মোহনপুর প্রতিনিধি:
রাজশাহীর মোহনপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত ক্লাস করে পরীক্ষার আগে স্কুল থেকে তাদের দেওয়া হয় বিশেষ প্রশ্নপত্রসহ নানা সুযোগসুবিধা। যারা অতিরিক্ত ক্লাস করে তাদের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হোয়াইটসঅ্যাপে খুলেছে আলাদা গ্রুপ। প্রতিটি ক্লাসে যারা অতিরিক্ত ক্লাস করে তাদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ। যারা টাকার অভাবে ক্লাস করতে পারেনা তারা থাকেন এ বিশেষ গ্রুপের বাইরে। প্রতিদিন শিক্ষকরা এ গ্রুপে টাকা পয়সা উত্তোলনসহ দেন বিভিন্ন নির্দেশনা। যারা অতিরিক্ত ক্লাস করতে পারে না তাদের রীতিমতো অপমান অপদস্ত করেন শিক্ষকরা।
গেল সোমবার (৫ মে) দৈনিক সোনার দেশ পত্রিকায় ‘পরীক্ষাকেন্দ্রে চলছে শিক্ষকদের কোচিং সেন্টার!’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হলে টনক নড়ে মোহনপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফসহসহ অন্যান্য শিক্ষকদের। প্রতিটি শ্রেণিতে অতিরিক্ত ক্লাসের জন্য হোয়াটসঅ্যাপে খোলা গ্রুপের বিশেষ নির্দেশনাগুলো ডিলিট করেছেন বার্তা প্রদানকারী অভিযুক্ত শিক্ষকরা। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিশেষ ক্লাস। মঙ্গলবার (৬ মে) গঠন করা হয় তদন্ত কমিটিও। সংবাদ প্রকাশের পরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিভাবকরা আরও অভিযোগ করছেন।
মোহনপুর থানায় কর্মরত পুলিশের সহকারি পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) নজরুল ইসলাম বলেন, আমার দুই মেয়ে এ স্কুলে পড়াশোনা করেন। প্রথমে দুই মেয়ের জন্য প্রতিমাসে দুই হাজার ৪০০ করে টাকা দিতে হত। পরে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফকে পরিচয় দিলে পুলিশ সদস্য হওয়ার কারনে তাকে দুই মেয়ের জন্য ৪০০ টাকা মওকুফ করে প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা ফিক্সড করে দেন। সেই থেকে ওই এএসআই প্রতিমাসে দুই মেয়ের জন্য ২ হাজার করে টাকা দেন অতিরিক্ত ক্লাস এর জন্য।
তিনি আরও বলেন, শুধু আমি একা নই আমার মত অন্যান্য অভিভাবকরাও প্রতি মাসে বাধ্য হয়ে মেয়েদের এখানে প্রাইভেট পড়ান। এস্কুলে যারা প্রাইভেট পড়ে তাদেরকে পরীক্ষার সময় বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
প্রশ্নপত্রের তথ্য দিয়ে বলেন, পরীক্ষার কয়েকদিন আগে অতিরিক্ত ক্লাসের শিক্ষার্থীদের শিক্ষকরা সরবরাহ করেন বিশেষ প্রশ্নপত্র শিট। সরবরাহের সময় দেখিয়ে দেওয়া হয় পরীক্ষায় কোন কোন প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে। আর যারা বিশেষ ক্লাস করতে পারে না তাদের সামগ্রিক বিষয়ে প্রশ্নপত্রের খাতায় লিখতে হয় উত্তর।
মোহনপুরের ব্যবসায়ী সিরাজ উদ্দিন বলেন, আমার দুই মেয়ে এই স্কুলে পড়ে। বড় মেয়ে দশম শ্রেণির ফার্স্ট গার্ল। ছোটটাও সপ্তম শ্রেণির ফার্স্ট গার্ল। তারা প্রতি ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক একদিন আমাকে ডাকেন। তার কাছে গেলে তিনি একটা আমাকে ফরম দেন। সেই ফরমে এক্সট্রা ক্লাসের আবেদন ছিল। তিনি জোরপূর্বক সেই ফরম পূরণ করিয়ে নেন। তারা ক্লাসের প্রথম বলে প্রধান শিক্ষক ছাড়ও করে দেন। দুই মেয়ের জন্য ১৭০০ টাকা করে রাখছেন।
এখানেই শেষ নয় এ স্কুল নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। স্কুলটিতে রয়েছে ৫১৮ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে তৈরি হয়েছে ৬ তলা বিশিষ্ট নতুন অ্যাকাডেমিক ভবন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীরা ভাল রেজাল্ট করতে পারছেনা। শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে এ স্কুলে তিন শিক্ষককে পদায়ন করে শিক্ষা অধিদফতর। শিক্ষকদের পদায়ন করায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফসহ অন্য শিক্ষকরা। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা শূন্য পোস্টের বিপরীতে পদায়নের কথা উল্লেখ করলে। শিক্ষকদের কথা শুনে বেতন করার কথা বলেন উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস। হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তারা বলেন, প্রধান শিক্ষক বেতন ফরওয়ার্ড করলে বেতন পেতে আর কোন বাধা নেই। কিন্তু প্রধান শিক্ষক স্বেচ্ছাচারিতায় ফরোয়ার্ড করেন না বরং তিনি অধিদফতরে যোগাযোগ করে শিক্ষকদের অন্যত্র বদলি করার ব্যবস্থা করেন।
এভাবে কয়েকজন শিক্ষককে তাদের অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ। বিদ্যালয়টিতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী থাকলেও মানসম্মত শিক্ষক নাই। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক ইংরেজি, গণিত, ভৌত বিজ্ঞান/ জীববিজ্ঞান এ বিষয়গুলোর কোন শিক্ষক নাই। সেকারণে এ স্কুলে কাক্সিক্ষত রেজাল্ট করতে পারছেনা শিক্ষার্থীরা।
এবিষয়ে মোহনপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির প্রধান বেনজির আহম্মেদ বলেন, মোহনপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজের সুত্র ধরে তদন্ত করা হচ্ছে। আরও কোন অভিযোগ আসলে সেটার বিষয়ে তদন্ত কমিটি তদন্ত করবে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।