শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
জলপাইগুড়িÍ নিজের মোটর সাইকেলকে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করে গত পনেরো বছরে কয়েকশো মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন তিনি। রোদ–ঝড়–বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতবিরেতেও চলছে তাঁর নিরলস এই অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা। গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার যে কোনও প্রান্ত থেকে ডাক পেলেই হল। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি ছুটে গেছেন সেখানে। রোগিকে মোটরবাইকের পেছনে বসিয়ে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন স্থানীয় অথবা জেলা হাসপাতালে। দিন কয়েকের মধ্যে তাঁকে সুস্থ করে ফের বাড়িতেও পৌঁছে দিয়েছেন কখনও কখনও। জলপাইগুড়ি জেলার মাল ব্লকের ক্রান্তি এলাকার স্বনামধন্য এই মানুষটির নাম করিমুল হক। বুধবার পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম ঘোষণা করল ভারত সরকার। তাঁকে এবার পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়া হচ্ছে জানতে পেরে দারুণ খুশি করিমুলবাবু। তবে ক্রান্তির রাজাডাঙা গ্রামপঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত ধলাবাড়ি গ্রামের এই মানুষটি পদ্মশ্রী পেয়ে নিজে যতটা খুশি তাঁর থেকেও যেন কয়েকশো গুণ বেশি খুশি গোটা জলপাইগুড়ি জেলার মানুষ। শুধু জলপাইগুড়িই নয় ডুয়ার্স–সহ গোটা উত্তরবঙ্গের মানুও আজ গর্ববোধ করছেন করিমুল হককে নিয়ে। কারণ, বছরের পর বছর ধরে মুমূর্ষু রোগিদের পরিষেবার জন্য তিনি যেভাবে নিজের কাজ করে চলেছেন তা কোনও সাধারণ মানুষের কাজ নয়। এ কথা গত কয়েক বছরে বেশ ভালভাবেই বুঝে গেছেন জলপাইগুড়ি–সহ গোটা ডুয়ার্স এলাকার মানুষ। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে কখনও হয়ত হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছেন তিনি, এমন সময় হয়ত ফের কোনও রোগিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাক পড়ল করিমুলবাবুর। খাওয়া ওভাবেই রেখে তিনি ওই রোগিকে নিয়ে ফের রওনা হয়ে যান হাসপাতালের দিকে। এমন ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে করিমুলবাবুর জীবনে। অনেক রাতের ঘুমও তার নষ্ট হয়েছে এই রোগি পরিষেবা দিতে গিয়ে। কিন্তু কখনওই তাঁকে মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে অনীহা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। করিমুল হক এমনই একজন মানুষ। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। সেবার শুধুমাত্র একটি অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি নিজের অসুস্থ মাকে। চোখের সামনেই বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে মরতে দেখেছেন মা জফুরান্নেসাকে। মায়ের এই অকালমৃত্যুর যন্ত্রণার কথা মন থেকে একেবারেই মুছে ফেলতে পারেননি করিমবাবু। তাদের মতো যে সব প্রত্যন্ত এলাকায় কোনও গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স নেই সেখানকার মানুষেরা কি তাহলে মায়ের মতো এভাবেই অকালমৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে? নিজের মনের মধ্যে থাকা এই প্রশ্নই তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল দিনরাত। তখনই তিনি শপথ নিয়েছিলেন চোখের সামনে বিনা চিকিৎসায় কাউকে কখনও মরতে দেবেন না। যেভাবেই হোক অন্তত রোগিকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন তিনি নিজেই। এরপর থেকে যখন যেখানে কোনও অসুস্থ রোগিকে দেখেছেন কখনও সাইকেলে, কখনও বা কোলে করে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এভাবেই কিছুদিন চলতে থাকে সুবর্ণপুর চা–বাগানে প্রহরীর কাজ করা করিমূল হকের জীবন। সামাজিক কাজে তাঁর এই উদ্যোগ দেখে অনেকেই রোগিদের হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার জন্য করিমুল হককে নিজের মোটর সাইকেল দিয়ে দিতেন ঘণ্টা কয়েকের জন্য। ধীরে ধীরে ধারদেনা করে নিজেই একটি মোটর সাইকেল কিনে নেন তিনি। মোটর সাইকেলের সামনে লিখে দেন বিনামূল্যের অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার দেয়ার কথা। তাঁর এই অসামান্য কাজের কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে জেলার গ-ি ছেড়ে বাইরের জগতেও। ইতোমধ্যেই রাজ্য ও দেশের অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। অবশেষে দীর্ঘ পনেরো বছর পর নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এবার পদ্মশ্রী পাচ্ছেন তিনি। করিমুলবাবু বলেন, বাবা লালুয়া মহম্মদ বিএলআরও দপ্তরে সামান্য কাজ করতেন। ছোটবেলায় তাঁরা এতটাই গরিব ছিলেন যে, কাঁচা কাঁঠাল ও কলা সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে তাঁদের। পড়াশোনার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, অভাবের জন্য বেশিরভাগ সময় মামার বাড়িতে কাটাতে হয়েছে। এক স্কুল থেকে আর এক স্কুল করে কোনওরকমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তারপর আর হয়ে ওঠেনি। নিজের এই পদ্মশ্রী সম্মান বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের তাঁর মতো কাজে এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন করিমুলবাবু। বলেন, নিজের পরিবেশ ও দেশকে সুস্থ রাখতে ও উজ্জ্বল করতে চাই আমি। আমার সঙ্গে আরও অনেকে যদি এভাবে এগিয়ে এসে কাজ করে তাহলে আমাদের সমাজ আরও অনেক অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে।- আজকাল