মুক্তিযোদ্বা মিন্টু ভাতা টাকা ব্যয় করেন অনাথের সাহায্যে

আপডেট: ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬, ১২:০২ পূর্বাহ্ণ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন



সার্টিফিকেট অনুযায়ী  নাম মিহাজ উদ্দিন, ডাক নাম মিন্টু। তবে রাজশাহীর মানুষ তাকে পুষ্প মিন্টু হিসাবেই বেশি চেনে। চির কুমার মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু রাজশাহী মহানগরীর নিউমাকের্টের পুষ্প  স্টুডিওর মালিক। পুষ্প স্টুডিওটা রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিক কর্মী ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদের আড্ডাস্থল হিসাবে বহুদিন যাবৎ পরিচিত। এই স্টুডিওটি পুষ্প আড্ডা হিসাবে খ্যাতি পেয়েছে। মিনহাজ উদ্দিন মিন্টুর জন্ম ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি, সেই সময়কার রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠ ছোট বনগ্রামে (বর্তমানে ছোটবনগ্রাম সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা)। তার বাবার নাম সামসুদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন কৃষক। তিনি বেড়ে উঠেন প্রগতিশীল ধারা রাজনৈতিক পরিবেশে। তার বড় ভাই হায়দার আলী ছিলেন শহিদ জাতীয় চার নেতার অন্যতম কামারুজ্জামান সাহেবের একজন সক্রিয় কর্মী। বড় ভাই হায়দার আলীর সংষ্পর্শে এসে মিনহাজ উদ্দিন  মিন্টু পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন। ১৯৬২ ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে তাকে দেখা যেত। তখন তার বয়স হবে ১১ বছর। পাকিস্তানের শিক্ষা কমিশনে শিক্ষানীতি এবং ৬৬ ছয়দফা আন্দোলনসহ পাকিস্তান বিরোধী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের মিছিলে মিন্টু ছিলেন টোকাই। তার পারিবারিক ও তৎকালীন দেশের রাজনৈতিক আর্থসামাজিক  প্রেক্ষাপটের কারণে তিনি মাধ্যমিকের গ-ি পেরুতে পারেননি। অল্প বয়সেই তিনি বামপন্থি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। তার একাডেমিক শিক্ষার পরিধি না তাকলেও  বাঙালির ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ের উপর রয়েছে তার অগাধ জ্ঞান। অসাধারণ স্মরণ শক্তি তাই তিনি এখন ইতিহাসের সাক্ষি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তান বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের  বিষয়গুলি নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা তার কাজ থেকে নানা তথ্য নিয়ে থাকেন।
মিন্টু জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তারা সশস্ত্র হয়ে পাক শাসন বিরোধী সংগ্রামে সংগঠিত হওয়ার জন্য উদ্যোগী হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন পাক সেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিরস্ত্র পুলিশ সদস্যদের উপর হামলা চালায় তার প্রতিবাদে জ্বলে উঠে বাংলাদেশ। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সাধারণ কর্মী। পাক সেনাদের চলাচল এবং জীবনযাত্রা অচল করে দেয়ার জন্য তারা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মিনহাজউদ্দিন মিন্টু বড় ভাই হায়দার আলীর সাথে রাজশাহী সেনানিবাসের পানির সরবরাহের লাইন কেটে দিয়েছিল সেই সময়। পাক সেনাস্থল রাজশাহী সেনানিবাস পানি শুন্য হয়ে পড়ে। বড় ভাই হায়দার এবং বেশ  কজনকে সাথে নিয়ে মিনহাজউদ্দিন মিন্টু সেনানিবাসের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তখন মিনহাজ উদ্দিন মিন্টুর কোন সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না, তবে তিনি এটা অনুধাবন করেছিলেন পাক হায়েনাদের প্রতিহত করতে হবে যে কোন ভাবে। তাই  তিনি জীবন বাজি রেখেই লড়েছিলেন পাকসেনাদের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের জুন জুলাইয়ের দিকের ঘটনা। তিনি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় টর্চার সেলে। পাক সেনারা তার শরীরের উপর চালায় অমানুষিক নির্যাতন। ওই সময় তাকে পাক সেনারা বেলপুকুরিয়ার দিকে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিনিয়ে দেয়ার জন্য। তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেনাদের খোলা জিপে করে। জিপটি যখন বেলপুকুরিয়ার খালের ব্রিজটি  পার হবে ঠিক এই সময় তিনি জীবনাবাজি রেখে জিপ থেকে লাফিয়ে পড়েন খালের পানিতে। জিপটি ছিল গতিসম্পন্নÑ তাই কিছু দূরে গিয়ে থামতে হয়। খালটির দুপাশে ছিল আখখেত যা অনেকটা গভীর বনের মতো। আর এই সময়টুকুর মধ্যে তিনি খালের পাশের আখখেতে লুকিয়ে পড়েন। তবে তিনি সেই সময় এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, মৃত্যুর যমদূত তার পেছনে ধাওয়া করছে। ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু। তিনি এমনভাবে লুকিয়ে পড়েছিলেন যে, পাক সেনারা অনেক খোঁজাখুজি করেও তাকে ধরতে পারেনি। অসুস্থ শরীর নিয়ে আখখেতের মধ্যে দিয়ে মধ্যরাতের দিকে তিনি পৌঁছেন নওহাটায়। তার সমবয়সী অনেকের ধারণা পাক সেনাদের অমানুষিক নির্যাতনে তার শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল যার জন্য তিনি বিয়ে করেননি। এই ঘটনার পর তিনি রাজশাহী থেকে চলে যান। মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর  সদস্য হিসাবে আসামের তেজপুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে রংপুর অঞ্চলে বাকি সময়টা যুদ্ধ করেন। তিনি ওই সময় রংপুরের মানুষের সাথে এতটাই মিশে গিয়েছিলেন যে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বেশ কিছু বছর তিনি রংপুরে কাটান। তার নাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ছিল না দীর্ঘ দিন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে বিজয় অর্জন করে।  আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সরকার। আর এই সরকার  যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয় । আওয়ামী লীগ জাতির দায়মুক্তির কাজ শুরু করে দেয়। ৭১ এর মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনে। সেই সাথে আওয়ামী লীগ সরকার ইতিহাসের আরেকটি বিষয়কে স্বীকৃতি দেয় তা হলোÑ ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ননের ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ গেরিলাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় গেজেটভুক্ত করা। সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন তারিখ ৭ শ্রাবণ/১৪২০ বাংলা ২২ জুলাই/২০১৩, নং ৪৮.০০.০০০০.০০৪.৩৭.১৪৯ ২০১৩-৪৩৯ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০০২(২০০২ সালের ৮ নং আইন) এর ৭(ঝ) ধারা অনুযায়ী ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা বাহিনী এবং এই বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধাদের ২৩৬৭ জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সরকার রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ এর সিডিউল-১ (এলোকেশান অফ বিজনেস) এর তালিকা ৪১ এর ৬ নং ক্রমিকের ক্ষমতা বলে তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে। বিজয়ের ৪২ বছর পর একটি বাহিনী রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। সেই সাথে স্বীকৃতি মেলে মুক্তিযোদ্ধা মিনহাজউদ্দিন মিন্টুর। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভাতা পেতে থাকেন। যদিও ভাতা পাওয়ার আগে থেকেই তিনি হতদরিদ্রদের সাহায্যে করতেন। তবে ভাতার অর্থ পাওয়ায় তিনি তার অসহায়দের সাহায্যের কাজের পরিধিটা বাড়িয়ে দেন। বর্তমানে তার প্রাপ্ত ভাতা কিছু অনাথের জীবন নির্বাহের একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট বনগ্রামের পক্ষাঘাতগ্রস্ত জেন্টুর সংসার চলে তার সাহায্যে। এই জেন্টু সারা মাসের ওষুধের ব্যয়ভার তিনি বহন করেন। অ্যানি নামে একটি হতদরিদ্র মেয়ের পড়াশুনা চলে তার অর্থ দিয়ে। তার সহযোগিতায় মেয়েটি জাতীয় বিশ্ববদ্যালয়ের অধীনে রাজশাহীর মাদার বখশ গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজের সম্মান শেষ করে মাস্টার্সে পড়ছে। রাজশাহী মহানগরীর অদূরে কোপেরহাট এতিমখানার শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিমাসে তিন রিম কাগজ, চার ডজন বলপেন সহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণাদি কিনে দেন। পঙ্গু হালিমকে তিনি প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দেড়শ টাকা করে সাহায্য করেন। হালিম হুইল চেয়ারে বসে ভিক্ষা করে। হালিমের নাতনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। এই মেযেটির সারা বছরের শিক্ষা উপকরণ মিন্টু কিনে দেন। তিনি প্রতি মাসে যে পরিমাণে দরিদ্রদের সাহায্য তা হিসাব করলে দেখা যায়, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যে পরিমাণ ভাতা পান তার চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া প্রতিমাসেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলিকে তিনি চাঁদা দিয়ে থাকেন। তিনি যে বাড়িটিতে থাকেন তা জেন্টু ও তার সন্তাানদের নামে উইল করে দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্বাসী মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু মনে করেন, এদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়িত হলে কোন দরিদ্র থাকবে না। তখন আর এদেশের কোন মানুষের প্রয়োজন হবে না কারো সাহায্যের। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ’৭১ এর মানবতা বিরোধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছে। তার নেতৃত্বে এদেশ ক্ষুধা এবং দারিদ্রমুক্ত হবে সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে উঠবে।
লেখক:- কলামিস্ট