সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১০ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফেন্সিডিল হচ্ছে মারাত্মক ধরনের একটি ড্রাগ যা আজ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। মূলতঃ এটি ভারতে তৈরি হয় এবং চোরাই পথে এদেশে আমদানি হয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে এর ব্যবহার আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। ইদানীং সর্বনাশা মাদকের সাথে যে নামটি যুক্ত হয়েছে তা হলো ইয়াবা। মিয়ানমার থেকে নেশাজাতীয় এ ট্যাবলেট মাদক ব্যবসায়ীরা চোরাইপথে বাংলাদেশে এনে থাকে। কখনো ভারত থেকেও আমদানি করা হয়। মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এর চালান আটক করলেও ক্রমেই এর আমদানি ও ব্যবহার বেড়েই চলেছে। মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ীরা এদেশেও এর প্রস্তুত করছে বলে মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হয়।
ইয়াবা এক ধরনের নেশাজাতীয় ট্যাবলেট। এটি মূলতঃ মেথ অ্যাস্ফিটামিন ও ক্যাফেইন এর মিশ্রণ। ইয়াবা উত্তেজক (ঝঃরসঁষধহঃ) মাদক দ্রব্য। কখনো কখনো এর সাথে হেরোইন মেশানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি খাওয়ার বড়ি হিসেবে সেবন করা হয়, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ধাতব ফয়েলে পুড়িয়ে ধোয়া হিসেবেও এটিকে সেবন করা হয়ে থাকে। এই মাদকটি থাইল্যান্ডে বেশ জনপ্রিয় এবং পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে চোরাচালান করা হয়।
তিন ধরনের ইয়াবা পাওয়া যায়। সেবনকারীদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা অনুসারে, চিতা নামের পিলটি সবচেয়ে নি¤œমানের ইয়াবা পিল হিসেবে গণ্য হয়। এর গায়ে ক্ষুদ্র চিহ্ন থাকে। অন্যদিকে গোলাপজল নামের ইয়াবা পিলকে উচ্চমানের পিল হিসেবে গণ্য করা হয়। ইয়াবা পিলের গায়ে ইংরেজি ডাব্লিউ ওয়াই (ুি) লেখা থাকে। ওয়াই (ু) লেখার ধরন দীর্ঘ হলে এবং ইয়াবার রং পুরোপুরি গোলাপি হলে ধারণা করা হয় সেটি ইয়াবা হিসেবে ভাল মানের।
প্রথমদিকে ইয়াবা যৌনউত্তেজক বড়ি হিসেবে পরিচিত ছিলো। দীর্ঘদিন ইয়াবা সেবনের ফলে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। ইয়াবা ট্যাবলেট থেকে সাময়িকভাবে উদ্দীপনা বেড়ে যায়। কিন্তু এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হেরোইনের চেয়েও ভয়াবহ। নিয়মিত ইয়াবা সেবন করলে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, নিদ্রাহীনতা, খিচুনি, ক্ষুধা মন্দা, রক্তচাপ বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন, হার্ট অ্যাটাক, ঘুমের ব্যাঘাত, কিডনি বিকল, চিরস্থায়ী যৌন অক্ষমতা, মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা যেতে পারে। ইয়াবা গ্রহণের ফলে স্মরণ শক্তি কমে যায়, ফুসফুস, বৃক্ক সমস্যা ছাড়াও অনিয়মিত এবং দ্রুতগতির হৃদসম্পনের মধ্যে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত হারে ইয়াবা গ্রহণ উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রার কারণ হতে পারে। এছাড়াও হার্টের ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিস্কের রক্তনালি ছিড়েঁও অনেকে মারা যান। বাংলাদেশে ইয়াবা আর্বিভাব ঘটে ১৯৯৭ সালে। পরবর্তীতে ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মায়ানমার থেকে ইয়াবা আসতে শুরু করে। তবে ইদানিং ভারত থেকে ইয়াবা আসছে বলে জানা যায়। এই ট্যাবলেটের দাম অত্যধিক হওয়ার কারণে উচ্চবিত্তদের মাঝেই এটি মূলত বিস্তর লাভ করে।
গবেষকদের মতে, মানুষের মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। যেমন- ১. সহজাত প্রবণতা, ২. সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, ৩. পারিবারিক অশান্তি জনিত অস্থিরতা, ৪. কালো টাকার প্রভাব, ৫. অপরিচছন্ন আয়ের পন্থা, ৬. মাদক দ্রব্যের প্রতি অযথা কৌতুহল ও অসৎ বন্ধু বান্ধব ও সঙ্গীদের কুপ্রভাব, ৭. প্রলোভন ও প্রচারণা, ৮. মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, ৯. নতুন অভিজ্ঞতা গ্রহণের চেষ্টা, ১০. নৈতিক শিক্ষার অভাব, ১১. মাদকের সহজলভ্যতা, ১২. আর্থিক অঘটন ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতাজনিত হতাশা, ১৩. কৈশর ও যৌবনের বেপরোয়া মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা, ১৪. পরিবারের মধ্যে মাদকাসক্ত সদস্যদের অবস্থান, ১৫. সহজে আনন্দ পাওয়ার বাসনা।
যখন কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তখন তার মধ্যে বেশ কিছু উপাদান দেখা যায়। যেমন- ১. আকস্মিকভাবে আচার আচরণে পরিবর্তন, ২. নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো, ৩. অপরিচিত সন্দেহজনক লোকদের সাথে চলাফেরা, ৪. হঠাৎ করে হাত খরচ বেড়ে যাওয়ায় টাকার খুবই চাহিদা, ৫. অহেতুক রেগে যাওয়া, ৬. খিট খিটে মেজাজ এবং অস্থিরতা, ৭. গভীর রাতে বাড়িফেরা, ৮. রাতে ঘুম না হওয়ার দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব, ৯. কথা জড়িয়ে যাওয়া, ১০. অসংলগ্ন কথা বলা, ১১. চোখের নিচে কালিপড়া, ১২. চোখ লাল হওয়া, ১৩. খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি, ১৪. মাঝে মাঝে বমি করা, ১৫. বাথরুমে অহেতুক সময় কাটানো, ১৬. গোসল না করা, নিয়মিত দাঁত না মাজা ও অপরিচ্ছন্ন থাকা, ১৭. ক্রমাগত মিথ্যা বলা, ১৮. সবসময়ে কিছু একটা লুকানোর ভাব করা, ১৯. মনোসংযোগের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, ২০. অতিরিক্ত আড্ডা দেয়ার প্রবণতা, ২১. শরীর আস্তে আস্তে মুটিয়ে যাওয়া, ২২. কাজে উৎসাহ না থাকা, ২৩. একাগ্রতা ও স্মরণশক্তি লোপ পাওয়া, ২৪. মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি, ২৫. নেশায় টাকা জোগাড় করার জন্য মাঝে মাঝে পরিবারের সদস্যদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা, ২৬. ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। ২৭. তার রুমে সিগারেটের তামাক, কাগজের পুরিয়া, প্লাস্টিক বোতল, খালি শিশি, দিয়াশলাই ও পোড়ানো কাঠি, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ইত্যাদি ধরনের আলামত দেখা যায়।
মাদকাসক্তের ক্ষতিকর দিকগুলো হলো- ১. উত্তেজনা বৃদ্ধি, ২. চরম অবসাদ, ৩. আত্মহত্যার প্রবণতা, ৪. অসংলগ্ন কথাবার্তা ও ব্যবহার, ৫. মানসিক তীব্র প্রতিক্রিয়া, ৬. উচ্ছৃংখল আচরণ, ৭. দুর্বলতা ও হতাশাবৃদ্ধি। আর এসব কারণে যে সকল শারীরিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয় যেগুলো হলো. ১. স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, ২. ক্ষয় রোগ, ২. ¯œায়বিক দুর্বলতা, ৪. যকৃতের তীব্র প্রদাহ, ৫. রক্ত দুষণ, জন্ডিস ও এইডসের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, ৭. নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়া, ৮. শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, ৯. ক্ষুধামন্দ, ১০. লিভার সিরোসিস, পেপটিক আলসারের ঝুঁকি বেড়ে দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়া, ১১. অনিদ্রা, ১২. পেট ব্যথা, ১৩. বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য ও মুত্র হৃাস, ১৪. যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।
মাদকাসক্তের কারণে একজন ব্যক্তি যেভাবে ক্ষতিগ্রহমশ হয় তা হলো- ১. কর্মোদ্যোগ হ্রাস পাওয়া, ২. জীবনে উন্নতির আকাক্সক্ষা হ্রাস, ৩. অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, ৪. পারিবারিক চরম অশান্তি, ৫. পরিবার ও সমাজে ঘৃণার পাত্র, অপাংক্তেয় এবং হেয় প্রতিপন্ন হওয়া, ৬. বারবার অপরাধ করে জেলে যাওয়া, ৭. ক্রমেই মৃত্যুর পথে এগিয়ে যায়।
১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ ধারা অনুসারে –
১. কারো কাছে যদি ২৫ গ্রাম হেরোইন, কোকেন এবং কোকা উদ্ভুত মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় তবে তার অন্যূন ২ বছর এবং অনুর্ধ্ব ১০ বছর কারাদ-। মাদকদ্রব্যের পরিমাণ ২৫ গ্রাম এর উর্ধ্বে হলে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ-।
২. কারো কাছে যদি ১০ গ্রাম প্যাথেডিন, মরফিন ও ট্রেট্ট্রাহাইড্রো-ক্যানাবিনল মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়, তবে অন্যূন ২ বছর এবং অনুর্ধ্ব ১০ বছর কারাদ-। মাদকদ্রব্যের পরিমাণ ১০ গ্রামের উর্ধ্বে হলে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ-।
৩. কারো কাছে যদি ২ কেজি পরিমাণ অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন বা অপিয়াম উদ্ভুত মাদক দ্রব্য পাওয়া যায়, তবে অন্যুন ২ বছর এবং অনুর্ধ্ব ১০ বছর কারাদ-। মাদকদ্রব্যের পরিমাণ ২ কেজির উর্ধে হলে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ-।
৪. কারো কাছে যদি ৫০ গ্রাম পরিমাণ মেথাডন মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। তবে অনূন্য ২ বছর এবং অনুর্ধ্ব ১০ বছর কারাদ-। মাদকদ্রব্যের পরিমাণ ৫০ গ্রামের উর্ধ্বে হলে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ-।
৫. কারো কাছে যদি ৫ কেজি পরিমাণ গাঁজা বা যে কোন ভেষজ ক্যানাবিস মাদক দ্রব্য পাওয়া যায় তবে অনূন্য ৬ মাস এবং অনুর্ধ্ব ৪ বছর কারাদ-। মাদক দ্রব্যের পরিমাণ ৫ কেজির উর্ধ্বে হলে অনূন্য ৩ বছর এবং অনুর্ধ্ব ১৫ বছর কারাদ-।
৬. যে কোন প্রজাতির ক্যানাবিস গাছের সংখ্যা অনুর্ধ ২৫ টি হলে অনূন্য ৬ মাস এবং অনুর্ধ্ব ৩ বছর কারাদ-। ক্যানাবিস গাছের সংখ্যা ২৫ টির বেশি হলে অন্যূন ৩ বছর এবং অনুর্ধ্ব ১৫ বছরের কারাদ-।
৭. কারো কাছে যদি ৫ গ্রাম পরিমাণ ফেনসাইক্লিআইন, মেথাকোয়ালন এল.এস.ডি বারবিরেটস, অ্যামফিটামিন অথবা এগুলোর যে কোনটির দ্বারা প্রস্তুত মাদক দ্রব্য পাওয়া যায়। তবে অন্যূন ৬ মাসের এবং অনুর্ধ্ব ৩ বছরের কারাদ-। মাদকদ্রব্যের পরিমাণ ৫ গ্রামের উর্ধ্বে হলে অনূন্য ৫ বছর এবং অনুর্ধ্ব ১৫ বছর কারাদ-।
মাদক নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন, ২০০৪ এর ৯(১) ধারা অনুসারে অ্যালকোহল ব্যতীত অন্য কোন মাদক দ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজতকরণ, বহন, পরিবহণ, আমদানি, রফতানি, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার করা যাবে না। অথবা এই উদ্দেশ্যে কোন প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ গ্রহণ, অর্থ বিনিয়োগ কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা বা তার পৃষ্ঠপোষকতা করা যাবে না। এই আইনের ১৬ ধারা অনুসারে যদি মহাপরিচালক বা তার নিকট থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা জানতে পারেন যে, কোন ব্যক্তি মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে প্রায়শঃ অপ্রকৃতিস্থ থাকেন এবং তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য অনতিবিলম্বে তার চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহলে মহাপরিচালক বা উক্ত কর্মকর্তা লিখিত নোটিশ দ্বারা মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে নোটিশ প্রাপ্তির ৭ (সাত) দিনের মধ্যে চিকিৎসার্থে কোন উপযুক্ত চিকিৎসকের নিকট বা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নিজেকে সমর্পণ করার জন্য নির্দেশ দিতে পারবেন। ১৭ (১) ধারা অনুসারে যদি কোন পরিবারের কোন সদস্য মাদকাসক্ত হন, তাহলে তার সম্পর্কে উক্ত পরিবারের কর্তা বা অন্য কোন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, মহাপরিচালক বা তদাধীন কোন কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। ১৭ (২) ধারা অনুসারে কোন চিকিৎসক যদি এরূপ মনে করেন যে, তার চিকিৎসাধীন কোন ব্যক্তি মাদকাসক্ত এবং তার চিকিৎসার প্রয়োজন, তাহলে তিনি মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পরামর্শ দিবেন এবং এই চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার কথা লিখিতভাবে মহাপরিচালককে অবহিত করবেন। তবে এই আইনের ১০ ধারা অনুসারে মুচি, মেথর, ডোম, চা-বাগানের কুলি ও রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা সমূহের উপজাতি গণ তাড়ি, পচুই, এবং ঐতিহ্যগতভাবে প্রস্তুতকৃত মদ লাইসেন্স ছাড়াই পান করতে পারে।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান মাদক সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে আরও বলেন, আমাদের কোন সন্তান যদি মাদকাসক্ত হয়েও যায় তবে আমরা তাকে রোগী হিসেবেই চিকিৎসা করবো, অপরাধী হিসেবে নয়। বিশ্বের অনেক জায়গায় সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা কিংবা কারারুদ্ধ করার মাধ্যমে মাদকসেবিদের বরং চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। যখন সাহায্য করার সময় তখন কি তাদের অপরাধী বানাচ্ছি? সামান্য মাদক গ্রহণের ফলে কোন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলে তার দ্বারা আরও অপরাধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। জাতিসংঘ মাদক কনভেনশনে মাদকসেবিকে রক্ষার ক্ষেত্রে ‘স্বাস্থ্য ও মানবজাতির কল্যাণ’- এর কথা বলা হয়েছে। কোন মাদকে কী ক্ষতি তাদেরও তা জানতে হবে। খুব ঝুঁকিপূর্ণ মাদকদ্রব্য যাতে নাগালের বাইরে থাকে, তা যেন কোনভাবে সহজ লভ্য না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রিক যথার্থ মাদক নীতি গ্রহণের সময় এখনই। জার্মানির মতো অন্যান্য দেশ একটি ভাল নীতি গ্রহণ করতে পারে। মাদকের প্রচলিত ভুল নীতি পর্যালোচনা করে তাকে বাস্তবসম্মতভাবে পরিবর্তন করতে হবে। জাতিসংঘের মাধ্যমেই সেটা শুরু হতে পারে।
সম্প্রতি মাদক ও অপরাধ বিষয়ক জাতিসংঘ কার্যালয় (ইউএনওডিসি) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপি সংঘবদ্ধ অপরাধ থেকে অপরাধীরা বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি ডলার আয় করে থাকে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি বছর হেরোইন ও কোকেন চোরাচালান থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি ডলার চোরাকারবারীদের পকেটে যায়। এ অর্থই আবার অপরাধমূলক কর্মকা- পরিচালনা সহ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে সন্ত্রাসবাদকেও জোরদার করে। চোরাকারবারীরা হেরোইন ও কোকেন পাচার থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৮ কোটি ডলার আয় করে। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় তার আয় করে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা প্রতি মিনিটে দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ ডলারের সমান।
মাদক আমাদের সমাজ ও পরিবারকে ধ্বংস করছে, বিপর্যস্ত করছে আমাদের অর্থনীতিকে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিমাত্রই শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি। মাদকাসক্ত ব্যক্তির পক্ষে সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের জন্য কোন অবদান রাখা সম্ভব নয়। বরং তারা সমাজ ও পরিবারের বোঝা। তারা নৈতিকভাবে স্থলিত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং সামাজিকভাবে ঘৃণিত। যে কোন অপরাধ করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। অত্যন্ত উদ্বেগ, দুঃখ আর চিন্তার বিষয় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম শিশু-কিশোর ও যুব সমাজই ক্রমান্বয়ে মাদকের ছোবলে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে মাদকের অপব্যবহার বৃদ্ধির অনেকগুলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো এর সহজপ্রাপ্যতা। কারণ হেরোইন, ইয়াবা, ফেন্সিডিল, মদ, গাঁজা ইত্যাদি মাদকদ্রব্যের সরবরাহ এবং প্রাপ্যতা শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে সর্বত্র পৌঁছে গেছে।
প্রতিষ্ঠিত মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও ইদানিং মাদক ব্যবসার সাথে শিশু-কিশোর ও নারীরা বেশি পরিমাণে জড়িত হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা নিজেরাই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য নিয়ে আসছে এবং কিছু ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীরা এ সকল নারী ও কিশোরদের মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহার করছে। বেশির ভাগ ব্যবসায়ীরাও নিজেও মাদকাসক্ত। স্বল্প আয়ের নি¤œবিত্তের মানুষ ও বস্তিবাসীরাই মাদক ব্যবসার সাথে বেশি জড়িত। তথাপি কিছু মুখোশধারী বিত্তসম্পন্ন লোকও বৈধ ব্যবসা ও অন্যান্য কর্মকা-ের আড়ালে মাদক ব্যবসা করে থাকেন। সকল প্রকার নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বহু সংখ্যক মানুষ এই ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে।
ইদানিং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা মাদকদ্রব্য অজ্ঞাত স্থানে রেখে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্রেতাদের সাথে কথা বলে তা বিক্রি করছে। তাছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশে কয়েক বোতল ফেন্সিডিল বা কয়েক পুরিয়া গাঁজা, হেরোইন লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হেঁটে হেঁটে বিক্রি করে। গাড়ির হেড লাইট, ব্যাটারি, সিটের ও পাটাতনের নিচে অভিনব কায়দায় মাদকদ্রব্য বহন করা হচ্ছে। ফেন্সিডিলকে পলিথিনের মধ্যে ঢেলে অভিনব কায়দায় বহন ও বিক্রয় করা হচ্ছে। দোকান ব্যবসা, বিউটি পার্লার, হোটেল- রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ব্যবসার আড়ালে অনেক ব্যবসায়ী মাদকের বেচাকেনা চালিয়ে থাকেন। বসতবাড়িতে অভিনব কায়দায় পাকা কুঠুরি তৈরি করে অত্যন্ত সঙ্গোপনে ফেন্সিডিল লুকিয়ে রেখেও ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। মদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, লাইসেন্সধারী ডিলার তথা ব্যবসায়ীরা লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে তাদের দোকান থেকে পারমিটবিহীন বা মদ কেনার জন্য যাদের বৈধ অনুমতি নেই তাদের নিকট মদ বিক্রি করে। এই সব দোকান থেকে খুচরা মদ ব্যবসায়ীরা তাদের চাহিদা মাফিক ইচ্ছে মতো মদ কিনে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে বিক্রি করে। লাইসেন্সধারী ডিলারগণ প্রতি বছর বহু সংখ্যাক ভুয়া পারমিট হোল্ডারের নিবন্ধন করিয়ে তাদের মদ উত্তোলনের পরিমাণ বাড়িয়ে অবৈধ ব্যবসা চালান। এতে মদের অপব্যাবহার বাড়ছে।
শুধুমাত্র একটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্নভাবে মাদকমুক্ত করা সম্ভব নয়। কারণ মাদক ব্যবসাগুলো আন্তঃজেলা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং এক জেলার মাদকসেবিরা প্রয়োজনে অন্য জেলায় গিয়ে মাদক সংগ্রহ, সেবন ও আনয়ন করেন। হেরোইন ও ফেন্সিডিলের মতো মাদক দ্রব্য বাংলাদেশে প্রস্তুত হয় না। পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ আফিম উৎপাদনকারী দেশ হলো-মিয়ানমার। এছাড়া থাইল্যান্ড ও লাওসের সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্ত এলাকায় প্রচুর আফিম উৎপাদন হয়। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল (মায়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড) এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান) এর মাঝে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদক ব্যবসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট কেন্দ্র। মাদকদ্রব্য আমাদের সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে ভারত ও মায়ানমার থেকে এবং সমুদ্র পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সুতরাং মাদকদ্রব্য যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য বিজিবি ও সীমান্তবর্তী পুলিশ এবং কোস্ট গার্ডকে সর্বাত্মক ও আন্তরিকভাবে সততা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। এজন্য তাদেরকে বিশেষ মোটিভেশনের মাধ্যমে মাদক বিরোধী অভিযানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শুধু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মাধ্যমে মাদকের মতো একটি সামাজিক ক্ষতকে সম্পূর্ণ নির্মুল করা সম্ভব নয়। এ জন্য অভিযানের সাথে সাথে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের সচেতন অংশ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মাদক নির্মুলে অবশ্যই সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি হওয়া দরকার।
১৯৯০ সালে জাতিসংঘ মাদক বিরোধী দশক (১৯৯০-২০০০) পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। যুব সমাজ তথা দেশকে মাদকের অভিশাপ থেকে বাঁচাতে হলে একটি লাগাতার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মাদক বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান খুবই কঠোর এবং অত্যন্ত সুদৃঢ়। এ ব্যাপারে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই তৎপর রয়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ভূমিকা স্বচ্ছ। ১৯৬১, ১৯৭১, ১৯৮৮ সালে জাতি সংঘে ৩টি মাদকবিরোধী কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনগুলোতে জাতিসংঘের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা হলো কোন রাষ্ট্রেই যেন আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে মাদকের অবৈধ পাচারকারীরা শাস্তি এড়িয়ে যেতে না পারে। চেতনানাশক দ্রব্যবিষয়ক কনভেনশন-১৯৭১, মাদক দ্রব্য ও চেতনানাশক দ্রব্র্যের অবৈধ পাচার রোধে জাতিসংঘ কনভেশন-১৯৮৮ এবং সার্ক কনভেনশন ১৯৯০’- এ বাংলাদেশে স্বাক্ষর করেছে। মাদক ব্যবহার ও পাচাররোধে বাংলাদেশের রয়েছে নানামুখি কার্যকরি ভূমিকা। তবে এ বাস্তবায়নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসাধারণের সার্বিক সহযোগিতা ও গণসচেতনতা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জনগণকে এর বিরুদ্ধে তীব্র এবং ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তবেই মাদক নির্মুল করা সম্ভব হবে, নচেৎ নয়।
লেখক : পুলিশ কর্মকর্তা (অব:)(আই.জি ব্যাজ, জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত)