শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
মোহনপুর পৌর ও মান্দা প্রতিনিধি
নওগাঁর মান্দা উপজেলার বন্যার পানিতে প্লঅবিত এলাকার দৃশ্য-সোনার দেশ
গত তিন দিনের একটানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে রাজশাহীর মোহনপুর ও নওগাঁর মান্দায় বেড়ি বাঁধ ভেঙে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসলসহ ঘরবাড়ি প্লাবিতে হয়ে গেছে। মোহনপুর উপজেলার ভীবনগর নামক স্থানে শিবনদীর একটি এবং মান্দার আত্রাই ও শিব নদের দুইটি বেড়ি বাঁধ ভেঙে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৬ ঘণ্টায় আত্রাই নদীর পানি বেড়ে এখন বিপদসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ঘটনায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন শতাধিক পরিবার।
সরেজমিনে মোহনপুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিবনদীর বেড়ি বাঁধের সুইস গেট দিয়ে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে বিশ্বজিৎ নামের জনৈক এক ব্যক্তি বিলমাইল বিলে মাছ চাষ করার ফলে বন্ধ থাকা সুইস গেটের পাশ দিয়ে ছোট ছোট গর্ত দিয়ে পানি বের হতে থাকে। কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে নদী ফেঁপে গিয়ে ওই স্থানটি পানির চাপে ভেঙে যায়। গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে ৩টার সময় পানি ঢোকার স্থানটি একসঙ্গে ২০ থেকে ২৫ হাত ভেঙে যায়। মুহূর্তে খবর পেয়ে স্থানীয়রা বাঁধের গাছ কেটে ভাঙা স্থানে ফেলে পানি বন্ধ করা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। মোহনপুর উপজেলা দায়িত্বরত নির্বাহী কর্মকর্তা শুল্কা সরকার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বিপুল কুমার কর্মকার, কৃষি কর্মকর্তা রহিমা খাতুন ও ধুরইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজিমউদ্দিন সরকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
স্থানীয় সাহেব আলী, মাজেদুর রহমান, শহিদুল ইসলাম, ইয়াদ আলী, এমদাদ হোসেনসহ ৮-১০ জন কৃষক জানান, শিবনদীর বেড়ি বাঁধে কয়েকটি সুইস গেটের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে বিলমাইল বিলে উপজেলার মেলান্দি গ্রামে বিশ্বজিৎ নামের এক ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে দীর্ঘদিন ধরে মাছ চাষ করে আসছিল। বিষয়টি নিয়ে ওই এলাকার কৃষকেরা প্রতিবাদ করেও কোন লাভ হয় নি। ওই বেড়ি বাঁধের সুইস গেটগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের তাদারকি করার কথা থাকলেও এলাকাবাসী জানান, সারা বছরেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা কর্মচারীদের দেখা মিলে না। এলাকাবাসী আরো জানান, বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলার কারণেই আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্লাবিত এলাকা থেকে বাঁধের পশ্চিম পাশে পানির অবস্থা প্রায় সাত থেকে আট হাত উঁচু-নিচু হয়ে আছে। সপ্তাব্যাপি ভাঙা স্থান দিয়ে পানি নামলেও পানি সমসমান অবস্থায় দাঁড়াবে না। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে মোহনপুর ও পাশের পশ্চিম বাগমারার অঞ্চলটি তলিয়ে যাওয়া আশঙ্কায় করছেন এলাকাবাসী। পানির প্রবল চাপে প্রথমত ধুরইল ও ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের সম্পন্ন এলাকার ফসল, পান বরজ, ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন তারা। এ বিষয়ে মোহনপুর উপজেলার দায়িত্বরত নির্বাহী কর্মকর্তা শুল্কা সরকার জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে আমার পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হবে।
অন্যদিকে মান্দার শিব নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠাকুরমান্দা যাতায়াতের রাস্তা তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে মাঠের আমন ধানের খেত। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তিন নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব নদীর বাঁধের ভেতরে থাকা অন্তত ৫ শতাধিক পরিবার। টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে গত শুক্রবার রাত থেকে আত্রাই, ফকিরনি ও শিবনদের পানি বাড়তে শুরু থাকে। গত শনিবার দুপুরে এসব নদীর পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করে। গতকাল রোববার বিকেল ৩টা পর্যন্ত এসব নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাইবুল্যা নামকস্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ৫০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুপুরে ১২টার দিকে পারনুরুল্লাবাদ উত্তরপাড়ায় আরেকটি বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে আড়াই শতাধিক পরিবার। এদিকে বিকেলে চকরামপুর ও চকবালু এলাকায় বেড়ি বাঁধ ভেঙে আরো সাতশ পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। দুর্গত মানুষরা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে এসব এলাকার ফসলের খেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ।
এদিকে পানির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে আত্রাই নদীর শহরবাড়ি, ভাংগীপাড়া, কয়লাবাড়ি, চকরামপুর, চকবালু, শামুকখোল হাতিয়ানদহ, প্রসাদপুর খেয়াঘাট, কামারকুড়ি, কালিকাপুর বাজার, কয়াপাড়া বেড়িবাঁধ, পারলক্ষ্মীরামপুর, মদনচক, নান্নুরঘাট ও আয়াপুর পাগলীতলা এবং ফকিরনি নদীর নুরুল্লাবাদ মন্ডলপাড়া, চকহরি নারায়ণ, নিখিরাপাড়া, গোয়ালমান্দা ও করাতিপাড়া। এছাড়া শিবনদের বাদলঘাটা, কোঁচড়া, দুর্গাপুর, শগুনিয়া, ডেবরা, বলাক্ষেত্র, শিমলাদহ, বাঁকাপুর, শংকরপুর, রুয়াই, ভাতহন্ডা এলাকার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো টিকিয়ে রাখতে স্বেচ্ছাশ্রমে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছে গ্রামপুলিশসহ স্থানীয়রা। এদিকে ফকির্নি নদীর বামতীর নুরুল্লাবাদ মন্ডলপাড়া নামকস্থানে বেড়িবাঁধ উপচে পানি পার হচ্ছে। স্থানীয়রা বাঁধটি টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বাঁধটি টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। বাঁধটি ভেঙ্গে গেলে নুরুল্লাবাদ, কশব ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে।
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম প্রামানিক জানান, বন্যায় ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান নিরূপণে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। তালিকা হাতে পেলেই ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য জানা যাবে।
এ বিষয়ে মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরুজ্জামান বলেন, বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে পানিবন্দি পরিবারগুলোর প্রাথমিক তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। খুব দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে।