বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮ ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
আব্দুর রউফ রিপন,নওগাঁ প্রতিনিধি:
‘পাড়ার লোকেরা হামাক রাসেলের মা কয়া ডাকতো। একন হামার ছাওয়াল তো আর নাই, হামিও নাই।’ ছেলের রক্ত মাখা কাপড় নিয়ে বলছিলেন রাসেলের মা অঞ্জনা। এক মাত্র ছেলেকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে রাসেলের বাবা পিন্টুর। ১৮ বছরের ছেলে রাসেলের কবরের পাশে বসে করছেন বিলাপ, ডাকছেন সৃষ্টিকর্তাকে।
অন্যের জমিতে বসবাসরত ভুমিহীন এবং আশ্রয়হীন পিন্টুর ২মেয়ে এবং ১ছেলের মধ্যে ছোট মেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী। সবার ছোট রাসেল। বড় মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল কিন্তু মেয়ের বাবার জমি এবং ঘরবাড়ি না থাকায় এবং যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় তালাক প্রাপ্তা হয়ে থাকেন বাবা-মায়ের সাথে। এদিকে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার এজন্য রাসেল চাকরি করছিলেন নারায়ণগঞ্জের একটি রেডিমেট গার্মেন্টসে
। বেতনের টাকা পেলেই বাড়ি ফিরে মায়ের চিকিৎসা করাবেন। বাড়ি থেকে যাওয়ার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় গুলিবিদ্ধ লাশ হয়ে ফিরবেন এমনটি প্রত্যাশা করেননি কেউ।
কোটা বিরোধী সহিংসতায় নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডে পুলিশে গুলিতে নিহত রাসেলের নওগাঁর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। কোনো সান্ত্বনাতেই থামছে না সন্তানহারা মায়ের কান্না।
রাসেল (১৮) নওগাঁর মান্দা উপজেলার কসবা ভোলাগাড়ি গ্রামের গ্রামের পিন্টু ছেলে। তিনি নারায়ণগঞ্জের ডিআইট রোড এলাকায় রেডিমেট গার্মেন্টসে কাজ করতেন। ওই এলাকায় গত ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে বুকে গুলিবিদ্ধ হন রাসেল
। বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরদিন শনিবার অপারেশন করে গুলি অপসারণ করা হলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। পরদিন মঙ্গলবার তার লাশ পৌছে গ্রামের বাড়িতে এবং বুধবার দাফন করা হয়।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়েছেন বাবা পিন্টু। তিনি বলেন, ‘আমি মানষের জমিতে কাজ করি। মানষের জমিতে থাকি। আমার নিজের বলতে কিছুই নাই। ছেলেকে কবর দিয়েছি মানষের জমিতে। আমার আয় দিয়ে পরিবারের সবার মুখে ভাত দিতেই জীবন যায়যায়। ভেবেছিলাম ছেলের পাঠানো টাকা দিয়ে অসুস্থ বউয়ের চিকিৎসা করাবো। আর তা হলো না। আমার সব শেষ হয়ে গেলো।”
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে কোন দিন স্কুলে যায়নি। অভাবের সংসারে আমি কোন সন্তানকে স্কুলে দিতে পারিনি। আমার ছেলে কোন আন্দোলন করেনি মিছিলে যায়নি। তারপরেও আমার ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি এখন কি করে খাবো? কেমন করে চলবো? কার কাছে বিচার দিবো? কি নিয়ে বাঁচবো?’
প্রতিবেশি আব্দুর রশিদ বলেন, রাসেল খুব শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। গ্রামে কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতোনা। জীবনে কখনো গোলমাল বা মারামারির সাথে জড়িত হয়নি। তার মতো ভদ্র ছেলে এই এলাকায় ছিলনা।
স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য পাঞ্জাব আলী বলেন, ‘এই গ্রামে পিন্টুর চেয়ে গরীব লোক আর নেই। তিন ভাই বোনের মধ্যে রাসেল ছিলো সবার ছোট। টাকার অভাবে কোন ছেলে মেয়েকে পিন্টু লেখা পড়া করাতে পারেনি। এক বোনের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু টাকার অভাবে স্বামী তালাক দিয়েছে।
টাকার অভাবে প্রতিবন্ধী মেয়েটারও চিকিৎসা করাতে পারেননি। কিশোর রাসেলই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। এখন ভিক্ষা করে খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় আছে বলে মনে হয় না।’