শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সুজিত সরকার
স্বাধীনতা দিবসে শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে গিয়ে বিএনপি কার্যালয় থেকে জেনারেল জিয়ার ভাষণ বাজানো হ”েছ। ওরা যে দাবি করে, ‘জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক’ সেটা প্রতিষ্ঠিত করার অভিলাষে বাজানো হ”েছ সেই ঘোষণার অংশ বিশেষ। সেখানে জিয়া শুধু বলছেন, ও সধলড়ৎ তরধ, ফবপষধৎব ঃযব রহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয…পরের অংশ ড়হ নবযধাব ড়ভ ড়ঁৎ মৎবধঃ হধঃরড়হধষ ষবধফবৎ ইধহমধনধহফযঁ ংযধশব গঁলরনঁৎ জধযসধহ এই শব্দগুলো সে বক্তৃতায় অনু”চারিত থেকেছে বা তারা শেষের অংশটুকু ফবষবঃব করে বাজা”েছ। বাজিয়ে তাদের কর্মীদের বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে এই বলে, ‘দেখো আমাদের নেতাও শেখ মুজিবের সমতুল্য। তার ঘোষণায়ই বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শেখ মুজিব তখন পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান।’ এটাও যে এক ধরনের ইতিহাস বিকৃতি, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই বিকৃতির সঙ্গে তারাই যুক্ত যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং বাংলাদেশকে আজো পাকিস্তানের পূর্বাংশ হিসেবে ভাবে।
ইতিহাসের বিরুদ্ধে অব¯’ান নিয়ে কেউ ক্ষমা পায়নি। তারা সেখানে দেশদ্রোহী, মানবতা ও শান্তি বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা বিরোধিতা করেছিলো, তাদের ঠাঁই তখনই সেখানে হয়েছে যখন তারা স্বাধীন আমেরিকাকে মেনে নিয়েছে। আর যারা আদৌ স্বাধীন আমেরিকাকে মেনে নেয়নি, তাদের দেশান্তর হতে হয়েছে। অধিকাংশই কানাডায় আশ্রয় নেয়। সোভিয়েত বিপ্লবের পর অনেকেই সে দেশ ত্যাগ করে নানা দেশে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ গ্রšে’ এ রকম একটি চরিত্র সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। যিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর মাতৃভূমি ত্যাগ করে প্রথম ইরানে এবং পরে আফগানিস্তানে আশ্রয় নেন। যুক্ত হন শিক্ষা কাজে। ইরানে অব¯’ানকালে তিনি ভালো ফারসিভাষা রপ্ত করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনেও ফারসিভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানেই মুজতবা আলীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। মুজতবা আলী স্বীকারও করেছেন তিনি ওই দেশত্যাগী প-িতের কাছে ফারসিভাষা শেখেন। এ ভাবে যারা পরা¯’ হয়েও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলো, সমাজতান্ত্রিক ব্যব¯’ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে জঙ্গি, জেএমবি, আনছারুল্লাহ্ বাংলাভাই, জামাত-শিবিরের মতো সশস্ত্র অব¯’ান নিয়েছিলো, দেশময় সন্ত্রাস স”ষ্টি করে নৈরাজ্যিক পরিবেশ স”ষ্টি করতে চেষ্টা করেছিলো, তাদের সোভিয়েত রেড আর্মি নির্মূল করে বিপ্লবকে অর্থবহ করে তুলেছিলো। অন্ততঃ মানুষের খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসা আর কর্মসং¯’ানের ব্যব¯’া পর্যায়ক্রমে করতে সক্ষম হয়েছিলো। হয়েছিলো বলেই তো প্রবল ফ্যাসিস্ত হিটলার-মুসোলিনি পরবর্তীতে লুটেরা সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলো পর্যন্ত সোভিয়েতের বিপরীতে অব¯’ান নিয়ে খুব বেশি লাভবান হয়নি। তার উজ্জ্বল দ”ষ্টান্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা সপ্তম নৌ-বহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে সোভিয়েতও নবম নৌ-বহর পাঠানোর ঘোষণা দেয়। সোভিয়েতের ঘোষণায় আমেরিকার নৌ-বহর ভারত মহাসাগরের অনেক দূরে অব¯’ান নিয়ে অপেক্ষায় না থেকে স্বদেশে ফিরে যায়। তখন তারা ভিয়েতনামে প্রচ-ভাবে বিপর্যস্ত হ”িছলো। ভিয়েতনামি গেরিলাদের আক্রমণে তারা প্রতিদিন নাকানি-চুবানি খেতে খেতে আতঙ্কের প্রহর গুনছিলো। শেষে দখলবাজির সকল আশা পরিত্যাগ করে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। জিয়া এবং তার দলের নেতা-নেত্রীরা আজকে সেই পরাজিত অপশক্তিরই সমর্থক। তাদের সঙ্গে জোট বেধে নির্বাচন করেছে, আগামীতেও করার প্রত্যাশী। সে কারণে তারা ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করেনি। যারা ২৫ মার্চ পালন থেকে বিরত থাকে, তাদের ২৬ মার্চ বা বিজয় দিবস ইত্যাদিও পালন করা উচিত নয়। তারা তো দেশটাকে, দেশের করুণ কিš’ গৌরবান্বিত অর্জনটাকেই মানে না। আত্মদান ব্যতিত কবে কখন কোথায় কোন্ দেশে স্বাধীন হয়েছে! ত্যাগের সেই স্বর্ণোজ্জ্বল মহিমাকেই যারা মানে না, তারা কোন্ লজ্জায় স্বাধীনতাদিবসে কাদের জীবনদানের উদ্দেশে শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে? তারা তো স্বাধীনতা, সার্বভৌম বাংলাদেশের কনসেপ্টেকেই মানে না। তাহলে তারা ঘোষণা দিতে পারে, জিয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিনা রক্তপাতে, কারো সম্পদ-সম্পত্তির ক্ষতি ব্যতিরেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কেউ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়নি, কেউ ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেননি, সব জিয়ার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে আপোসে নিষ্পত্তি হয়েছে। অবশ্য বিএনপি নেত্রী বলেছেন, ত্রিশ লক্ষ শহিদ হননি, তিন লাখ হতে পারে! তার নেতারা আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, একটা একটা করে গুণে, তালিকা করে প্রমাণ করা হোক ত্রিশ লাখ শহিদ বাঙালি নাম- ঠিকানা। জিয়াপুত্র লন্ডনে বসে দাবি করেছে, তার পিতাই ‘দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’(!)। এমন যোগ্য নেতারা (?) কেনো ২৫ মার্চকে বাঙালির ত্যাগী ইতিহাসের অংশ হিসেবে বিবেচনায় নেবে? ওরা বরং ১৪ আগস্টকে ওদের মুক্তির দিবস আর ১৫ আগস্ট যখন সারা জাতি শোক পালন করে, তখন মিথ্যে জন্মদিবসের উৎসব করে মানুষের ঘ”ণার পাত্র সাজে। এরা কি সত্যিই বাংলাদেশ নামে দেশটাকে সম্মান করতে পারে? কখনো না। কোনোদিনই করেনি, আর করবেও না। তাই এদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া প্রত্যাশিত। যারা দেশ মানে না, দেশের গৌরবগাথাকে মানে না, সম্মান করে না, তারা কেনো, কোন্ অধিকারে এ দেশে থাকবে আবার এ দেশেরই বিরোধিতা করবে? এ দেশের আলো-হাওয়া, খাদ্য-মাটি কোনো কিছুরই সহযোগিতা তাদের জন্যে নয়। বরং পাকিস্তানি জঙ্গি-সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতাই তাদের পছন্দ। সে পছন্দের আলোকেই তারা বাংলাদেশে ‘বাংলাভাই’, ‘জেএমবি’সহ নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠির স্রষ্টা। তোষক ও পোষক।
সত্যটা সব সময়ই অপ্রিয়। অনেক সময় নিজেদের নেতা-নেত্রীও সত্যের অপলাপ করেন। কর্মীকে ভুল বোঝেন। আজকে দেশময় যে কৌশলে জঙ্গি উত্থান ঘটেছে, তার পেছনে যে যা-ই বলুন না কেনো, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রই তার হোতা। তাদের মদদ দি”েছ যারা আচরণে নিজেদের সবকিছুর উর্ধ্বে ভাবেন কিš’ ভেতরে ভেতরে ঘাতকদের অপচেতনা বহন করে, ভোগে ধর্মান্ধতায়, তারাও। জিন্নাহ্ সাহেব যেমন দিনভর মদপান করতেন, নিজেকে অতি আধুনিক মানুষের পোশাকে আব”ত রাখতেন, ভেতরে ভেতরে পুষতেন ধর্মান্ধতার বিষব”ক্ষ। সেই জিন্নাহ্ পরিণতিতে অনুধাবন করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকচক্র কতো বড়ো অধার্মিক, অসভ্য আর বর্বর। আজকে অবিকল বর্বরতার মাদক বিএনপি যুব মানসে পুশ করছে জঙ্গি স”ষ্টিতে সহায়তা করে। তারা বলছে, ‘সরকার জঙ্গি নিয়ে খেলছে। আসুন, জাতীয়ভাবে সকল দল মিলে ওদের দমন করি।’ দেশবাসী জানে, এই জঙ্গি ¯্রষ্টা বিএনপি। জিয়াউর রহমান। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই জামাতের মতো জঙ্গি-ধর্মান্ধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী হন। মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব তুলে দেয়া হয় তাদের হাতে। সেই তারা একাত্তরে যেমন গণহত্যা-ধর্ষণ আর লুটপাট-অগ্নিসংযোগে লিপ্ত হয়েছিলো ধর্ম রক্ষার জিকির তুলে, তারা এখনো সেই একই স্লোগান দিয়ে জঙ্গিপনা করছে। নিজেরা মরছে, নিরস্ত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করছে। এমন কি আত্মঘাতী হতে গিয়ে নিজের শিশু সন্তান, স্বজন-প্রিয়জনদের তার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত করছে। কয়েকদিনের জঙ্গি বিরোধী অ্যাকশনে সে চিত্রই সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। যারা ধর্ম রক্ষার কথা বলে মানুষ হত্যা করে, দেশটাকে মানে না, সম্মান করে না, তারা কী করে ধর্মের আদর্শ-চেতনা ধারণ করতে পারে? তারা নিছক সন্ত্রাসী-জঙ্গি। ফেসবুকে একজন লিখেছিলেন, ‘পশুর চেয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসী ভয়াবহ’। তাই যারা সন্ত্রাসী-যুদ্ধাপরাধীর পুনর্বাসনকারী তারা দেশের স্বার্থ কখনোই রক্ষা করেনি। পঁচাত্তরের পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে একটিও উন্নয়নমূলক কাজ করেনি। তারা কী করে বাঙালির স্বার্থ, দেশের ও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হতে পারে, সেটাই এখন বড়ো প্রশ্ন। বিধায় জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা শুধু মিথ্যে নয়, ইতিহাস বিকৃতি, ইতরজন সুলভ আচরণের বহির্প্রকাশ। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে তাদের বিচার হওয়া প্রত্যাশিত।
এখন সূর্যের আলোর সঙ্গে মোমবাতি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে প্রতিযোগীরা নিঃসন্দেহে বোকার স্বর্গে বাস করে। অবশ্য এ উদাহরণের সঙ্গে অতি প-িত কেউ তুলনা করতে পারেন, ক”ছপ আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতার কাহিনি। সেটা আলসের নিবুর্দ্ধিতা। কিš’ সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একজন সেক্টর কমান্ডারের তুলনা নির্ভেজাল বিকৃত মেধা ও মননের অনুশীলন। মূর্খতা। জিয়া ছিলেন স্বাধীনতা ঘোষণার পরের দিনের সান্ধকালীন আসরের ৮ম পাঠক। তার আগেও একজন সামরিক কর্মকর্তা ওই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন। প্রথম পাঠক চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হান্নান সাহেব। প্রথম পাঠককে বাদ দিয়ে কেনো ৮ম পাঠক ঘোষণাকারী হবেন, সে অঙ্ক মেলে না। অতএব এটা মিথ্যেচার, ইতিহাস বিকৃতি। এদের বিচারের সম্মুখিন না করলে আজকের প্রজন্মের বাঙালি শিশু-কিশোর বিভ্রান্ত হবে। ভুল শিক্ষায় গড়ে উঠবে। সরকার পক্ষ ঘোষণাও দিয়েছেন ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিচার করবেন। আদালতের দিক থেকে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ আবশ্যক। সংসদেও আলোচনা হওয়া প্রত্যাশিত। একটি স্বাধীন জাতি নিজের মেরুদ-ের ওপর তখনই অব¯’ান নিতে পারে যখন তারা ইতিহাসের শুদ্ধ পাঠ নেয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলার আয়োজন করে। জঙ্গি দমনের সমান্তরালে ইতিহাস বিকৃতকারীদেরও বিচার সরকারকে করতে হবে।