রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৯ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান
মাদক নির্ভরশীলতা হলো একটি ক্রমবর্ধমান, দীর্ঘস্থায়ী এবং মারাত্মক অবস্থা। মাদক নির্ভরশীলতা সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। ‘আচরণগত সমস্যা’ ও ‘ব্যাধি’ ইত্যাদি বিভিন্ন ডিসকোর্সের মধ্য দিয়ে মাদক নির্ভরশীলতাকে চিহিত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাদক নির্ভরশীলতাকে একটি মারাত্মক রোগ হিসেবে চিহিত করেছে। মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিরা হঠাৎ নেশা ছেড়ে দিতে পারেন না। তখন হয়তো শরীরে ভারসাম্য হারাতে পারে কিংবা মাদক গ্রহণকারী আরো অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। তাই এই কাজ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনাই বিজ্ঞানসম্মত।
মাদকনির্ভরশীলদের চিকিৎসায় ‘‘ডিটক্স’’ হলো প্রথম পদক্ষেপ। চিকিৎসা চলাকালীন মাদক না নেয়ার ফলে শরীরে প্রত্যাহার উপসর্গগুলো দেখা দেয় তা মোকাবেলার সঙ্গে সঙ্গে শরীরকে মাদকমুক্ত করার প্রক্রিয়াকে ডিটক্সিফিকেশন বলা হয়। পরবর্তী ফলোআপের মাধ্যমে এই চিকিৎসা সম্পন্ন করা হয়। সেলফ ডিটক্সিফিকেশন, মেডিকেল ডিটক্সিফিকেশন ও এলাকাভিত্তিক ডিটক্সিফিকেশন এই তিন ধরনের ডিটক্সিফিকেশনের সাথেই আমরা বেশি পরিচিত।
মাদক থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের সুস্থতার চ্যালেঞ্জ সমূহ
ডিটক্সিফিকেশন সেন্টার বা মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোর সামাজিক পরিচিতি অপেক্ষাকৃতভাবে কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকা-, ডিএনসি, বিভিন্ন এনজিও এর প্রজেক্ট এবং বিভিন্ন সংবাদপত্র ও মিডিয়ার মাধ্যমে এইচআইভি এইডস ও মাদকনির্ভরশীলতা সর্ম্পকে মানুষ সচেতন হলেও মাদক নিরাময় প্রক্রিয়া ও কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে খুব কমই সচেতন মানুষ।
মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তি আমাদের সমাজে লুকায়িত জনগোষ্ঠির একটি অংশ। আর তাই অস্বীকার করার প্রবণতা তাদের মাঝে অনেক বেশি। তদুপরি সামাজিক ও ব্যক্তিগত মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার আশংকা, সামাজিক বঞ্চনার সম্ভাবনা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিতে রূপান্তরের ভয়ে মাদকনির্ভরশীল ব্যাক্তির চিকিৎসা গ্রহণের মানসিকতা কম থাকে। এক্ষেত্রে পরিবারের বা অভিভাবকের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকার কারণে অসুস্থতার চূড়ান্ত পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। অথচ মাদক নির্ভরশীলতার প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকত।
ফিরে আসা কি সবসময় আনন্দের?
ইদানিং মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন বোনাস ও বন্ধ সিমে ফিরে আসার সুবিধার কথা জানতে পারলেও মাদক থেকে ফিরে আসা ব্যক্তির অভিজ্ঞতা সবসময় আনন্দের নয়। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় এ অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যময়।
‘‘পলাশ (ছদ্মনাম), ২৩ বছর বয়স, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মহিষালবাড়ী এলাকার একজন মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তি। মাদকনির্ভরশীলতার কথা গোপন রেখে সে একটি হোটেলে কর্মরত ছিল। এমনকি কেউ কেউ বিষয়টি জানলেও তার সেখানে কাজ করতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ডিটক্স সেন্টার থেকে ফেরত আসার পর তার চাকরি আর ফেরত পায়নি। মালিকের মতে “এগুলো (মাদকসেবি) আবার ভাল হয় নাকি? ওর রাস্তা ও খুঁজে নিক এখানে ওর কাজ হবে না।”
“জহুরুল(ছদ্মনাম) ৪৫ বছর বয়স, একজন শিক্ষক। মাদকনির্ভরশীলতার কথা তার পরিবারে ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা জানার পর তাকে ডিটক্সিফিকেশন সেন্টারে নিয়ে আসে এবং সে চিকিৎসা চালিয়ে যায়। পরবতী পুনঃপতন (জবষধঢ়ংব) এর সময়ও তাকে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। সেই পরিবার ও বন্ধুরা তাকে সহযোগিতা করে।”
তত্ত্ব ও বাস্তবতার ফারাক
সাধারণভাবে মনে হয় মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির চিকিৎসা নেয়া বা ডিটক্সিফিকেশন তার জন্য একটি লিমিনাল (খরসরহধষ) পর্যায়, যেখানে তার পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে মাদকমুক্ত জীবন আর পূর্ববর্তী পর্যায় মাদকনির্ভরশীলতা। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এমনটি নাও ঘটতে পারে। কারণ যেকোন মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির পুনঃপতন (জবষধঢ়ংব) হার অনেক বেশি। বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সামাজিক, পারিবারিক ও পারিপার্শি¦ক ফ্যাক্টর তাকে সুস্থ হতে বাধা দেয়। পুনঃপতন (জবষধঢ়ংব) মাদক চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিশ্বজুড়ে এটি দেখা যায়। এমনকি ইনহাউজ চিকিৎসা সম্পন্ন করার হার সেসব দেশে বেশি সেখানেও এটি দেখা যায়। যেমন নেপালে ৩৩%, চিনে ৫৫.৮% এবং সুইজারল্যান্ডে ৬০% চিকিৎসা নেয়ার ১ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে। বাংলাদেশে এ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকলেও কাহিনী-সংক্রান্ত (অহবপফড়ঃধষ বারফবহপব) তথ্য নির্দেশ করে যে ৬০-৯০% রোগির পুনঃপতন ঘটে। (তথ্যসূত্র- ঐধৎস ৎবফঁপঃরড়হ লড়ঁৎহধষ ২০১৩)
‘প্রান্তিকীকরণ’ সুস্থতার অন্তরায়
একজন মাদকসেবিকে যেমনটি আমরা বিভিন্ন কলংক (ঝঃরমসধ) দিয়ে প্রান্তিক ও বিছিন্ন করে ফেলি তেমনটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিটক্স ফেরত ব্যক্তিকে আমরা আমাদের আচরণ, কথাবার্তা ও যোগাযোগ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে তাকে প্রান্তিক করে ফেলি। এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডিটক্স ফেরত ব্যক্তি পুনরায় মাদকে ফিরে যেতে উদ্ভুদ্ধ হয়।
ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত অভিযোজনের সম্ভাবনা হ্রাস করে
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডিটক্স ফেরত মাদকসেবিকে ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক অভিঘাতের মুখোমুখি হতে হয়। সাংস্কৃতিক অভিঘাত বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে দীর্ঘ তিন মাস ডিটক্সে একধরনের সংস্কৃতির ভিতর সে আবদ্ধ ছিল। সেই সংস্কৃতির পূর্বেও তার জীবনযাপন প্রক্রিয়া ভিন্ন ছিল। এখন সে নতুন আরেকটি প্রক্রিয়ার সাথে অভিযোজন করতে সময় লাগে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা তাকে সে সময়টা দিতে চায় না বা সময় দিতে পারে না।
মাদক থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের সুস্থতার সম্ভাবনা সমূহ
বিভিন্ন এনজিও ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো মাদক থেকে ফিরে আসা সুস্থ ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানে সহায়তা করছে। যেমন আসক্ত পুনর্বাসন সংস্থা (আপস) এ ৯১ জন কর্মীর মধ্যে ৭৯ জনই প্রাক্তন মাদকসেবি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা যেমন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ডিটক্স পরবর্তি বিভিন্ন কর্মসংস্থানমূলক ট্রেনিঙে সহায়তা করছে।
বাংলাদেশে অবস্থিত মাদক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর নেটওয়ার্ক ‘সংযোগ’ নামে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এ উপলক্ষে সম্প্রতি ঢাকা আহসানিয়া মিশন প্রধান কার্যালয়ে এক সভার আয়োজন করা হয়। সভায় ৩২ টি মাদক চিকিৎসা ও নিরাময় কেন্দ্রের প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় দুই বছরের জন্য ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। (১৩ মে ২০১৫, ভোরের কাগজ)
সর্বোপরি ডিটক্সে মাদকসেবিদের আগ্রহ, ডিটক্সপরবর্তী ফলোআপ, পারিবারিক কাউন্সিলিং ইত্যাদি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং পুনঃপতন পরবর্তী মাদক চিকিৎসা গ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়া আমাদেরকে আশান্বিত করেছে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি মাদক থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের সুস্থতার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ যেমন অনেক, সম্ভাবনাও তেমন কম নয়। আর তাই আমি, আপনি, আমাদের সকলকেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগী হতে হবে এবং সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।