মৃত্যু দিয়েই জন্ম যাদের! রাজশাহী বিভাগে গত ৫ বছরে দুঃসহ যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন ১২৮৮ জন মা

আপডেট: ডিসেম্বর ৩, ২০২৪, ১০:১৯ অপরাহ্ণ

মাহাবুল ইসলাম


সন্তান। প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। ১০ মাস গর্ভধারণের পর পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়ে থাকে সন্তান। সাত মাস ধরে মায়ের গর্ভে এ শিশুদের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি হয়, হৃৎস্পন্দন শুরু হয়, গর্ভধারিণী মা এদের নড়াচড়া নিয়মিত টেরও পান।

তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, নিভৃত আদরে হয়তো গুনগুনিয়ে গানও শুনিয়ে থাকেন। কিন্তু এতো স্বপ্ন ও সাধনার ফল অনেকের জন্যই শুভকর হয় না। যদি মৃত সন্তান প্রসব হয়, তা হয়ে থাকে অসহনীয় কষ্টের। মৃত সন্তান প্রসবের অসহনীয় কষ্ট ছাপিয়ে অসহায় মা পড়েন পারিবারিক-সামাজিক নিষ্ঠুর বিড়ম্বনায়। একটি পরিবারে যখন কোনো মৃত শিশুর জন্ম হয়, তখন মা এবং পরিবারের সবার মধ্যে দুঃসহ মানসিক চাপ তৈরি হয়। রাজশাহী বিভাগে গত ৫ বছরে এই দুঃসহ যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ২৮৮ জন মা। যাদের সন্তানের জন্ম হয়েছে মৃত্যু দিয়ে!

রাজশাহী বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের তথ্যমতে, রাজশাহী বিভাগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মৃত শিশু প্রসব হয়েছে ৩৩৮ টি। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৯৪ জন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২০০ জন, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ২৬৭ জন এবং ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ২৮৫ জন মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে। মৃত শিশুর জন্ম সবচেয়ে বেশি সিরাজগঞ্জ জেলায়। গত ৫ বছরে এ জেলাতেই ৫৯৬ জন মৃত শিশুর জন্ম হয়। যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৪৬ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমরা সচেতন ও সতর্ক হলেই অনেকাংশেই গর্ভাবস্তায় শিশু মৃত্যু কমানো যাবে। গর্ভাবস্থায় মা যদি সংক্রমণে আক্রান্ত হন, কিংবা তার যদি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ-জাতীয় অসুস্থতা থাকে, মা যদি অপুষ্টিতে ভোগেন, তার যদি ঝুঁকিপূর্ণ জীবনাচরণ থাকে, কিংবা প্রসব প্রক্রিয়ার সময় যদি কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে মৃত শিশুর জন্ম হতে পারে। অনেকের মধ্যেই এ ভুল ধারণা আছে যে মৃত শিশুর জন্ম মূলত অপ্রতিরোধযোগ্য জন্মগত ত্রুটির কারণে ঘটে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানের প্রশ্নে, মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতকরণের প্রশ্নে বিরাট ঘাটতি আছে দেশে। ব্যবস্থা নেওয়া তো পরের কথা, আমরা যে সুনির্দিষ্ট করে বলতেই পারছি না, স্টিল বার্থ প্রতিরোধে মানের যে সমস্যাটি ঠিক কোন জায়গায়, এটিই হচ্ছে ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক গলদ। যারা সমাজের উঁচু তলার মানুষ, কিংবা যারা সচেতন, অধিকার আদায় করে নিতে পারেন, সেই গুটিকয় মানুষ হয়তো পারছেন পয়সা খরচ করে ভালো চিকিৎসকের কাছে গর্ভকালীন সেবা নিতে। কিন্তু বাদবাকি সাধারণ মানুষ হয় সেবার আওতায় আসছেন না, অথবা সরকারি ও বেসরকারি সেবাকেন্দ্র বা ক্লিনিক থেকে নিম্ন বা অসম্পূর্ণ মানের সেবা নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন। কমিউনিটি ক্লিনিক বা ইউনিয়ন সেবাকেন্দ্রে যে গর্ভকালীন সেবা দেওয়া হয়, তার মান নিয়ন্ত্রণ বা সত্যিকার অর্থে কার্যকর জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ আমাদের গ্রামীণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এ কেন্দ্রগুলোর হওয়ার কথা ছিল ভরসার জায়গা।

এদিকে, মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুতে অস্বাভাবিক চিত্র উঠে আসছে সিরাজগঞ্জ জেলায়। সিরাজগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা উপ-পরিচালক মো. রায়হানুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে শিশু মৃত্যুর পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। যে সংখ্যা আসছে, এটা অস্বাভাবিক। এটা আমাদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা কাজ করছি মৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য।

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন বলেন, প্রতিটি শিশুর মৃত্যুই অনাকাক্সিক্ষত। শিশু মৃতুর যে চিত্র এটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে অন্য জেলাগুলোর তুলনায় এ জেলায় চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেশি। আমরা সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছি।

রাজশাহী বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের পরিচালক ড. কুস্তরী আমেনা কুইন বলেন, শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ, অপুষ্টি ও সচেতনতার অভাব। যে শিশুর জন্ম হচ্ছে মৃত্যু দিয়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব দম্পতিরা সচেতন নয়। তারা নিয়মিত চেকআপ করেন না। আমরা এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। নব দম্পতিকে বাচ্চা নেয়ার আগেই সেবা নেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হারকে একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অগ্রসরমাণতার সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু দেশে প্রতিবছর মায়ের গর্ভে ৭ মাস (২৮ সপ্তাহ) জীবিত থাকার পরও ৮৩ হাজারের বেশি শিশু জন্মায় মৃত অবস্থায়। মৃত শিশুর জন্মের সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ২৬ লাখ মৃত শিশুর জন্ম হয়। যার ৯৮ শতাংশই স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এবং ৭৫ শতাংশই সাবসাহারা আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ