মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩১ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
জয়পুরহাট প্রতিনিধি:
কৃষি ব্যবস্থায় কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমে বাড়ছে। এরই অংশ হিসেবে শুরু হয়েছে মাচা পদ্ধতিতে খাসি মোটাতাজাকরণ। এতে একদিকে যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন খামরি অন্যদিকে উৎপাদনও বাড়ছে। পিকেএসএফ এর অর্থায়নে জয়পুরহাটে এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করছে উন্নয়নমূলক সংস্থা জেআরডিএম।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার খেতুপাড়া গ্রামের গৃহিণী শ্রীমতি স্বরস্বতী রানী। সংসারের অসচ্ছলতার কারণে দারিদ্রতা পিছু ছাড়ে না কখনো। বাড়িতে দু-একটি ছাগল লালন-পালন করে রোগবালাইয়ের কারণে লোকসান গুণতে হতো বেশি সময়। এ সময় জেআরডিএম থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন মাচা পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে খাসি মোটাতাজাকরণ। এতে অল্পদিনেই লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন তিনি। শুধু শ্রীমতি স্বরস্বতী রানীর দেখাদেখি জয়পুরহাট জেলায় প্রায় ২শ’ জন নারী ও কিছু সংখ্যক পুরুষ সংসারের পাশাপাশি মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালন শুরু করেছেন। মাচায় খাসি মোটা তাজাকরণ করে ভাগ্য বদলিয়েছেন তারা।
শ্রীমতি স্বরস্বতী রানী জানান, আগে খোলাস্থানে ছাগল পালন করে খুব অসুবিধা হতো। এতে বেশি ছাগল পালন করাও সম্ভব ছিল না কিন্তু জেআরডিএম এর সহযোগিতায় ছাগল পালনের জন্য মাচা বা ঘর পেয়ে খুব উপকার হয়েছে। এর ফলে মাচা পদ্ধতিতে বেশি পরিমানে ছাগল পালন করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্ভী হচ্ছেন। আগে নিজের হাত খরচ বা সংসারে টুকিটাকি প্রয়োজনে স্বামীর টাকার অপেক্ষায় থাকতো হতো। সংসারের অস্বচ্ছলতার কারণে বেশির ভাগ সময় সেই ইচ্ছা পূরণ হতো না। এখন জেআরডিএম এর সার্বিক সহযোগিতা পেয়ে মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালন করে লাভের মুখ দেখছেন। এখন আর কারও টাকার অপেক্ষায় থাকতে হয় না। চাহিদামত নিজের ও সংসারের খরচ করতে পেরে খুশি তিনি।
সদর উপজেলার নারায়ণ পাড়া গ্রামের কারিমুল ইসলাম জানান, আগে সনাতন পদ্ধতিতে বাড়িতে ছাগল পালন করতাম। এ সময় জেআরডিএম থেকে এসে আমাকে মাচা পদ্ধতিতে খাসি মোটাতাজাকরণের জন্য পরামর্শ দেন, তাদের কথা আমার বিশ্বাস হয়নি। তারাও আমার পিছু ছাড়ে না। নানাভাবে পরামর্শ দিতে থাকেন এক সময় তাদের কথামত জেআরডিএম থেকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও যাবতীয় উপকরণ পেয়ে মাচা পদ্ধতিতে খাসি মোটাতাজাকরণ শুরু করি। তারপর তাদের পরামর্শ মোতাবেক বাণিজ্যিকভাবে খাসি মোটাতাজাকরণের যাত্রা শুরু। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। ফলে খাসির শীতকালে ঠান্ডা কম লাগে। এতে ছাগলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায় বলে এখন লাভের মুখ দেখছেন।
জেআরডিএম এর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল জানান, পিকেএসএফ এর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় জেআরডিএমের বাস্তবায়নে অসহায় ও দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করছে। খাসি মোটাতাজাকরণের বিশেষ দিকগুলো হচ্ছে- উপযুক্ত বাসস্থান, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা। যেমন- নিউমোনিয়া, একথাইমা, পিপিআর, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, উকুন ইত্যাদি, অপর দিকে ছাগলের উৎপাদন কমে যায়। তাই মাচা পদ্ধতিতে খাসি মোটাতাজাকরণের সব ধরণের সহযোগিতায় কাজ করছেন তারা।
এ পদ্ধতিতে ছাগলের জন্য মাচা আকৃতির ঘর তৈরি করে দেয়া হয়। এতে ছাগলের মল-মূত্র পড়বে নিচের মাটিতে। ফলে মাচায় থাকা ছাগল রক্ষা পাবে বিভিন্ন রোগ বালাই থেকে। অন্যদিকে মাটিতে জমে থাকা মল থেকে জ্বালানি তৈরি করা যাবে। এছাড়া বিভিন্ন শাক-সবজি চাষেও এটি সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
জেআরডিএমের সিনিয়র উপ-পরিচালক শওকত আলী জানান, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গৃহপালিত প্রাণির নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে মাচা পদ্ধতিতে খাসি মোটাতাজাকরণের জন্য পিকেএসএফ এর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় জেআরডিএমের বাস্তবায়নে দিন দিন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সাংসারিক কাজে পাশাপাশি গ্রামীণ নারীরা অনেকেই ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। অল্প সময়ে মোটাতাজা করণের মাধ্যমে বাজারজাত করে বছরে প্রায় চারবার বিক্রি করা সম্ভব।
এ বিষয়ে জেআরডিএম এর নির্বাহী পরিচালক রাজিয়া সুলতানা জানান, ছাগল সাধারণত পরিষ্কার, শুষ্ক, দুর্গন্ধমুক্ত উষ্ণ, পর্যাপ্ত আলো ও বায়ু চলাচলকারী পরিবেশ বেশি পছন্দ করে। অপরিষ্কার, স্যাঁতস্যঁতে, বদ্ধ, অন্ধকার ও গন্ধময় পরিবেশে ছাগল বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। মাচা পদ্ধতিতে ছাগলকে মাটি থেকে কিছুটা উপরে বাঁশের তৈরি মাচার মেঝেতে রাখা হয়। এতে ছাগল সরাসরি মাটির সংস্পর্শে আসে না, মেঝেতেও পানি জমে না। যার কারণে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের রোগ দ্বারা ছাগল আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
দেশে দুধ, ডিম ও পোলট্রির উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে ছাগলের উৎপাদন তেমন বৃদ্ধি পায়নি। তাই জয়পুরহাটে পিকেএসএফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় জেআরডিএমের বাস্তবায়নে অসহায় ও দরিদ্র নারীদের মাচার ওপর খাসি মোটাতাজাকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ শেষে ছাগল পালনে উদ্বুদ্ধ করছেন তার প্রতিষ্ঠান।
জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দীন জানান, মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালন করলে ছাগলের সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া রোগ হবে না। কৃমি, উকুন, চর্মরোগ কম হবে। প্রস্রাব, গোবর সঙ্গে সঙ্গে নিচে পড়ে যায়। ফলে শরীর পরিষ্কার থাকে। মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালন করলে শীতকালে ঠান্ডা কম লাগে। মাচার ওপর ও নিচ দিয়ে বাতাস চলাচল করে বিধায় মাচা শুকনো থাকে, যা ছাগলের জন্য আরামদায়ক। অন্যদিকে, ছাগলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে ছাগল পালন করে বেশ লাভবান হওয়া যায়। তাই এসব উদ্যেক্তা তৈরিতে প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও বেসরকারি সংস্থা জেআরডিএম কাজ করে যাচ্ছে।