মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
আব্দুল আলীম
পাখির ডাক কার না ভালো লাগে। তারা আবারিত প্রকৃতি আশ্রিত ভালোবাসার একটি প্রাণী। যখন যা মন চাই, যেখানে ইচ্ছে উড়ে যেতে পারে। কোথাও উড়ে যেতে তাদের বারণ নেই। কখনো আবার গাছের মগ ডালে বসে গান গাইতে মন চাইলে তা তার অনায়াসে করতে পারে। খিদে পেলে প্রকৃতির সবুজে কিংবা জলাধারে একান্তে নিভৃতে হিজোল গাছের তলে- বকুল গাছের তলে- শিউলি গাছে তলে, আম বাগানে, বাঁশ বাগানে, খোলা জায়গায় বিচরণ করে করে খাবার জোগাড় করতে পারে।
কাউকে দেখে তারা তেমন ভয় পায় না, তারা ঘোড়ার পিঠে বসে, ষাড়ের পিঠে বসে, গরুর পিঠে বসে, ছাগলের পাশে বসে, মুরগির পাশে বসে, মোরগের পাশে বসে, সর্বপরি তারা স্বাধীন ভাবেই বিচরণ করে। তারা ভয় পায় শুধু মানুষকে। মানুষ কাছে গেলেই তারা ফুরুত করে উড়ে গাছের ডালে গিয়ে বসে। তাদের কোন সীমানা নাই, তাদের কোন এলাকা নাই, তাদের কোন বাধার প্রাচীর নাই। তাদের সভা সেমিনারের প্রয়োজন হয় না, উচ্চ স্বরের বার্তার প্রয়োজন পড়ে না, স্কুল নাই, কলেজ নাই, ট্রেনিং সেন্টার নাই, ব্যাংক নাই, বীমা নাই, খাদ্য রাখার গুদাম নাই, তবু তারা গান গেয়ে গেয়ে মানুষের ঘুম ভাঙায়। আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই একটি ঘুঘু’র ডাক কানে এলো। ঘু-ঘু ঘু-ঘু করে ডাকছে। কি জন্য ডাকছে জানি না। সুখে ডাকছে, -না কি দুঃখে ডাকছে, না কি প্রিয়সঙ্গীকে খুঁজছে কেইবা জানে! তবু অনেকক্ষণ ধরেই ডাকা-ডাকি করছে। ঘুম থেকে জাগতেই মনে পড়ে গেল সেই ঘুঘুটার কথা।
অনেক দিন আগের কথা, তখন বয়স বারো অথবা তেরো বৎসর হবে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু, গাছে-গাছে আম গুটি থেকে পরিণত প্রায়। এরই মধ্যে একটা প্রলংকারী ঝড় সহ শিলা বৃষ্টি হয়ে গেল। বাগন জুড়ে যত্রতত্র শুধু আম আর আম। কোনটা রেখে কোনটা নিই। ধূসর মাটির ওপর মনে হয় তখন সবুজ আমের আস্তরণ পড়েছে। বৈশাখের ঝড় মানেই আম আর আম মানেই আমি বস্তা নিয়ে প্রস্তুত। তখন বস্তা ভর্তি আম মাথায় করে ঘরে ফিরছি। বাগানের এক পার্শ্বে দেখি ডানা ভাঙা একটা ঘুঘু পাখি মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। অবশ্য আমাকে দেখেই সে নিজেকে লুকানো কিংবা আড়াল করে বাঁচার চেষ্টা করছে কি না জানি না। শুধু এতোটুকু বুঝেছি, ও আতংকিত। নিজেকে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে একটা বড় স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলতে চায় ও। আমাকে দেখেই সে লুকানো কিংবা পালানোর চেষ্টা খুব সহজেই করতে পারছে তা না।
তবু তার চেষ্টা প্রাণপণ। তখন আমার কিশোর মন দৌড়ে ঘুঘুটাকে ধরে ফেলল। অন্য কোন বাধ-বিচার ছাড়াই এমনটা করলাম। তারপর তাকে সবার অলক্ষ্যে সোজা বাড়িতে নিয়ে এলাম। তখনো তার কষ্টের কথা কিছুই ভাবলাম না। না সুস্থ করা, না চিকিৎসা করা, কিছুই না। তখন শুধুই মনে হলো একটা ঘুঘু পাখি কুড়িয়ে পেয়েছি। দেরি না করে তার একটা জবরদস্ত ব্যবস্থা করা দরকার। লবণ, মরিচ, তেল, মশলা, আগুন সব কিছুই ঘরে, হাতের কাছে মজুদ আছে। আর এদিকটাই মাও তেমন একটা নজর দিবেন না। কিন্তু দেখি পাখিটা ভরে থরথর কাঁপছে। ওর গায়ে হাত দিতেই ও কেমন কোঁকিয়ে উঠছে। নিজেকে জড়সড় করে বাঁচার যে আকুতি তার বার্তা, তার ভাঙা ডানা, শরীর থেকে আসছে। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণের এই অভিন্ন আকুতির কাছে হয়তো সকল নিষ্ঠুরতা নত হয়।
আমি নিজের সঙ্গে নিজেই অনেকক্ষণ যুদ্ধ করলাম। শেষে পরাজিত হলাম তার কাছে। যে প্রাণের আনন্দ ছড়াই, গান গাই, সুরের তালে তালে প্রকৃতিকে দোলায়, সে তো নিঃশেষ হতে পারে না, সে পারে না হারিয়ে যেতে এই মায়াময় সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে। তার বেঁচে থাকার অধিকার, সে তো আমরাই রক্ষা করি। আর আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে তারা। এতো উপকারের পরেই দুষ্টু মন কখনো কখনো পাখিদের আঘাত করেই বসে অথবা ভারসাম্য হারিয়ে পাখিরা কখনো কখনো নিজেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আমরা তাদের পাশে তাই ভুল বুঝে ওরা আমাদের দেখে পালায়। আমাদের দেখে পালানোর তৎপরতা আমাদেরই হতভম্ব করে। তাহলে এবার আসি আমাদের কথায়। মানুষকে দেখে পালানোর শিক্ষাটা ওরা কখন পায় ? কে তাদের শেখায় ? না কি জন্মগতভাবেই তারা এটা পায় ? এমন প্রশ্ন অনেক সময়ই মাথার মধ্যে ঘুরপাক তুলে আবার থেমে যায়। আসলে ওরা গৃহপালিত পরিবেশের অভাব আর মুক্ত চলার চঞ্চলতায় বিভোর থাকে। ওদের কেউ কিছু শিখিয়ে দেয় আর না দেয়, মানুষ যে ওদের আতংকের খোরাক এটা খুব সহজেই বুঝে যায়। মানুষ সুযোগ পেলেই ওদের বিরক্ত করে, আঘাত করে এমন কি বন্দি করার গোপন ফাঁদ পাততেও দ্বিধাবোধ করে না। তারা মানুষ দেখলেই পালিয়ে যায়, মানুষ থেকে অনেক দূরে থাকতে চায়।
তাদের স্বাধীন উড়–ক্কুতার অবতলে তার কেবল চায় শান্তির সুবাতাস। সবুজের অপরূপ সমারোহ। ফুল-ফসলের অবাধ্যতা। মানুষ, অবলীলায় সেসব মাড়িয়ে, নিধন করে নির্মাণ করে চলেছে দম্ভের অট্টালিকা, কংক্রিটের অবকাঠামো। জড়জীবনের সাথে বাহ্যিক বাহুল্যতার বহতাকে বড় মনে করে যে ঠাঁটই-যাপন আমরা আয়ত্ত করার দৌড়ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখি তা নিছকই ঠুনকো। মানবিকতার সবকসূত্রে সন্তরণ ভুলে সাথীহারা নিঃসঙ্গতা আপন করে আমরা গর্বিত হই। হীরে ফেলে কাঁচকেই আপন করে তুলি। যখন ভুল ভেঙে যায় তখন দেখা যায় অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে যাওয়ার পথ তখন অনেক দীর্ঘ। পাখিদের ছায়া অনেক দূরে। অনন্ত মোহমায়ায় মত্ত জীবনের বিপরীতে আরশীতে চোখ রাখলে নিজের বন্দিত্ব আর অসহায়ত্ব ফুটে উঠে বিস্তর।
আমি যাকে দুর্বল ভেবে, আহত ভেবে, আমার পেষণপিষ্ট করছি মূলত তার পদতলে আমরাও প্রতিচ্ছবি জেগে আছে। আমিও বন্দি কোনো এক মায়া জালে। চারপাশে নিঝুম অন্ধকার। যারা আলো নিয়ে ঘুরে পথে পথে, বলে, মুক্তির বাণী। তাদের থেকে নিজেকে অনেক দূরে রাখি। না বুঝেই ছুঁড়ি ঢিল উর্ধ্বে। পাখি দেখে প্রেমে পড়ে যায় তার। ভালোবাসার যত আয়োজন তা সাজিয়ে ধরি তার সামনে। উড়তে চায় পাখির সাথে, দূর দেশ থেকে দূর দেশে। তারপরই ভয় এসে বাসাবাঁধে মনে যখন ভাবি, উড়তে উড়তে একদিন পৃথিবীর সীমনা ছাড়িয়ে যদি উড়ে যায় অজানায়! অন্যের কষ্ট-ব্যথা অনুভব করার অনুভূতিগুলো যখন জ¦রে জীর্ণ, উত্তাপে বিলয় তখন সাধনার সরলরেখাগুলো ক্রমেই বক্র হতে থাকে। পল্লবিত গাছের শাখা হতে থাকে বিরান মরুর মত। পাখিরা যাবে কোথায় ! কোনো ঠাঁই নাই। যেদিকে তাকায় সেদিকেই শূন্যতা আর শূন্যতা। মানুষ, নিজেই নিজেকে পতিত করে ভেঙেছে অন্যের আবাস। তবু বোধের বোধিতে শান্তির জল আসে না। আসে না সুস্থতার পরিমল।
ঘুঘুটার বাসায় তার ছোট ছোট ছানা ছিলো কিনা জানি না। কিংবা নীড়ে তা দেওয়ার মত নিষিক্ত ডিম ছিলো কি না জানি না। এই ব্যাপারগুলো একটিবারের জন্যও খোঁজ করি নি, ভেবে দেখি নি, মনে আসে নি, কষ্ট লাগে নি, মনে ব্যথা পাই নি। তা যে ধ্বংস করছি তার চলমানতা তা একবারের জন্যও মনে হয় নি। পাখিটা ঘু ঘু করে ডাকতো, দাপিয়ে বেড়াতো বন-বাদাড় আবার খুব নির্জনে কোনো ডালের আড়ালে যে সুখের নীড় রচনা করেছিলো, সে কথাও একবার ভাবি নি। তার কত পরিশ্রমে গড়া নীড়, চঞ্চুতে বয়ে আনা একেকটি খড়কুটো কত স্বপ্নে সাথে মিশে ছিলো তার কথাও একবার ভাবি নি। একবারও মনে আসে নি, ও একটু শ্রশ্রুষা পেলে আবার ফিরে পেতে পারে ডানা মেলার খোলা আকাশ। সে কথা মনে আসে নি। শুধুই তার ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে, আমার কাছে সে পোষ মানবে, এমন ভাবাতেই খুঁজে নিয়েছি অনেক আনন্দ। আনন্দেরও একটা বেদন আছে। সব আনন্দই আনন্দ হয় না। অনেক দিন পরেও আনন্দ পাওয়া যেত যদি ডানা ভাঙা ঘুঘুটা সুস্থ করে আঁকাশে উড়িয়ে দিতে পারতাম। তার ছানার কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম।
হয়তো তা দেওয়া ডিমগুলো এখনো সে উষ্ণতা পাবার অপেক্ষা করে আছে। সে ব্যবস্থা না করে দেওয়ার অক্ষমতা কেন জানি না এখন আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায়। আমার হাতেই আছে সুস্থতার চাবি, বদলে দেওয়ার বর্ণিল রং। দিতে পারতাম। কেন দিই নি, দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত! না দিয়েই কি খুব ভালো আছি? এইতো হাজার প্রশ্নের বানে নিজেই এখন জর্জরিত। তাকে তার প্রকৃতি পরিবেশে উন্মুক্ত করে দিতে পারার আনন্দ এখন আমার করায়ত্ত। ওই তো পাখি এখন মুক্ত। মুক্তির মিথ্যে ছলনা না, বাস্তবে আমার হাতে পাখি পেল মুক্তির অমূল্য স্বাদ।
সময়: রাত্রি ৯টা ৫০ মিঃ
হেতেমখাঁ, রাজশাহী।