শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদ্য প্রয়াত নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার গত এক বছর ধরে ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। ধারণা করা হচ্ছিল, দীর্ঘ সময়ে মাটির নিচে হামাসের তৈরি সুড়ঙ্গের মধ্যে একদল দেহরক্ষী এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের ‘মানবঢাল’ বানিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি।
তবে মৃত্যুর আগে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় মাত্র তিনজন সঙ্গীকে নিয়ে একটি ভবনের কক্ষে প্রবেশ করলেও শেষ মুহূর্তে তিনি ছিলেন একা।
সিনওয়ারের অবস্থান শনাক্তকারী ড্রোনের ক্যামেরায় এই নেতাকে হত্যার আগের মুহূর্তের ভিডিও এমন তথই প্রকাশ করেছে।
বিবিসি লিখেছে, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালানোর মূল কারিগর বলে মনে করা হয় সিনওয়ারকে। গত জুলাই মাসে তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া হত্যার শিকার হলে ৬১ বছর বয়সী সিনওয়ারকে হামাসের সামগ্রিক নেতা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ নিশ্চিত করেছেন যে, বুধবার সেনারা সিনওয়ারকে হত্যা করেছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীও (আইডিএফ) বলছে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হামাসের শীর্ষ নেতাদের অবস্থান শনাক্তের পর ইসরায়েলি সেনারা দক্ষিণ গাজায় অভিযান চালায়। আইডিএফের ৮২৮ ব্রিগেডের সেনারা সেখানে তিনজনের অবস্থান শনাক্ত এবং তাদেরকে হত্যা করে। পরে ডিএনএ পরীক্ষা করে তাদের মধ্যে একজনকে সিনওয়ার বলে নিশ্চিত করা হয়।
সিনওয়ারের সন্ধান মিলল যেভাবে
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলছে, তাদের ৮২৮তম ব্রিগেডের একটি ইউনিট বুধবার রাফার তাল আল-সুলতান এলাকায় টহল দিচ্ছিল। ওই সময় সেখানকার একটি ভবনে অভিযান চালান হয়। কারণ সেনাদের কাছে তথ্য ছিল, ভবনটি হামাসের সিনিয়র নেতারা ব্যবহার করেন। তারপর ওই ভবনে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে হত্যা করা হয়।
ওই তিনজনের মধ্যে একজনের সঙ্গে হামাস নেতা সিনওয়ারের শারীরিক গঠনের মিল পান ইসরায়েলি সেনারা। পরে সেই মৃতদেহের আঙুলের একটি অংশ পরীক্ষার জন্য ইসরায়েলে পাঠানো হয়। ইসরায়েলের কাছে সিনওয়ারের জেনেটিক তথ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। কারণ জীবনের কয়েক দশক সিনওয়ারের কেটে গেছে ইসরায়েলের কারাগারে।
আরও পরে ওই এলাকার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হামলায় প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবন থেকে মৃতদেহগুলো বের করে ইসরায়েলে নিয়ে যায় অভিযান পরিচালনাকারী সদস্যরা। ইসরায়েলেই ডিএন পরীক্ষা করে এবং ড্রোনের ভিডিও ও কয়েকটি গ্রাফিতি ছবির সাহায্যে সিনওয়ারের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগরি বলেছেন, ওই ভবনে যে সিনওয়ার আছেন, সেটি তার বাহিনী নিশ্চিতভাবে জানত না।
“আমাদের অভিযান শুরু হলে তিনজন বন্দুকধারীকে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়াতে দেখেছে সেনারা। একবার গুলি চালানো হলে তারা বিচ্ছিনি হয়ে যান ও সিনওয়ার একা ভবনের মধ্যে একটি কক্ষে প্রবেশ করেন। এরপর একটি ড্রোন দিয়ে তার অবস্থান শনাক্ত করে তবে হত্যা করা হয়।
“ওই সময় সিনওয়ার জিম্মিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিলেন না। তার একক চলাফেরা থেকে ধারণা করা হয়, তিনি শেষ মুহূর্তে একাই ছিলেন অথবা তিনি তার দেহরক্ষীদের হারিয়েছিলেন।”
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, “সিনওয়ার একজন কমান্ডার হিসেবে মারা যাননি। তার মৃত্যু হয়েছে পালিয়ে যাওয়ার সময়, মারধর ও নিপীড়নের শিকার হয়ে। তিনি মৃত্যুর সময় কেবল নিজের প্রাণ নিয়েই চিন্তিত ছিলেন। এই মৃত্যু আমাদের সমস্ত শত্রুদের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা।”
ড্রোনের ভিডিওতে যা ছিল
যে ড্রোন দিয়ে হামাস নেতা সিনওয়ারকে ভবনের মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছিল, সেই ড্রোনের ক্যামেরার ভিডিও প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
যে ভিডিওতে হত্যার আগ মুহূর্তের কিছু দৃশ্য উঠে এসেছে। দেখা গেছে, ভবনের নিচ তলায় সোফায় বসে আছেন একজন, তার মাথা ও মুখ একটি কাপড়ে ঢাকা এবং ঘরটি প্রায় ধ্বংস্তুপ। তারপর ওই ব্যক্তি ড্রোনের দিকে হাতের লাঠিটি ছুড়ে মারেন। এরপর অন্ধকার, আরো কোনো ভিডিও ধরা পড়েনি ড্রোনের ক্যামেরায়।
গাজা যুদ্ধের ‘শেষের শুরু’
ইসরায়েল প্রথমে বলেছিল, ‘সম্ভবত’ সিনওয়ার মারা গেছেন। সেনাদের ভাষ্য ছিল, সিনওয়ার নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না; নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এজন্য ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন বলেও জানিয়েছিল ইসরায়েল।
পরে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে একজনের সঙ্গে সিনওয়ারের যথেষ্ঠ মিল পাওয়া গেছে, তার মাথায় গভীর ক্ষত রয়েছে। মৃতদেহটি সিনওয়ারেরই কী না তা নিশ্চিত হতে অবশ্য ইসরায়েল বেশি সময় নেয়নি।
যাবতীয় পরীক্ষা শেষে সিনওয়ারকে হত্যার কথা নিশ্চিত করে বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, সিনওয়ারের হত্যার মধ্য দিয়ে গাজা যুদ্ধের ‘শেষের শুরু’ হল।
তবে যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়নি বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
গাজা যুদ্ধের শুরুতে হামাসকে নির্মূলের যে অঙ্গীকার নেতানিয়াহু করেছিলেন তাতে তিনি এখন পর্যন্ত অটল আছেন।
জিম্মিদের পরিবারের উদ্দেশে তিনি বলেন, “যতক্ষণ আপনাদের প্রিয়জন, স্বজনরা বাড়িতে না ফিরছেন, ততক্ষণ যুদ্ধ চলবে।”
যদিও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, লক্ষ্য ধরে সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়নি। কিন্তু আইডিএফ বলছে, তারা হামাসের এই শীর্ষ নেতাকে হত্যার জন্য রাফার ওই এলাকায় গোয়েন্দা তৎপরতা চালাচ্ছিল এবং গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতেই ওই ভবনে হামলা চালানো হয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি বাহিনী সিনওয়ারের অবস্থান ধরে নিয়ে দক্ষিণের শহর রাফা পর্যন্ত তাদের হামলা এগিয়ে নিচ্ছিল এবং সিনওয়ারের বসবাসের ভবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
সিনওয়ারের মৃত্যু ইসরায়েলের জন্য এক বিরাট সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০১১ সালে হামাসের এই নেতা বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। এরপর তিনি হামাসের কট্টরপন্থি এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠেন।
সিনওয়ার ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক পন্থায় সমস্যা সমাধান করা নয় বরং ইসরায়েলকে মোকাবেলায় সশস্ত্র সংঘাতের পথ বেছে নেন।
বিশেষ করে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়।
ইসরায়েল সরকারের তথ্য অনুসারে, এই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছে, এছাড়া প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
ওই হামলার জবাবে ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় নির্বিচারে হামলা শুরু করে ইসরায়েল, যা এখনো চলছে।
তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ