সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৭ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সামসুল ইসলাম টুকু
বেশ দেরিতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারই এই শক্ত সিদ্ধান্তটি নিয়েছে বলে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করতে চাই না। সিদ্ধান্তটি হলো- ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্বেচ্ছায় সনদ বাতিল করে সরে যাওয়ার শর্তে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণ। তবে সিদ্ধান্তটি আংশিক, সামগ্রিক নয়।
শহীদ বিদ্ধিজীবী দিবস ও মহান বিজয় দিবস এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম এ তথ্য জানান। উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন এবং সুবিধা নিচ্ছেন তারা জাতির সাথে প্রতারণা করছেন। এটা বড় অপরাধ। তারা এখনই চলে যান, তাহলে হয়তো ক্ষমা পেতেও পারেন। অন্যথায় তাদের প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে। ১২ বছর ৬ মাস বয়সি ২ হাজার ১১১ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ ইতোমধ্যে বাতিলের পর আদালতে মামলা চলছে। তবে আদালতের রায়ের পর তাদের সনদ বাতিল বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং তখন তাদের বিরুদ্ধে সাজার ব্যবস্থাও করা হবে। উপদেষ্টা আরও বলেন, নীল তালিকা, লাল তালিকা, ভারতীয় তালিকাসহ অনেক তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনুরাগের বসে, আত্মীয়তার সুবাদে, অন্য কোনো প্রলোভনে বহু মানুষকে মুক্তিযোদ্ধা করা হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে সময় লাগবে।
এই সময় লাগার ব্যাপারটি বহুদিন ধরে শুনে আসছি। এ সময়টা কতদিন, কত বছর তার কোনো ঠিকানা দেয়নি কেউ। কারণ, বড় বড় সাবেক ও বর্তমান আমলা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে চাকরি করেছেন, নিয়মিত ভাঁতা নিয়েছেন। ধরাও পড়েছেন কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এখনো তেমনটা হবে বলেই ধারণা করা যায় । এই ধারণা কি উপদেষ্টা ভাঙ্গতে পারবেন ? যতদ্রুত পারবেন ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে।
আমরা জানি, ১৯৭১ সালে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তথা জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদপত্র প্রাপ্ত ও ভারতের বিভিন্ন রণাঙ্গনে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ হাজার। যা ভারতীয় তালিকা ভুক্তও বটে। যারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছেন তারাই মূলত ‘এফএফ’ নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ শেষেও তারা ছিল একটি সংগঠিত শক্তি। যাকে ক্ষমতাসীন সরকারেরা ব্যবহার করতে চেয়েছে এবং সম্মান জানানোর নামে রাজনীতি করেছে। টাকা দিয়ে, ভাতা দিয়ে তাদের কিনতে চেয়েছে, অনুগত রাখতে চেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তো ভাতার দাবী করেনি, দাবী করেছিল সম্মান। কিন্তু দেওয়া হলো টাকা। ভেঙ্গে দেওয়া হলো তাদের নৈতিকতা, চরিত্র হনন শুরু হলো। ক্ষমতাসীন সরকারগুলো তাদের এ রাজনীতিকে এ পর্যায়ে সীমিত রাখলে ভালো হতো।
কিন্তু তা না করে তাদের ইচ্ছেমত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়াতে থাকলো। মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, তার সাহায্যকারী, ইয়থ ক্যাম্পের গার্ড চৌকিদার সহ বিভিন্ন নামে এবং বিশেষত রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করতে থাকে। তারপরে রাজনৈতিক বিভাজন করা হলো। এরফলে বর্তমানে এর সংখ্যা হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার। এটা গোটা জাতির কাছে অনভিপ্রেত এবং এ সমালোচনা আজও অব্যাহত আছে। এখানেও থেমে থাকেনি তারা, মুক্তিযোদ্ধদের সন্তান এমনকি নাতি পুতিদেরও ভাঁতার অংশীদার এবং কোটায় চাকরি নিশ্চিত করলো। যা জাতীর সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করলো। এতে যেমন রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তেমনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হারিয়ে গেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভীড়ে।
শুধু তাই নয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ও বলতে পারবে না কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর কে নয়। ধোঁয়ায় অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও কাজটি কঠিন নয়,। দেশের প্রতিটি গ্রামে ও ইউনিয়নে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করেই তা সম্ভব। যা এখনই করতে হবে। কারণ, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগই গত ৫৩ বছরে মারা গেছেন। অন্যদিকে দেশে থেকে যারা পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের বলি হয়েছেন- তাদের রীতিমত অপমান করা হয়েছে। এটা বন্ধ করা অতীব জরুরি।এতে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি বন্ধ হবে, রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি বন্ধ হবেÑ তেমনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় নামক আজব মন্ত্রণালয় এবং এর জন্য অহেতুক খরচ বন্ধ হবে ।
উপরে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার হয়- তবে বাকি ২ লাখ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই। এছাড়া যারা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকরি করেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। বিশেষত খুনি অহেদুজ্জামান মোল্লাহসহ যারা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন জাতির সাথে প্রতারণা করেছেন, তাদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা অতি আবশ্যক। সেক্ষত্রেও সরকারগুলো নিরব থেকেছে। গত ২০ বছরে এদের পেছনে শুধু ভাতা বাবদ কত ব্যয় হয়েছে তা দেখা যাক।
ঋূয়া মুক্তিযোদ্ধা ২,০০,০০০দ্ধ গড় ভাঁতা ১০,০০০ দ্ধ ২৪০ মাস=৪৮০০০,০০,০০,০০০ বা ৪৮ হাজার কোটি টাকা। সেইসাথে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের খরচতো আছেই। এদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যদি ৭০ হাজার ধরা হয় তাদের অধিকাংশই মারা গেছেন। তাদের ছেলে মেয়েরা হয়তো চাকরি করে অথবা স্বচ্ছল। তারা ভাঁতাও নিবে আবার কোটা তে চাকরিও নিবে তা হয় না। তাহলে সে সময়ের ৭ কোটি মানুষকে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে নিদেনপক্ষে তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ৩০ লাখ শহীদ পরিবার ও ২ লাখ ইজ্জতদানকারী মা বোনের পরিবারকে কেন ভাঁতা দেওয়া হবে না? এতদিন দেওয়া হয়নি কেন? দরদটা উদ্দেশ্যমূলক হলে চলবে না। বরং দেখতে হবে, প্রকৃত অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা কতজন আছে- তাদের ভাঁতা দেওয়া যেতে পারে। অন্যথায়, জনগণের টাকার অপব্যবহার চলতে পাওে না। এর অবসান জরুরি। এটাই অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম কাজ হবে বলে মনে করি। এই রাজনৈতিক অস্ত্র আর ব্যবহার করতে দেওয়া যায় না। কিন্তু এই মন্ত্রণালয়ের সমাপ্তি না টেনে একে সম্প্রসারিত করার জন্য সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অধীনে জুলাই গণঅভুত্থান অধিদপ্তর করা হবে। এতে জুলাই গণঅভুত্থানের শহীদদের প্রকৃত সম্মান জানানো হবে, না জাতির উপর আর একটি বোঝা চাপানো হবে তা ভেবে দেখতে বলবো অন্তর্বর্তী সরকারকে ।
লেখক: সাংবাদিক