মুক্তিযুদ্ধের ফিফ্থ-আর্মি : অপ্রচলিত যুদ্ধের কিছু বিষয়ে আলোকপাত

আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬, ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

 মো. আশরাফুজ্জামান


সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলেন ১৯৭০ এর ভোটে নির্বাচিত মুজিবনগর সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিকনায়ক। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তিনি ভালভাবেই অনুধাবন করতেন যে, পাক সামরিক জান্তা কখনো ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। পাকবাহিনী আক্রমণ করলে, যুদ্ধ শুরু করলে কি কি করতে হবে তা তিনি গোপনে পরিকল্পনা করে দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে সে সমস্ত কথাই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এসব বিষয়ে তিনি গোপনে ভারতের সরকারের সাথে যোগাযোগ করে যুদ্ধের ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন। যুদ্ধ করার জন্য যারা উপযুক্ত অর্থাৎ ছাত্র, যুবকদের তিনি নির্দেশনা ও দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছিলেন। পাকবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমত ছাত্র নেতা, যুব নেতা, ছাত্র জনতা আমরা ব্যারিকেড দেই, কেউ কেউ সংগৃহিত রাইফেল দ্বারা গুলি ছোঁড়ে, বোমা মারে। পুলিশ, ইপিআর, আনসারকে সশস্ত্র যুদ্ধে সাহায্য করি। পাকবাহিনীর ট্যাংক, হেভি- মেশিনগান, অটোমেটিক রাইফেলের গোলা গুলিতে জনতার প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়লে আত্মগোপন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকা হতে নেতৃস্থানীয় চার যুব নেতা যথাক্রমে শেখ ফজলুল হক মণি (বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে), সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ ভারতের কোলকাতায় চলে যান নির্দিষ্ট ঠিকানায়, অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে। কোলকাতার ঠিকানাটি বঙ্গবন্ধুই বলে দিয়েছিলেন যুব নেতাদের। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল (অব) সুজন সিং উবানের (পিভিএস, এভিএমএস) সাক্ষাৎ পান ভারত সরকারের পক্ষ হতে। সুজন সিং উবানের অনেক উল্লেখযোগ্য পরিচয় আছে। তিনি এশিয়ার বিখ্যাত সামরিক গেরিলা বিশেষজ্ঞ। অবসর গ্রহণের পরও সরকার তাঁকে ভারতের স্পেশাল ফ্রন্টটিয়ার্স ফোর্সের বা এসএসএফ এর ইন্সপেক্টর জেনারেল নিয়োগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি এ পদেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও দক্ষতা দেখানোর জন্য ভারতীয় সামরিক সর্বোচ্চ পরম বিশ্বস্ত সেবক পদক পান এবং পরে বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পদক পান। তাঁর সাথে সাক্ষাৎকারে চার যুব নেতা মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলেন। তিনি সে পরিকল্পনাসহ অন্যান্য রিপোর্ট তাঁর ওপরওয়ালা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনিয়েট সেক্রেটারিকে প্রদান করেন এবং পরবর্তী কার্যক্রমের নির্দেশ পান। তাঁর সামরিক কার্যক্রম চলে ক্যাবিনিয়েট সেক্রেটারিয়েট মিলিটারি কমান্ডার ইন-চিফ জেনারেল মানেকশ এর দফতর হতে।
আমার প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের ফিফ্থ আর্মি। এই ফিফ্থ আর্মি সম্পর্কে কিছু পরিচয় দিচ্ছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ফিফ্থ আর্মি ছিল। ফিফ্থ আর্মির প্রধান কাজ হল সীমান্তে শত্রুর প্রতিরক্ষা আক্রমণ ব্যবস্থাপনার পিছনে বা দেশের ভিতরে কৌশলে প্রবেশ করে তাদের প্রতিরক্ষা, চলাচল, স্থাপনা ধ্বংস করে দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের ফিফ্থ আর্মি বলতে বোঝায় দুটি অপ্রচলিত যুদ্ধের আধাসামরিক ও বেসামরিক কমান্ডে, গেরিলা বাহিনী। এর একটি হল মুজিব বাহিনী ও অন্যটি হল ভারতীয় স্পেশাল ফ্রন্টটিয়ার্স ফোর্স বা এসএসএফ। মুজিববাহিনী হল বাংলাদেশের ন্যূনতম এসএসসি পরীক্ষা পাশ ছাত্র যুবকদের স্বেচ্ছাসেবী ও অস্থায়ী গেরিলা বাহিনী যা বাংলাদেশে উনসত্তর সাল হতে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ নামে অতিগোপন বাহিনী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। এসএসএফ হচ্ছে ভারতে উত্তরে হিমালয়ের সীমান্তের উপজাতীয় তিব্বতি কমান্ডো কাম গেরিলা বাহিনী। এবং তিব্বত বাহিনী হিসাবেও পরিচিত। এরা প্যারাট্রুপার্স ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং বেতনভুক্ত স্থায়ী বাহিনী। ভারতে নির্বাসিত তিব্বতের দলাইলামার নেতৃত্বে তিব্বত দখল তাদের আসল লক্ষ্য। মুজিব বাহিনী ও এসএসএফ দুটোই স্পেশাল ফোর্স। স্পেশাল ফোর্স অপ্রচলিত যুদ্ধের বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করে। এসএসএফ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডেপুটেশনে যাওয়া অফিসার দ্বারা পরিচালিত তিব্বতি যুবকদের বিশেষ বাহিনী যার নিজস্ব কমান্ড স্ট্রাকচার, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, লজিসটিক্স, ব্যবস্থাপনা আছে। স্পেশাল ফোর্স সামরিক কমান্ড ও অন্যান্য বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে নিজের কমান্ডেই প্রধানতঃ খ- যুদ্ধ করে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে যুদ্ধরত বাহিনীর সাথে স্পেশাল ফোর্স, জঙ্গি, সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশেও জঙ্গি বিরোধী যুদ্ধে বিভিন্ন স্পেশাল ফোর্স সাহসিকতা পূর্ণ কাজ করছে। মুজিব বাহিনী ও বাংলাদেশ এবং ভারতের সামরিক কমান্ডের সাথে সমন্বয় করেছিল দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) সুজন সিং উবালের মাধ্যমে। মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের বই “লক্ষ প্রাণের বিনিময়ের” “বিশেষ কাহিনীর ছেলেরা” অধ্যায়টি পড়লেই তা বুঝতে পারবেন। এ ছাড়াও ১৯৭১ এর ২০ নভেম্বর ভারতের আগরতলায় সর্বোচ্চ কমান্ডার পর্যায়ে বাংলাদেশ ভারত যৌথ বাহিনী বা মিত্র বাহিনীর সাথে মুজিব বাহিনীও এসএসএফ এর টোটাল ওয়ারের সমন্বয় হয়। এ দুটি বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য ভারতীয় কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল পরে ফিল্ড মার্শাল মানেকশ এ দুটি বাহিনীর মিলিত রূপকে ফিফ্থ আর্মি বলে বাহ্বা ও নাম দেন। কখনো “পূবের আর্মি” বলেও অভিহিত করতেন। মুজিব বাহিনীকে ভারতীয় আর্মি অনেক সময় “মানেকশ বয়েজ” বলেও উল্লেখ করতেন। মেজর জেনারেল (অব.) উবান নিজে নাম দিয়েছিলেন ফ্যান্টমস্ অব চিটাগাং বা জঙ্গলের ছায়ারূপী ভৌতিক যোদ্ধা যারা অদৃশ্য হয়ে চলাফেরা করে পাহাড়ে, জঙ্গলে।
মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ১৯৭১ এর জুন মাসে শুরু হয়। অপ্রচলিত যুদ্ধের স্পেশাল ফোর্সের ট্রেনিং হয়ে থাকে দুর্গম পাহাড়-পর্বত, জঙ্গলে গোপন স্থানে। যুদ্ধও করতে হয় দুর্গম পাহাড়, পর্বত, দূরবর্তী অঞ্চল শত্রুর পিছন ভাগে, শত্রুর সীমান্ত অতিক্রম করে অভ্যন্তরে। রণকৌশল কনভেনশনাল ওয়ার হতে ভিন্ন এবং যুদ্ধেরও বিশেষ কলা কৌশল থাকে। মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং এসএসএফদের ট্রেনিং সেন্টারেই শুরু হয়। স্থানটি হল ভারতের বর্তমান উত্তরাখন্ডের হিমালয়ের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের দেহরাদুন জেলার ৮০০০ ফুট উচ্চতায় চাকরাতা ক্যান্টনমেন্টের তান্ডুয়া গোপন ট্রেনিং সেন্টারে। এ ছাড়াও ট্রেনিং হত আসামের হাফ লং, ডেমাগিরিতে। দেড় মাস ট্রেনিং হত। দেড় মাসে যা ট্রেনিং দেওয়া হত তা কম পক্ষে এক বছরের স্বাভাবিক সময়ের সামরিক ট্রেনিং এর সমান। রাতদিন ট্রেনিং হত। গেরিলা যুদ্ধের বিচিত্র বিষয়ের ট্রেনিং। আধুনিক অস্ত্রচালনা যেমন- রাইফেল হতে শুরু করে এসএলআর, এলএমজি, এসএমসি (উন্নত স্টেনগান), গ্রেনেড ট্যাপ, মাইন, টুইঞ্চ মর্টার, থ্রি ইঞ্চ মর্টার, আরসিএল গান। এ ছাড়াও আরো অনেক সামরিক ও গেরিলা তত্ত্ব, বেইড, অ্যামবুশ, ক্যাশিং, ডেমোলেশন, রেডিও টান্সমিটার ও কমিউকেশন এমনি আরো অনেক জরুরি বিষয় ও রণকৌশল। তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক মহড়া হত। ফায়ারিং, প্র্যাকটিস হত। ট্রেনিং এর নাম গেরিলা লিজারশিপ ট্রেনিং। ১ম হতে ১৬ তম কোর্স পর্যন্ত মোট দশহাজার গেরিলা লিডারকে ট্রেনিং দিয়ে থানা ভিত্তিক দেশের অভ্যন্তরে ইনডাকশন বা প্রেরণ করা হয় সশস্ত্র অবস্থায় গোলাবারুদ, এক্সপ্লোসিভ, গ্রেনেড সহ গেরিলা ওয়ার ফেয়ারের জন্য। মুজিব বাহিনীর যুদ্ধের সকল ব্যবস্থাপনা ছিল চমৎকার ও দুঃসাহসী। গেরিলাদের সমবেত ইচ্ছা অনুযায়ী বিএলএফ হতে এ বাহিনীর নামকরণ করা হয় মুজিব বাহিনী। বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করাই এ বাহিনীর যুদ্ধের লক্ষ্য।
সত্তরের দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সামরিকজান্তার মেশিনগান, রাইফেলের মুখে সংগ্রামে যেসব ছাত্র, যুবক, সুনাম অর্জনকারী অগ্রসেনানী নেতা হয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগই মুজিব বাহিনীতে যুদ্ধ করেছেন। এমএনএ, এমপিএগণও ছিলেন মুজিব বাহিনীতে। যাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য তারা হলেন- শেখ ফজলুল হক মণি, মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার, সিরাজুল আরম খান মুজিব বাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার, আব্দুর রাজ্জাক, মুজিব বাহিনীর মধ্যাঞ্চলীয় কমান্ডার, তোফায়েল আহমেদ, মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডার। এ ছাড়া সহকারী কমান্ডার ছিলেন আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ জামাল, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র আশরাফুল ইসলাম, কাজী আরেফ, নূরে আলম জিকু, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আফম মাহাবুবুল হক, মার্শাল মণি, স্বপনকুমার, খসরু, মোস্তফা মোহসিন মন্টু, ওবায়দুল কাদের, এমনি আরো অনেকে। বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মুজিব বাহিনীতে ছিলেন।
দেশের প্রত্যেক থানার ছাত্র, যুব নেতাদের রিক্রুট করে মুজিব বাহিনীতে গেরিলা লিডারশিপ ট্রেনিং দেওয়া হত। তারা নিজ নিজ থানা অঞ্চলে ছাত্র জনতাকে ট্রেনিং দিয়ে গেরিলাদল গঠন করে জনগণ রক্ষা করে খ- যুদ্ধ ও অন্যান্য গেরিলা ওয়ার ফেয়ার করত। উদাহরণ স্বরূপ রাজশাহী মহানগরীর কয়েকটি থানার গেরিলা ট্রেনিং প্রাপ্ত লিডারগণ হলেন, দরগাপাড়ার জাহাঙ্গীর হোসেন, মাহফুজুর রহমান খান, নূরুল ইসলাম মতিন, অন্যান্য পাড়ার অ্যাডভোকেট মো. মতিউর রহমান, রবিউল ইসলাম, আব্দুল জলিল, সাব্বির রহমান, হাবলুল মতিন, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, শরীফ উদ্দিন, মনিরুল হক জোহা, এজাজুল হক মিঠু, রতন, মোখলেস-ই-সাত্তার, হাকিম আতাউর রহমান এবং মো. আশরাফুজ্জামান  (লেখক নিজে) এবং আরো কয়েকজন।
এবার যুদ্ধের কথায় আসা যাক। ফিফ্থ আর্মির টোটাল ওয়ারের দায়িত্ব পড়ে বাংলাদেশের দুর্গম পার্বত্য, জঙ্গল এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম মুক্ত করে চট্টগ্রাম বন্দর দখল করা এবং নদী পথে ঢাকায় প্রবেশ করে ঢাকাতে শত্রু পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। এ নির্দেশ ও ইন্সক্ট্রাকশন দিয়েছিলেন কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল মানেকশ। কারণ তিনিই একমাত্র এসএসএফ বা ফিফ্থ আর্মিকে কমান্ড করতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট দপ্তরের অনুমোদনে। আদেশ পাওয়ার পর ২৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল উবান ভারতের বিভিন্ন স্থান হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তে ভারতের মিযোরামে এসএসএফদের সমাবেশ করতে শুরু করেন। এটাই প্রথম যৌথ বাহিনীর টোটাল ওয়ারের শুরু। মুজিব বাহিনী ইতোমধ্যেই সারা বাংলাদেশে ইনডাকশন বা প্রবেশ করে খ- খ- যুদ্ধ ও যুদ্ধ কর্মকা- শুরু করে দিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামেও তারা আগে থেকে প্রবেশ করে বেইড, অ্যামবুশ, বেইস, খ-যুদ্ধ করে যাচ্ছিল ভারতের বিদ্রোহী মিযোবাহিনী ও পাকবাহিনীর সাথে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম হল ভারতে সীমান্তে পার্বত্য, জঙ্গল এলাকা। ভারতের আসাম ও মিযোরামের পার্বত্য এলাকার মতই উপজাতীয় এলাকা। পর্বতের চড়াই, উৎরাই, গিরিখাদ পার্বত্য নদী, হ্রদ, ঝর্ণা, জঙ্গল, কর্ণফুলী নদী পেরিয়ে পায়ে হেঁটে বা নৌকা, ছোট ছোট জলযানে রসদ, গোলাবারুদ নিয়ে চলতে হয়। এ এলাকায় সুপেয় পানি কম। আমাশয়, ম্যালেরিয়া, সাপ, হিং¯্র জন্তু, মশা দ্বারা প্রচুর আক্রমণ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম কনভেনশনাল ওয়ারের জন্য উপযুক্ত না হওয়ায় এ এলাকাটি মুক্তিবাহিনীর সেকটর বহির্ভুত এলাকা ছিল। এ জন্যই এসএসএফ বা ফিফ্থ আর্মিকে কমান্ডো ও গেরিলা যুদ্ধের টোটাল ওয়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয় যা ছিল দুঃসাহসিকতাপূর্ণ কাজের। মেজর জেনারেল উবান ১৯৭১ এর আগে থেকেই এসব ভারতীয় এলাকায় মিযো, নাগা, নকশাল বিদ্রোহীদের দমনে নিয়োজিত ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাক বাহিনী ভারতের  মিযো বিদ্রোহীদের ট্রেনিং সেন্টার খুলে গেরিলা/কমান্ডো ট্রেনিং দিয়ে বাহিনী বানাত। রাঙামাটিতে বড় ট্রেনিং সেন্টার ছিল এবং সেখানে চিনা ইন্সট্রাকটরগণ মিযোদের ট্রেনিং দিত।
চট্টগ্রামে পাক বাহিনীর অবস্থান ছিল ইপকাপ, মিযো বাহিনী, বেলুচ, পাঠান, পাঞ্জাবী ছোট ছোট ইউনিট দ্বারা সজ্জিত। প্রয়োজন পড়লে চট্টগ্রাম হতে দ্রুত পাক মূলবাহিনীর ফ্রন্টটিয়ার্স ফোর্স, অন্যান্য ব্রিগেডের সাহায্য পেত। পাক ইয়ার ফোর্সের বম্বিং, হেলিকপটার গানশিপ, প্যারাট্রুপাস ইত্যাদি সাহায্য পেত। মিত্র বাহিনীর ৪র্থ কোর ফ্রেনী চট্টগ্রাম কলামের পার্শ্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার শত্রুবাহিনী হুমকি স্বরূপ ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম কিছু বিষয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। (১) পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধরত ভারত বাংলাদেশ বাহিনী কর্ণফুলী নদী দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দখল করতে পারে। (২) চট্টগ্রাম আরাকান মহাসড়ক দিয়ে পাক বাহিনী বার্মায় পলায়ন করতে পারে। (৩) আমেরিকার সপ্তম নৌবহর এসব এলাকার সমুদ্র দিয়ে কর্মতৎপরতা চালাতে পারে। (৪) পাক বাহিনী ও সহযোগী যুদ্ধাপরাধীরা পার্বত্য অঞ্চলে লুকিয়ে পড়ত ও সমস্যা তৈরি করত। (৫) মিযো বিদ্রোহীরা অপতৎপরতা করতেই থাকত। (৬) পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে নদী পথে ঢাকায় বাহিনী ঢুকতে পারে সহজেই।
ফিফ্থ আর্মি বাহিনী নিজস্ব কার্গোবিমান, হেলিকপ্টার যোগে মিযোরামের সীমান্তে এসএসএফ সৈন্য সমাবেশ করে বেং বিভিন্ন কলাম তৈরি করে সে অনুযায়ী টোটাল ওয়ারে নেমে পড়ে। এসএসএফ এ আছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল লে. কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেন, ল্যাফটেনেন্ট, জুনিয়র অফিসার, মেডিকেল কোর অফিসার, এয়ার ফোর্সের অফিসার ইত্যাদি এবং এসএসএফ জোয়ানগণ বা কমান্ডো। নিজস্ব লজিস্টিকস্ সাপোর্ট অস্ত্র, গোলাবারুদ, পরিবহন বলতে ছিল- এয়ার ফোর্সের কার্গো বিমান, হেলিকপ্টার, মিলিটারি ট্রাক, জিপ ইত্যাদি। মেশিনগান, মর্টার, রকেট লাঞ্চার, এলএম,জি, এসএলআর, এসএমসি, রিভলবার ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ, ডেমোলেশন সামগ্রী। খাদ্য সরবরাহ ছিল না। খাদ্য নিজস্ব সংগ্রহ করতে হত। ফিফ্থ আর্মির জন্য মিত্র বাহিনীর সাহায্য বিশেষ করে এয়ার ফোর্স ও আরও হেলিকপ্টারের প্রয়োজন হলে তা পাওয়া যায়নি। কেননা তা ডিসেম্বরে অন্য জায়গায় যুদ্ধে প্রয়োজন পড়ছিল।
ফিফ্থ আর্মির সকল যুদ্ধের বিবরণ অনেক বড় যা বড় বই হয়ে যাবে। আমি সংক্ষেপে কিছু কিছু লিখছি। মেজর জেনারেল উবান কমান্ডো কাম-গেরিলা রণকৌশল অবলম্বন করেছিলেন। একই সঙ্গে দুটি কলাম ব্যবহার করেছিলেন। একটির নাম অ্যানভিল অর্থাৎ কামারের নেহাই এবং দ্বিতীয়টা হাতুড়ির মত কাজ করে। কম সচল অ্যানভিল ফোর্স সাধারণভাবে কর্ণফুলি নদীর গতিপথ অনুসরণ করে চলেছে এবং চূড়ান্ত সচল হ্যামার ফোর্স আঘাত হেনে শত্রু আউটপোস্টগুলিকে গুড়িয়ে দিয়েছেন বর্কলে, সুভলঙে এবং রাঙামাটিতে। একজন কোম্পানি কমান্ডার কমান্ডো দিয়ে কঠিন যুদ্ধে নদীর উপর সেতুবদ্ধ হস্তগত করল। মে. জে. উবান সশস্ত্র ক্যাডারদেরকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলানোর জন্য শত্রুর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি রাঙামাটি ও চট্টগ্রামে ঢুকিয়ে দিলেন। মেজর সুরত সিং ভিএসএ,এর অধীন কেন্দ্রীয় কলামটি দুটি সাব-কলামে বিভক্ত হয়ে বর্কলের দিকে সাঁড়াশির আকারে এগিয়ে গেল। এ যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু শহিদ হয়, আহত হয়। শত্রুপক্ষে আহত, নিহত এবং শত্রুর অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত হয়। অন্য কলামটি লেফটেন্যান্ট কর্নেল বি. কে নারায়ণের কমান্ডের অধীনে বর্কলের সকল শত্রুকে ফাঁদে আটকানোর লক্ষ্যে চারদিক থেকে বর্কল ঘিরে অগ্রসর হয়। এই কলামটি অত্যন্ত সাহসের সাথে যুদ্ধ করে শত্রু পোস্টগুলি মুক্ত করল। এ পর্যায়ের যুদ্ধের শত্রু পাকবাহিনী শক্তি বৃদ্ধি করে। এ অবস্থায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রয়োজন পড়ে এবং মে. জে. উবানের অনুরোধ রকেট হামলা করে এবং শত্রু কে বিধ্বস্ত করে। মে. উবান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসসার কে নির্দেশ দিলে সর্বল শত্রু মুক্ত করে সেখানে প্রবেশ করে। সেখানকার জনগণ তাদের স্বাগত জানায়। শত্রু পালিয়ে যায় এবং তাদের অস্ত্র গোলাগুলি হস্তগত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘অপারেশন ঈগলে’ এসএসএফ দের একমাত্র এমই-৪ হেলিকপ্টারটি কৌশলে আকাশের ব্যাটলশিপ হিসাবে প্রস্তুত করা হল। এতে চড়ে শত্রুকে মেশিনগানের গুলি, গ্রেনেড ছোড়া, পেট্রোল ভর্তি পিপা জড়িয়ে শত্রুর ঘাঁটি গুলিকে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল তাদের ব্যাপক গুলিবর্ষণ সত্ত্বেও। এ এক অভিনব ও দুঃসাহসী কর্মকা-।
অনেক কমান্ডো কাম গেরিলা আক্রমণ কলাম যুদ্ধের টোটাল ওয়ারে বর্কল, সুভলং ঘাঁটি এসএসএফ ও মুজিব বাহিনীর হস্তগত হল যা দুঃসাহসিক যুদ্ধের ইতিহাস।
আক্রমণের সকল প্রস্তুতি শেষ হওার পর মেজর জেনারেল উবানকে অপারেশন সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য দিল্লিতে ডেকে পাঠালেন সিভিলিয়ান ক্যাবিনেট সেক্রেটারি। নানা ধরনের অপারেশনাল পরামর্শ ও কৌশল নির্ধারণ হল। মে. জে. উবান জেনারেল মানেকশ’ এর সাথে দেখা করলেন। তিনি তাঁর যুদ্ধের প্রশংসা করলেন এবং “মাই কমান্ডার ইন চিফ অবদি ইস্ট” বলে অভিহিত করলেন। এ ছাড়া তিনি তাঁকে অপারেশনগত নির্দেশের পরিধি বর্ধিত করে চট্টগ্রাম বন্দর ও শহর দখল করার দায়িত্ব দিলেন।
এবার আমি মেজার জেনারেল উবানের হুবহু বর্ণনায় যুদ্ধের একটি অংশ লিখছি “স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স পাবর্ত্য চট্টগ্রামের মধ্যভাগে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল। উত্তর কলাম তাদের অগ্রগতির অবিমিশ্র ভাল খবর পাঠাচ্ছিল। রাঙামাটি আক্রমণের আগে দক্ষিণে কাপ্তাই হুমকির মুখে ফেলার জন্য আমি ২শ জনের মতো মুজিব বাহিনীর ছেলেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি চট্টগ্রাম ও ঢাকার পথে আমার সঙ্গে থাকার জন্য এসে পৌঁছেছিলেন সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী যা আমি ছকে ফেলেছিলাম এবং মুজিব বাহিনীর ছেলেদের সঙ্গে সব মহড়া দিয়েছিলাম। সেসব ছেলেরা ঢাকা পৌঁছে গিয়েছিল। পাকিস্তান গায়ে পড়ে যুদ্ধ ঘোষণা করার সাথে সাথে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে দিল। একটা সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসাবে বাংলাদেশের মর্যাদা আমরা উদযাপন করলাম। জনাব মণি এবং আরও কয়েক জন তাঁদের মুক্তিতে ভারত যে ভূমিকা পালন করছে তার সহৃদয় উল্লেখ করলেন। আমার বক্তৃতার পর বাঙালি তরুণরা গান গাইল ও নাচল।
পরদিন সকালে মুজিব বাহিনীর ছেলেরা তাদের যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার জন্য বেরিয়ে পড়ল। তারা ছিল খুবই কমবয়সী এবং অনভিজ্ঞ, আমি তাদের পরিণতির কথা ভেবে শঙ্কিত হচ্ছিলাম। পরে এটা জেনে আঁৎকে উঠেছিলাম যে, নিজেদের পরিচয় গোপন করার জন্য তাদের মধ্যে কতক তাদের অস্ত্র নদীতে ছেড়ে দিয়েছিল যখন ছোট ছোট নৌকায় নদী পার হওয়ার সময় তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। অবশ্য পরে তারা তাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করেছিল ওই একই নদী পার হতে উদ্যত পলায়নপর মিযোদের চ্যালেঞ্জ করে তাদের কিছু অস্ত্র দখল করার মাধ্যমে।”
“চট্টগ্রাম নিয়ে কাড়াাড়ি:- চট্টগ্রাম বন্দর ও শহরে আগেই অনুপ্রবেশ করা মুজিব বাহিনীর ছেলেদের আমার ফোর্সের নদী পাড়ি দিয়ে রাতের বেলায় চট্টগ্রামে নামার জন্য নৌকার ব্যবস্থা করল। তারা বেতার কেন্দ্র দখল করল। বেতার কেন্দ্রের স্টাফের মধ্যে তাদের সমর্থন ছিল। তারা এমনকি পাক সৈন্যদের আত্মসমর্পণেরও ঘোষণা করল।
ঠিক এই সময় আমি আর্মি সদর দফতর থেকে সংকেত বার্তা পেলাম যে, আমার ফোর্স কর্ণফুলি নদী পাড়ি দেবে না এবং তার দক্ষিণ দিকে থাকবে। এ হচ্ছে আমাকে চট্টগ্রামে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করা, চট্টগ্রাম হচ্ছে কর্ণফুলি নদীর উত্তর পারে। সংকেত বার্তা এও বলল যে, চট্টগ্রামস্থ পাক আর্মির সেনাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণের জন্য দুটি আর্মি ব্রিগেড চট্টগ্রামের পথে রয়েছে।
একটা ছোট গেরিলা ফোর্সকে সেখানকার পাক সৈন্যদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে দেওয়া এবং তারা এই মস্ত বন্দর নগরীটি দখল করেছে এই কথা বলার সুযোগ দেওয়া বোধ করি আর্মির পক্ষে একটু বেশি হয়ে যাচ্ছিল। আমরা সাংঘাতিক রকম হতাশ হলাম। এতে বিস্ময় ও ক্রোধ প্রকাশ করতে শেখ ফজলুল হক মণি যা মুখে এসেছে তাই বলেছিলেন।”
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ১৬:৩১ ঘটিকায় পাক বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করল মিত্র বাহিনীর নিকট ঢাকায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধ পরিস্থিতি তখনও ভিন্ন ছিল। মেজর জেনারেল উবানের ভাষায়, “আমার সৈন্যরা তখনও গোলাগুলির সম্মুখিন হচ্ছিল। মিযো রাজাকার এবং চাকমাসহ অনেক প্যারামিলিটারি বাহিনীর বিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে কিছু সশস্ত্র লোক পার্বত্য চট্টগ্রামের  মতো গেরিলা যুদ্ধের আদর্শ ভূমিতে বিচরণ করছিল। আর্মি চিফ এর আদেশে আর্মি যুদ্ধ বিরতি আদেশ দিয়েছিলাম।” এ অবস্থায় তিনি আর্মিকে বাস্তব অবস্থা জানালে তিনি (মানেকশ) শুধুমাত্র আত্ম রক্ষার্থে গুলি চালাতে নির্দেশ দিলেন। মিযোরা পাক হাই কমান্ডকে মান্য করলে এবং আত্মসমর্পর্ণ না করলে ধাওয়া করে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বের করে দিতে বললেন। ধাওয়া খেয়ে মিযোরা মিযোরাম সীমান্ত বরাবর আত্মসমর্পণ করল। তবুও যুদ্ধ থামল না। মিযোদের বিরুদ্ধে আরও কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। আমেরিকার সপ্তম নৌবহর এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল।
ফিফ্থ আর্মির সকল যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অনেকে শহিদ হয়, অফিসার সহ আহত হয় অনেক। শত্রু পক্ষের অনেক নিহত হয়, আহত ও আত্মসমর্পণ করে অনেকে। অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত হয়। মেজর জেনারেল (অব.) উবান তাঁর সামগ্রিক যুদ্ধ কর্মকা- ও অভিজ্ঞতার উপর একটি মূল্যবান বই লিখেছেন যার নাম হ’ল “ফ্যান্টমস্ অব চিটাগাং: দিফিফ্থ আর্মি ইন বাংলাদেশ।” বইটির নাম থেকেই আমি আমার প্রবেন্ধর শিরোনাম করেছি। বইটি ভারত এবং অন্যান্য দেশ হতে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি ইংরেজিতে লিখেছেন। বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের সত্য, সঠিক ইতিহাস সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে যা মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল। বইটি হতে আমার প্রবন্ধের অনেক তথ্য নিয়েছি এবং আমার যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসহ নিজের ভাষায় লিখেছি। বাংলাদেশে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছে “ঘাস, ফুল, নদী প্রকাশনী” ৮৪ আজীজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০, সেলফোন: ০১৮১৮০০৯০৯৪। নতুন প্রজন্ম সহ অন্যান্য পাঠকগণ বইটি পড়লে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা সত্য সঠিক ইতিহাস জানতে পারবেন।
ভারতীয় সরকার ও কমান্ডার-ইন-চিফ ফিল্ড মার্শাল মানেকশ ফিফ্থ আর্মির মূল্যায়ন করেছিলেন খুবই গুরুত্বের সাথে। মেজর জেনারেল (অব.) উবান সাহসিকতা ও যুদ্ধকর্মের জন্য পুরস্কার প্রাপ্তির তালিকা পাঠিয়েছিলেন ফিল্ড মার্শাল মানেকশ এর কাছে। সে অনুযায়ী ছয়জন বীরচক্র, সাত জন বিশিষ্ট সেবা মেডেল, পাঁচজন সেনা মেডেল, এগার জন মেনসন-ইন- ডেসপ্যাচেস মেডেল পান। মেজর জেনারেল (অব.) উবান পান পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেল। মোট পুরস্কার পাওয়া গেল তিরিশটি। মে. জে. উবান তাঁর সিভিলিয়ান ব্যক্তিগত সহকারী শ্রী এস. ডি ক্যান্ড্রলি বিশিষ্ট সেবা মেডেল পাননি বলে দুঃখিত হয়েছিলেন। সেই সাথে বেতার যোগাযোগের কমান্ডার অব সিগনালস মেজর এমএল দত্ত বিশিষ্ট সেবা মেডেল পাওয়ায় খুশি হয়েছিলেন এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট কোম্পানি কমান্ডার টিএস বাওয়া পদক না পাওয়ায় দুঃখিত হয়েছিলেন। ভারতীয় সরকার ও এসএসএফ সামরিক স্ট্রাকচার মুজিব বাহিনীকে খুবই সম্মান দিয়েছিল। মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারদের চলাচলের জন্য দুর্গম, পার্বত্য অঞ্চলে সামরিক হেলিকপ্টার সুবিধা দিতেন। মে. জে. উবান তাঁর বই এ মুজিব বাহিনীর বিভিন্ন চিত্র দিয়েছেন- যার মধ্যে আমার চিত্রও আছে।
বাংলাদেশ পক্ষ মুজিব বাহিনীর যুদ্ধের তেমনভাবে মূল্যায়ন হয় নাই। আমার জানা মতে, একজন মাত্র বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। দশ হাজার মুজিব বাহিনীর গেরিলা লিডারের যুদ্ধ কর্মের, যার মধ্যে অনেক দুঃসাহসিক যুদ্ধও আছে, তার সমন্বিত কোন রেকর্ড নাই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তরের “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ” ৭ খ–বই এ অল্প কিছু বিবরণ আছে। মুজিব বাহিনীর তালিকাও ভারত হতে আনা হয় নাই।