মাদার বখ্শ এর ৫০তম মুত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০১৭, ১২:০২ পূর্বাহ্ণ

প্রফেসর ড. মো. তাজুল ইসলাম


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সংগঠক, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, শিক্ষা বিস্তার, সমাজসেবা এবং জনকল্যাণের জনক হিসেবে পরিচিত  মাদার বখ্শ উত্তরবঙ্গের মানুষকে আলোকিত করেছেন তাঁর ত্যাগের মাধ্যমে।  মাদার বখ্শ ১৯৬৭ সালের ২০ জানুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। আজ ২০ জানুয়ারি তাঁর ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী।
নাটোর জেলার সিংড়া থানার স্থাপনদিঘি গ্রামে এক কৃষক পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৯০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯২২ সালে তিনি সিংড়ার চৌগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় হতে ১ম শ্রেণিতে মেট্রিক, রাজশাহী কলেজ হতে ১৯২৪ সালে আই.এ এবং ১৯২৬ সালে একই কলেজ থেকে বিএ. ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ. পাশ করেন এবং ১৯২৯ সালে রিপন কলেজ থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর শিক্ষা জীবনের ব্যয় তিনি নিজেই পরিশ্রম করে অর্জন করেন।
শিক্ষা বিস্তারে অগ্রদূত মাদার বখ্শ শিক্ষকতা দিয়েই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। নওগাঁ জেলার পোরসার হাই মাদ্রাসায় এবং মুর্শিদাবাদের সালার উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি দুই বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি রাজশাহী জজকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের তিনি স্বল্প খরচে, অনেক ক্ষেত্রে বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা দিতেন।
১৯৪৬ সালে তিনি আত্রাই, বাগমারা ও মান্দা থানা নির্বাচনী এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ আইন সভার সদস্য ছিলেন। সেই সময়ে উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রতি সরকারের বৈষম্য ও বিমাতাসূলভ আচরণের প্রতিবাদে মাদার বখ্শ গর্জে উঠেছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেছিলেন বাংলা ভাষাকে যদি রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়া না হয়, তবে আমি আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করবো।
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ থেকে ২২ জুন ১৯৫৪ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সে সময় ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী নিউমার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি রাজশাহী শহরে রিক্সা চালু করেন। তিনি প্রথম সুইপারদের রেশন প্রদান করেন, তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন।
১৯৫৩ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি ভুবন মোহন পার্কে এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাদার বখ্শ সরকারকে বলেছিলেন যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা না হয় তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব। তাঁর এ বক্তব্যে টনক নড়ে সরকারের। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চে প্রাদেশিক আইন সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়।
মাদার বখ্শ রাজশাহীতে একটি মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালে রাজশাহীতে একটি প্রাইভেট মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সালে সরকার এই স্কুলটি অধিগ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে মেডিকেল স্কুলটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়।
তাঁর প্রচেষ্টাতেই রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “ রাজশাহী কোর্ট একাডেমী” ( ১৯৫৪ সালে যেটি সোবহানিয়া হাই স্কুল নামে পরিচিত), লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৬০ সালে), রাজশাহী মুসলিম হাই স্কুল (১৯৪৭ সালে) এবং রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ (১৯৬৭ সালে)। তাঁর নামে ১৯৮৬ সালে আরও স্থাপিত হয়েছে   “ মাদার বখ্শ আইডিয়াল স্কুল ” ও মাদার বখ্শ গার্হস্থ্য অর্থনীতি মহিলা কলেজ। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁর নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আবাসিক হল এবং শহরের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়।
মাদার বখ্শ এর মত একজন আপোষহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মানবপ্রেমিক জননেতা, দয়ালু আইনজীবী, সমাজসেবক, বিদ্যানুরাগী, মানবতাবাদী মহৎপ্রাণ মানুষ চিরদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে, বেঁচে থাকবে তাঁর কীর্তি। আমরা সবাই তাঁর আদর্শকে ধারণ করে আগামী দিনে দেশ ও সমাজ গড়ার কাজে আতœনিয়োগ করবো এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাধ্যক্ষ, মাদার বখ্শ হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস:
বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ, খ–৮, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, মার্চ-২০০৩, পৃষ্ঠা-১১৯।
* িি.িংড়সবযিবৎবরহনষড়ম.হবঃ (খধংঃ ফধঃব ারংরঃবফ: ১০-০১-২০১৭).