শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত বহু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। পান না কোনো সরকারি ভাতাও। রাজশাহী অঞ্চলেও এ সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে। স্বীকৃতি পান নি এমন মুক্তিযোদ্ধার তথ্য সংবলিত প্রতিবেদন দৈনিক ‘সোনার দেশে’ও প্রকাশিত হয়েছে।
অথচ সরকারিভাবে তৈরি তালিকায় রয়েছে বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার লক্ষ্যে নতুনভাবে আবার শুরু হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া। এ যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে মুক্তিযুক্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাইয়ের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও যাচাই-বাছাইয়ের সম্ভাব্য তারিখ দেয়া আছে। ওই ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়, রাজশাহী নগরীতে যাচাই-বাছাইয়ের সম্ভাব্য তারিখ দেয়া হয়েছে জানুয়ারির ৭ তারিখ। জেলার গোদাগাড়ী থানায়ও ৭ তারিখ, তানোর ও পুঠিয়ায় ১৪, মোহনপুর ও চারঘাটে ২১ এবং বাগমারা ও দুর্গাপুরে ৪ ফেব্রুয়ারি।
অথচ এই যাচাই-বাছাই নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দ। তারা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছে। তারা সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। তাদের বাদ দেয়া অনেক কঠিন হবে। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও স্বীকৃতি পাননি। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়ে খোদ কেন্দ্রে আবেদন পড়েছে দেড় লাখ। তবে যাচাই-বাছাইয়ের এই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হলে সঠিক মুক্তিযোদ্ধার তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে স্বীকৃতি না পাওয়া মুক্তিযোদ্ধারাও তালিকাভুক্ত হবেন।
দৈনিক সোনার দেশের প্রকাশিত প্রতিবেদনেও স্বীকৃতি না পাওয়া ওইসব মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি পেতে চান। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বিদিরপুর গ্রামের মৃত হাজি সোলেমন সরকারের ছেলে নুরুল ইসলাম চার নম্বর ক্যাম্প লালগোলা ৭ নম্বর সেক্টর তরঙ্গপুর দিনাজপুর ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর রাজশাহীর গোদাগাড়ী তানোর, পবা, বোয়ালিয়া ও মোহনপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাক বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুুদ্ধে অংশ নেন। রণাঙ্গনের সৈনিক নুরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে লাল বার্তা গেজেট (নং ০৩০২০৯০১৫৩) অন্তর্ভুক্ত হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি এখনো। বয়সের ভারে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শয্যাশায়ী হয়ে বাড়িতে রয়েছেন। অর্ধাহারে-অনাহারে জীবনযাপন করলেও মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ভাতা পাওয়া থেকে বঞ্চিত। এই মুক্তিযোদ্ধা কোথাও থেকে কোন অর্থ সাহায্য পাননি। অসহায় এই মুক্তিযোদ্ধা তার ভাতা চালুর দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে।
এ প্রসঙ্গে গোদাগাড়ী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অশোক কুমার চৌধুরী বলেন, নুরুল ইসলামের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাগজপত্র থাকলে অবশ্যই সে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাবে। এজন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের আবেদন করতে হবে নুরুল ইসলামকে। এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ নেওয়াজ বলেন, নুরুল ইসলামের আবেদন যাচাই বাচায়ের জন্য তার দপ্তরে আসামাত্রই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে।
স্বীকৃতি পান নি তানোরে পাকবাহিনীর ক্যাম্প রেকি করে তাদের অবস্থান মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহকারী নওশের উদ্দিন। এইজন্য বেশ কয়েকবার তার বাড়িতে আক্রমণ করে রাজাকার বাহিনী। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান তিনি। জীবনবাজি রেখে এই কাজ করতেন তিনি। তবুও স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান নি নওশের উদ্দিন। নওশেরের বাড়ি তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের কচুয়া দক্ষিণপাড়া গ্রামে। তিনি মরহুম আমিরুদ্দিনের ছেলে। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল ওয়াহাব জানান, নওশের উদ্দিন একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিনেও তার নাম তালিকাভুক্ত হয় নি।
মোহাম্মদ মখলেছুর রহমান ৬৩ বছর বয়সে সংসার জীবনে পরাজিত এক সৈনিক। পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে স্বীকৃতি না পাওয়া এক অসহায় মুক্তিযোদ্ধা। শেষ জীবনে হলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চান। মখলেছুর রহমান ৭ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ওসমান গণির নেতৃত্বে কুষ্টিয়া, যশোর, বেনাপোলসহ বিভিন্ন জায়গায় বীরত্বের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে বাঘা উপজেলার আড়ানী মোমিনপুর গ্রামে বসবাস করছেন। এই গ্রামেই জরাজীর্ণ কুুঁড়েঘরে স্ত্রী নিয়ে বসবাস করছেন।
দুর্গাপুরের কিশোরীপুর ক্যাম্প থেকে জীবনবাজি রেখে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পাননি মুক্তিযোদ্ধা দুদু। তার পুরো নাম আশরাফুল হক দুদু। তিনি ‘স্যার’ হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত।
নওগাঁর নিয়ামতপুর থানায় গেরিলা হামলা চালিয়ে রাজাকার হত্যা করেছেন ভবেন চন্দ্র সরকার। ছিনিয়ে নিয়েছেন থানার অস্ত্র ও গুলি। এরকম একাধিক গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪৫ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান নি গেরিলাযোদ্ধা ভবেন চন্দ্র সরকার। তার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ১৯৮৭। তিনি মান্দা উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের মৃত রুহিনী কান্ত সরকারের ছেলে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আফসার আলী মন্ডল জানান, ভবেন চন্দ্র সরকার একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ দিনেও তার নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভবেন সরকারের নাম তালিকাভুক্তির দাবি জানান তিনি।
নগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুল মানান বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হলেও কেন এতদিন তালিকায় নাম আসেনি। কেন তারা যোগাযোগ করেন নি। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আবেদন করলে অবশ্যই তালিকাভুক্ত হবে।
‘মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের’ বিষয়ে তিনি বলেন, যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়টি অনেক জটিল। এটা ঠিক যে, বিভিন্নভাবে বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়ে আছে। তারপরও বিষয়টি অনেক জটিল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ও কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল যৌথভাবে যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি করবে। কীভাবে করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। যাদের বাদ দেয়া হবে তারাই বা শুনবে কেন ? এতবছর ধরে ভাতা পেয়ে আসছে বাদ দিলে তারা তা মেনে নেবে কেন? তারপরও যাচাই-বাছাই হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। সম্ভাব্য তারিখের বিষয়ে তিনি বলেন, পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। এখনো পর্যন্ত লিখিত কোনো নির্দেশনা পাই নি।
জেলা কমান্ডার ফরহাদ আলী মিয়া বলেন, স্বাধীনতার বহু বছর পার হয়ে গেলেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করা উচিত। যাচাই-বাছাই মানেই হচ্ছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রাখা। কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়ে গেলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে অন্তুর্ভুক্ত করা। যেসব মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পান নি তারাও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহকারে আবেদন করলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।