত যে সময়কাল, তার মোটামুটি মাঝামাঝি সময়ের ছবি ধরা দিচ্ছে এই ছায়াপথের থেকে।
সেই সময়ের ছায়াপথ কেমন ছিল, তার একটি ধারণাও এটির থেকে পেতে পারেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এই ছায়াপথের আকার, সেটির ভর-সহ বিভিন্ন তথ্য ইতিমধ্যে জরিপ করেছেন মহাকাশবিজ্ঞানীরা। তাতে দেখা গিয়েছে একই ভরের অন্য ছায়াপথগুলির তুলনায় এটি অনেক কম বিস্তৃত। তা ছাড়া ছায়াপথটি তৈরি হওয়ার পর থেকে এটিতে খুব বেশি নক্ষত্রও সৃষ্টি হয়নি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং এই গবেষকদলের সদস্য চিয়ারা স্পিনিয়েলোর কথায়, মহাবিশ্বের আদিকালে যে ধরনের অবিস্তৃত ছায়াপথ ছিল, এটি অনেকটা সেই রকমই।
সম্প্রতি ‘রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র সাময়িকপত্রে নতুন গবেষণাটির কথা প্রকাশিত হয়েছে। ইটালির জাতীয় জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা গবেষণা সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স’ (আইএনএএফ)-এর বিজ্ঞানী ক্রেসেনজো ডাভও রয়েছেন এই গবেষকদলে। উচ্ছ্বসিত ডাভের কথায়, “আমরা এমন একটি ছায়াপথ আবিষ্কার করেছি যা কোটি কোটি বছর ধরে ‘নিখুঁত ভাবে সংরক্ষিত’ রয়েছে। এটি সত্যিই একটি বড় প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজ। শুরুর দিকে ছায়াপথগুলি কী ভাবে তৈরি হয়েছিল এবং এখনও পর্যন্ত এই মহাবিশ্ব কী ভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে এই তথ্য।” তাঁর কথায়, “এই জীবাশ্ম ছায়াপথগুলি মহাবিশ্বের ডায়নোসরের মতো। এগুলি নিয়ে গবেষণা করে আমরা বুঝতে পারব, সেগুলি কোন পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছিল। সবচেয়ে বড় ছায়াপথগুলি কী ভাবে এই আকার পেয়েছে, সেই বিবর্তন আমরা বুঝতে পারব।”
তবে ‘কিড্স জে০৮৪২+০০৫৯’ একা নয়, এমন আরও মহাজাগতিক ‘জীবাশ্ম’ ছড়িয়ে রয়েছে মহাকাশে। যার মধ্যে একটি এনজিসি ১২৭৭। এটি তুলনামূলক ভাবে পৃথিবীর অনেক কাছে। পৃথিবী থেকে এটির দূরত্ব ২৪ কোটি আলোকবর্ষ। বহু বছর ধরে অপরিবর্তিত থাকাই এই ‘জীবাশ্ম’গুলির বিশেষত্ব। এই ছায়াপথগুলির ‘টাইম মেশিনে’ বিজ্ঞানীরা উঁকি দিতে পারেন কয়েকশো কোটি বছর আগের ব্রহ্মান্ডে। মহাবিশ্বে সৃষ্টিরহস্যের সন্ধানে।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন