মানুষ জানত ‘দানশীল’ সাজেদুল পিএসসির বড় কর্মকর্তা

আপডেট: জুলাই ১২, ২০২৪, ৪:৩৯ অপরাহ্ণ


সোনার দেশ ডেস্ক :


পিএসসির অফিস সহায়ক পদে চাকরি করলেও সাজেদুল ইসলাম বছরে কখনও কখনও নোয়াখালীর সুবর্ণচরের গ্রামের বাড়ি যেতেন দামি গাড়ি হাঁকিয়ে; করতেন দান-খয়রাতও। যে কারণে, মানুষ ভাবত, তিনি প্রতিষ্ঠানটির ‘বড় কর্মকর্তা’।

চরবাটা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য চরবাটা গ্রামের বাড়ির প্রায় এক একর জায়গায় সীমানা প্রাচীর করেছিলেন সেখানে নতুন করে ভবন তৈরির জন্য। বছর দুয়েক আগে নিজের বোন ও ভগ্নিপতির দুজনের একসঙ্গে নন-ক্যাডারে চাকরি হলে গ্রামের মানুষদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন সাজেদুল।

প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসের ঘটনায় রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় যে মামলা হয়েছে, তাতে ৪১ বছর বয়সী সাজেদুলকে ‘চক্রের অন্যতম মূল হোতা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি পিএসসির একজন উপ-পরিচালকের কাছ থেকে প্রশ্ন পেতেন। তিনি প্রার্থী জোগাড়ের দায়িত্বও পালন করতেন।

তার বাসা থেকেই মামলার আরও দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই আলোচিত পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী ওরফে জীবনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে এজাহারে বলা হয়েছে।

মধ্য চরবাটা গ্রামের বাড়ি গিয়ে জানা যায়, সাজেদুলের পরিবার মূলত ঢাকাতেই বসবাস করে। বাবার চাকরি সূত্রে সেখানেই তাদের জন্ম ও লেখাপড়া। বাড়ির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ একেবারেই কম।

একটি চক্র প্রায় এক যুগ ধরে পিএসসির অধীনে বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত বলে ছয়জনের ছবিসহ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রোববার প্রচারিত হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে।

এরপরেই সিআইডি তদন্ত করে ওই ছয়জন ছাড়াও অন্য যাদের নাম পেয়েছে অভিযানে নেমে সাজেদুল ইসলামসহ মোট ১৭ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে পিএসসির দুজন উপপরিচালক, দুজন সহকারী পরিচালকও আছেন।

বুধবার আসামিদের মধ্যে সাজেদুল ইসলামসহ ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। পিএসসি এরই মধ্যে তাদের পাঁচজনের অবৈধ সম্পদের তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকে চিঠি দিয়েছে।

মামলায় সাজেদুল ইসলাম সম্পর্কে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার আসামিদের দেওয়া তথ্যে ভিত্তিতে দেখা যায়, এই চক্রের মূল হোতা সাজেদুল ইসলাম। প্রযুক্তির সহায়তার তাকে সোমবার মতিঝিলের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে তার বাসা থেকেই এই মামলার ১৪ নম্বর আসামি সাখাওয়াত হোসেন এবং ১৫ নম্বর আসামি তার ভাই সাইম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই, রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পশ্চিম শেওড়াপাড়া এলাকার বাসা থেকে আবেদ আলীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

সাজেদুল পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফরের মাধ্যমে প্রশ্ন পেতেন। পরে সহযোগী সাখাওয়াত ও সায়েম দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন। সেসব চাকরি প্রার্থীদের ঢাকায় ভাড়া বাসায় বা হোটেলে জড়ো করতেন। অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র বিতরণ করা হত।

রেলের সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন ক্যাডার) পরীক্ষার নিয়োগের সময় আবেদ আলীকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ও উত্তপরত্র দিয়েছিলেন বলে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার মধ্য চরবাটা গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের রবির দোকানের পাশের বাড়িটাই সাজেদুলদের। বাড়ির সীমানা প্রচীরটি নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। ইট-বালুসহ অন্যান্য উপাদান বাইরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বড় বাড়ি করার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। সেই অনুযায়ী সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয়। এর ভিতরে একটা ছোট টিনশেড ঘর আছে। বাড়িটি মূলত সাজেদুলের মামা ছেরাজুল হক দেখাশোনা করেন।

সাজেদুলের বাবা সামছুল আলম সরকারি পরিবহন পুলের কর্মচারি ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। সাজেদুলরা দুই ভাই, দুই বোন। সাজেদুল স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে মতিঝিলের এজিবি কলোনির সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। সেখানে তার মা থাকেন। কয়েক বছর আগে বাবা মারা গেছেন।

পরিবারটির গ্রামের বাড়িতে খুব একটা যাতায়াত ছিল না। ফলে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই সাজেদুল ও তার ভাই-বোনরা ততোটা পরিচিত না বলে জানান স্থানীয়রা। তবে সাজেদুল গ্রামে যখন যেতেন দামি গাড়ি নিয়ে যেতেন। মানুষের মধ্যে দান-খয়রাত করতেন। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর সাজেদুলকে নিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে কৌতুহল বাড়ে।

স্থানীয় বাসিন্দা শেখ ফরিদ বলেন, “সাজেদুলদের চার ভাই-বোনের সবার জন্ম ঢাকায়। তাদের সবার পড়াশোনাও ঢাকায়। তার বাবা চাকরির কারণে ঢাকায় থাকতেন। কিছুদিন আগে তার বোন আর বোন-জামাইয়ের একসঙ্গে সরকারি চাকরি হয়েছে। এরপর সাজেদুল এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছেন।”

আরেক প্রতিবেশী সিদ্দিক আলম বলেন, “সাজেদুল ইসলাম শরীফ এলাকার মানুষের কাছে দানশীল হিসেবে পরিচিত। উনার বোন প্রাইমারি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ না হতে পারলেও কিছুদিন আগে সরকারি বড় চাকরি পেয়েছেন। পরে এলাকায় মিষ্টিও বিতরণ করেছেন।

“উনিও অনেক লোককে চাকরি দিয়া থাকেন শুনতাম। আমি ভাবতাম, উনি পিএসসির বড় কর্মকর্তা, পরে শুনি উনি অফিস সহায়ক, পিয়ন।”
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, “কোরবানির ঈদে বাড়িতে গিয়ে সাজেদুল ইসলামের কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হয়েছি। দেখি নিজের গাড়িতে চলাফেরা করেন। শুনলাম তার বউয়েরও নাকি ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। নিজে কোটি টাকা কামাই করেন। ডুপ্লেক্স বাড়ি করার প্ল্যান করে বাউন্ডারির কাজ চলমান।

“সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, এলাকার মানুষ তাদের টাকার গল্প করে; বাট সততার না। দেশ, সমাজে শিক্ষার চেয়ে টাকার মূল্য যে বেশি”, আক্ষেপ করে বলেন ওই প্রতিবেশী।

আরিফুর রহমান বলেন, “সাজেদুলরা এলাকায় অনিয়মিত। সে মা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মতিঝিল এজিবি কলোনির কোয়ার্টারে বসবাস করে। তারা বাবা ২০১৯ সনে মারা যান। তিনি পরিবহন পুলের গাড়িচালক ছিলেন।”
“ঢাকা থেকে সাজেদুল যখন বাড়িতে আসতেন, তখন একা একা চলাফেরা করতেন। কারও সঙ্গে তেমন মেলামেশা করতেন না”, বলেন আরিফুর রহমান।

সাজেদুলের মামা ছেরাজুল হক বলেন, “ভাগনে-ভাগনিরা বাড়িতে তেমন একটা আসে না। এলেও সবার সঙ্গে মিশে না। দোকানপাটেও কম যায়। তাদের বাড়ি চরক্লার্ক ইউনিয়নে। এটা তার নানা বাড়ি। কোনো বাড়িতেই তাদের ঘর নেই।

“সাজেদুলের বাবা সামছুল আলম এই জায়গাটি কিনেছিলেন। মাত্র সীমানা প্রাচীর তোলা হচ্ছে। এখানে বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। সে তার বোন আর ভগ্নিপতির চাকরি হওয়ায় পরিচিতদের মিষ্টি খাইয়েছে। এর বেশি কিছু আমি জানি না।”

চরবাটা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইব্রাহিম খলিল বলেন, “সাজেদুল ইসলামের মূল বাড়ি চরক্লার্ক ইউনিয়নের আবদুর রব বাজারের পাশে। আমার ওয়ার্ডে তারা নতুন বাড়ির জন্য জায়গা কিনেছে। এটা তার নানার বাড়ির এলাকা। তার বাবা জীবিত থাকাকালীন তার মায়ের জন্য জমিটি কিনেছিলেন বলে জেনেছি।

“বর্তমানে বাড়ির কাজ ধরার পরিকল্পনা ছিল। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছে। এর ভেতর তো শোনলাম সে গ্রেপ্তার হয়েছে। আমরা এসব খবরে আশ্চর্য হচ্ছি।”
তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ