বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
একটা সময় দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তৃর্ণ এলাকা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো। ওই সময় অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে কর্মরত এক কর্মকর্তার হাতে ১৮২৯ সালে পোড়ামাটির কয়েকটি ফলক এসে পৌঁছায়।
এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ বিশিষ্ট ওই ফলকগুলোর গায়ে অপরিচিত একটি বর্ণমালা ব্যবহার করে কিছু লেখা ছিল। আর এক একটি ফলকের গায়ে খোদিত ছিল এক একটি প্রাণীর ছবি। সেগুলোর মধ্যে রূপকথার এক শিং বিশিষ্ট ইউনিকর্ন সদৃশ্য প্রাণীর ছবি সবচেয়ে বেশি খোদাই করা ছিল। এই ফলকগুলো ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানীদের একেবারে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল।
তারা ফলকগুলোর উৎস আবিষ্কার এবং এগুলো নির্মাণকারীদের সম্পর্কে জানার তৎপরতা শুরু করলো। এরপর গঠন করা হলো আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। এই সংস্থার অনুসন্ধানে পাঞ্জাবের হরপ্পায় সুপ্রাচীন এক জনপদের সন্ধান পাওয়া যায়। জনপদটি হরপ্পা সভ্যতা হিসেবে পরিচিত।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কাজ প্রথম দশক পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে ভাটা পড়ে। ১৯০৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর লর্ড কার্জনের উদ্যোগে সংস্থাটি আবারও কাজ শুরু করে। গবেষণায় উঠে আসে একের পর তথ্য। সুপ্রাচীন এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু নদ অববাহিকায়।
নৃবিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য, প্রায় সাড়ে ৮ হাজার বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ার সিন্ধু নদের অববাহিকায় কৃষি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। ওই সময় সিন্ধু নদের পাশাপাশি স্বরসতী নামে আরেকটি নদী এই অববাহিকায় প্রবাহিত হতো। তিব্বতের পার্বত ভূমি থেকে উৎপন্ন এই দুইটি শক্তিশালী জলধারা একত্রিত হয়ে আরব সাগরে মিলিত হতো।
বছরে দুইবার এই দুইটি নদীর তীর বন্যায় আক্রান্ত হতো। গ্রীষ্মে হিমালয়ের পর্বতের বরফগলা পানি আর বর্ষাকালে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের কারণে সিন্ধু অববাহিকা এলাকার মাটি ছিল খুব উর্বর।
খিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে যাত্রা করা এই সভ্যতার নিয়ন্ত্রণে থাকা বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে পূর্বে ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে বর্তমান ভারতের গুজরাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখন পর্যন্ত এই সভ্যতায় দেড় হাজারের বেশি জনপন আবিষ্কৃত হয়েছে। যেগুলো হারিয়ে যাওয়া স্বরসতী নদীর তীরে অবস্থিত।
এই জনপদগুলো ছিল যেমন আধুনিক, তেমন ছিমছাম এবং গোছানো। এই জনপদের অধিবাসীদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহের কোনো নজির নেই বললেই চলে। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে টিকে থাকা এই জনপদগুলো ভীনদেশি হানাদারদের হামলাও সহ্য করেনি কখনো। এই সভ্যতায় পাওয়া নিদর্শনগুলোতে কোনো রাজপ্রাসাদ বা ধর্মীয় উপাসনালয় ছিল না।
হরপ্পার মানুষদের জীবনযাত্রার মান ছিল যথেষ্ট উন্নত। আধুনিক যুগে যেভাবে তেল দিয়ে রান্না করা হয়, হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরাও সেভাবেই রান্না করতো। সিন্ধুলিপির নিদর্শন থেকে ধারণা করা হয়, হরপ্পাবাসীদের একটা অংশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিল। তারা কৃষিকাজ ছাড়াও নানা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ করতো। হরপ্পার মানুষেরা কুঠার, বর্শা, ছোরা, তীর-ধনুকের ব্যবহারও জানতো।
হরপ্পাবাসীরা অবসরে পাশা খেলতো, শিকার করতো এবং ষাঁড়ের খেলার আয়োজন করতো। নগরে খাদ্যের অভাব ছিল না। অধিকাংশ ফসলই নিজেরা উৎপাদন করতো। গবেষণায় পাওয়া তথ্য, সে সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা তেমন আধুনিক ছিল না। হরপ্পার জনগণের গড় আয়ু ছিল মাত্র ত্রিশ বছর। কেউ মারা গেছে সরাসরি কবর দেওয়া হতো অথবা মৃতদেহ পুড়িয়ে তার ছাই কবর দেয়া হতো।
বিশেষজ্ঞদের ধারনা এই জনপদ রাজপরিবারের পরিবর্তে প্রতিনিধি পরিষদের দ্বারা পারিচালিত হতো। আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এই জনপদের অধিবাসীরা তাদের প্রিয় শহর ছেড়ে চলে যায়। এরপর প্রায় চার হাজার বছর ধরে এই জনপদগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।
অধ্যাপক গুরুদীপ সিং বলেছেন, ২২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ সিন্ধু নদ অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। কৃষি বিপর্যস্ত হয় এবং জীবনযাপন কঠিন হযে পড়ে। প্রচুর গাছ কাটা হয় এবং প্রাণীজ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে নানা রকম সংকট তৈরি হয়।
পুরাতাত্ত্বিকরা বলেন, খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০ পরবর্তী হরপ্পার সঙ্গে মহেঞ্জোদারোর ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা পড়ে। ফলে কারিগরি শিল্পের ভাটা পড়ে। শিল্পের উৎপাদন এবং বিনিময় কেন্দ্র হিসেবে নগরগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
বলা হয়, সম্ভবত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অধিবাসীরা এই জনপদ ফেলে চলে যায়। এই মতের পক্ষে স্বরসতী নদী শুকিয়ে যাওয়া অন্যতম কারণ।
এক কথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পেরে সুসজ্জিত হরপ্পা সভ্যতার মানুষ ছেড়ে যায় তাদের জনপদ।
তথ্যসূত্র: রাইজিংবিডি