বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
মহাকাশে অভিযান হোক বা গবেষণা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভেসে কাটাতে হয় শূন্যে। পৃথিবীর বাইরে গিয়ে মহাশূন্যের অনন্ত রহস্যের খোঁজ করেন নভোচরেরা। নিজেদের জীবনে ঝুঁকি নিয়ে মহাকাশের অনাবিষ্কৃত দিকগুলি খুঁজে বার করতে নিরন্তর গবেষণা চালান গবেষক ও মহাকাশচারীরা। এই পেশায় প্রতিটি পদক্ষেপেই বিপদকে সঙ্গী করতে হয় তাঁদের। মহাকাশ গবেষণায় নতুন নতুন রহস্য খুঁজতে পৃথিবীর বাইরে পা রাখেন তাঁরা।
অন্য মহাকাশচারীদের মতো সুনীতা উইলিয়ামসও মহাকাশের নানা রহস্যের কিনারা করতে পাড়ি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রে। মাত্র আট দিনের জন্য সেই অভিযান নির্ধারিত হলেও পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে কার্যত আটকে রয়েছেন সুনীতা ও তাঁর সহকর্মী বুচ উইলমোর।
সাম্প্রতিক বিবৃতি অনুসারে, নাসা জানিয়েছে, মার্চ মাসে স্পেসএক্স মিশনে এই জুটির দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তত দিনে তাঁদের মহাকাশবাসের প্রায় ১০ মাস সম্পূর্ণ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। ১২ মার্চ পৃথিবী থেকে মহাকাশযান পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছে নাসা। মার্চের শেষের দিকে তাঁদের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর দক্ষ নৌসেনা থেকে সরাসরি নাসার মহাকাশচারীর পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত সুনীতা। ধীরে ধীরে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার অভিজ্ঞ নভোচারী হয়ে ওঠেন তিনি। মহাকাশ অভিযানে একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ মিশনে অংশ নিয়েছেন সুনীতা। অন্যান্য পেশার তুলনায় এই পেশায় প্রাণের ঝুঁকি যথেষ্ট বেশি।
মহাকাশচারীর পেশা বেছে নেওয়া কিন্তু মোটেই সহজ নয়। উচ্চশিক্ষিত না হলে, বিশেষত মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকলে এই কাজ পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। পাশাপাশি, মহাকাশচারী হতে গেলে নিতে হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ।
মহাশূন্যে নভোচর পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। এখানকার মহাকাশচারীদের বেতন কাঠামো সংস্থাটির ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে। আমেরিকার আইন অনুযায়ী, অসামরিক সরকারি কর্মীরা জেনারেল শিডিউলের (জিএস) ফেডারেল কাঠামো অনুযায়ী বেতন পান। বিজ্ঞানী, মহাকাশচারী থেকে নাসার সমস্ত কর্মীরাও আমেরিকার জেনারেল শিডিউলের আওতায় পড়েন।
সেই বেতন কাঠামো অনুযায়ী সুনীতার মতো অত্যন্ত অভিজ্ঞ নভোচারীদের বার্ষিক বেতন জিএস ১৫ বিভাগের আওতায় পড়ে। জিএসের ১২ থেকে ১৫ র্যাঙ্ক অনুযায়ী সাধারণত আমেরিকার মহাকাশচারীরা বেতন পেয়ে থাকেন। নাসার ওয়েবসাইটের সূত্র বলছে ২০২৪ সালে এই বিভাগের মহাকাশচারীরা ১ লক্ষ ৫২ হাজার ২৫৮ ডলার বেতন পেয়েছেন।
অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বছরে ১ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা বেতন ধার্য হয়েছে জিএস ১৫ আওতাভুক্ত নভোচারীর। জিএস ১৪ এর কাঠামোয় বেতন পান যাঁরা, তাঁরা বছরে ৮৩ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। জিএস ১৩ কাঠামো হলে বার্ষিক আয় ৭০ লক্ষ থেকে ৯১ লক্ষ ৪১ হাজার।
সুনীতাও সমপরিমাণ বার্ষিক বেতন পান বলে নাসা সূত্রে খবর। সেই বতনের পরিমাণ ১ কোটি ২৬ লক্ষ ৩৮ হাজার ৪৩৪ টাকা। মহাকাশ ভ্রমণ এবং প্রশিক্ষণের জন্য এই বেতন বরাদ্দ। এ ছাড়া রয়েছে হরেক রকমের সুযোগ-সুবিধা। নাসা তাঁকে স্বাস্থ্য বিমা, মিশনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, ভ্রমণ ভাতা- সহ অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।
মহাকাশ অভিযানের আগে ও পরে নভোচারীদের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য চিকিৎসা খরচ দেওয়া হয় নাসার তরফে। পুরুষ ও নারী উভয় নভোচারীদের মহাকাশ অভিযানের আগে ও পরে, নাসা তাঁদের এবং পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করে থাকে।
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর সঙ্গে তুলনা করলে নাসার সঙ্গে বেতনের আকাশ-পাতাল ফারাক। ইসরোর বিজ্ঞানীরা মাসে ৮০ হাজারের মতো বেতন পান। ইসরোর প্রধানের বেতন মাসে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। অন্য সুযোগ-সুবিধা পেলেও, আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সঙ্গে তার তুলনাই হয় না।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ইএসএ মহাকাশচারীদের বেতন কাঠামো কিন্তু একেবারেই নাসার মতো নয়। এখানকার নভোচরেরা আমেরিকার সংস্থার তুলনায় কম বেতন পান। তবে আয়করে ছাড় পান তাঁরা।
আমেরিকার নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সুনীতা নাসায় সরাসরি নিযুক্ত হন। এর পর তাঁকে মহাকাশ অভিযানের জন্য বেছে নেয় নাসা। বাহিনী থেকে আনা মহাকাশচারীরা সাধারণত অফিসার পদে নাসায় চাকরি পান। তবে নিয়োগের আগে তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতা ও কত ঘণ্টা বিমান বা কপ্টার উড়িয়েছেন তা পরীক্ষা করে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
‘মার্কা ডটকম’ নামের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, সুনীতার আনুমানিক মোট সম্পদের পরিমাণ ৫০ লক্ষ ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪৩ কোটি টাকার বেশি।
সুনীতার জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ সালে ওহায়োর ইউক্লিডে এক ভারতীয় পরিবারে। ১৯৮৩ সালে নিডহ্যাম হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এর পর তিনি ১৯৮৭ সালে আমেরিকার নৌ অ্যাকাডেমি থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৯৫ সালে ফ্লরিডা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
সুনীতা বিয়ে করেন মাইকেল জে উইলিয়ামসকে। পেশায় তিনি টেক্সাসের এক ফেডারেল পুলিশকর্তা ছিলেন। তাঁরা টেক্সাসের হিউস্টনেই থাকতেন। ঘনিষ্ঠ পরিবার এবং বন্ধুদের উপস্থিতিতে বিয়ে করেন সুনীতা এবং মাইকেল। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দাম্পত্যজীবন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর সুনীতা প্রথম বার পা রাখেন মহাকাশে। সুনীতা সেই অভিযানের এক জন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই অভিযানের সময়, তিনি চার বার মহাকাশে পদযাত্রা করে ইতিহাস তৈরি করেন। মোট ২৯ ঘন্টা ১৭ মিনিট মহাকাশযানের বাইরে সময় কাটিয়ে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী হন তিনি। পরে সেই পদযাত্রার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ ঘণ্টারও বেশি।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে ভাসমান গবেষণাগারের ‘কমান্ডার’ সুনীতা। ক্রিউ-১০ অভিযানে চার মহাকাশচারী পৌঁছলে তাঁদের মধ্যে এক জনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন তিনি। এই হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলবে সাত দিন। ১২ মার্চ ক্রিউ-১০-এর মহাকাশে পৌঁছনোর কথা। তার পর ১৯ মার্চ আবার সেই মহাকাশযানে চড়বেন সুনীতা এবং বুচ। তাঁদের নিয়ে মহাকাশযানটি পৃথিবীর উদ্দেশে রওনা দেবে।
গত বছরের জুন মাসে মাত্র আট দিনের জন্য মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন সুনীতারা। কিন্তু যে মহাকাশযানে তাঁদের পৃথিবীতে ফেরার কথা হয়েছিল, তাতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এর ফলে সুনীতারা আটকে পড়েন মহাকাশে। ক্রমে তাঁদের সফর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। বর্তমানে মহাকাশে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনেই রয়েছেন দুই নভশ্চর।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন