যে কারণে হামলা-ভাঙচুর থেকে বেঁচে গেছে দেশের কয়েকটি থানা-ফাঁড়ি

আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪, ৩:০০ অপরাহ্ণ


আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ প্রতিনিধি:


গত ৪ আগস্ট দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় চলে বিভৎস হত্যাকাণ্ড। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করা হয় ১৪ জন পুলিশ সদস্যকে। তাদের মধ্যে আটজনের লাশ থানার পাশের মসজিদের সামনে স্তূপাকারে রাখা হয়েছিল।

তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে পাশের পুকুরে। একজনের লাশ পড়ে ছিল পাশের রাস্তায়। অন্য একজনের লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। হামলাকারীদের সেই বর্বরতার কথা মনে হলে এখনও আঁতকে ওঠেন স্থানীয় মানুষেরা।

শুধু এনায়েতপুরেই নয় ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় ব্যাপক হামলার শিকার হয় দেশের বেশিরভাগ থানা। বিগত ১৬ বছর ধরে সাধারণ মানুষের ওপর আওয়ামী লীগের চালানো দমন পীড়নের কারণে সৃষ্ট জনরোষের শিকার হয় পুলিশ। থানায় চালানো হয় ভাঙচুর, ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন, লুট করা হয় অস্ত্র-গোলাবারুদ।

বিভিন্ন স্থানে হত্যার শিকার হন পুলিশ সদস্যরাও। তবে যখন বেশিরভাগ থানায় তাণ্ডব চলছিল তখনও দেশের গুটিকয়েক স্থানে পুলিশকে সুরক্ষা দিয়েছেন স্থানীয় মানুষেরাই। সে সব স্থানেরই একটি মৌলভীবাজারের শেরপুর।

সিলেট বিভাগের চারটি জেলার মিলনস্থল মৌলভীবাজারের শেরপুরেও গত ৪আগস্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। একই সময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরাও পাল্টা মিছিল বের করেছিলেন। এরপরও সেখানে কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।

এর কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলেন, ওইদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় কারণেই কোনোপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ যখন আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি ছুঁড়েছে, সেই সময় শেরপুরের পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনকারীদের দিকে কোনো গুলি ছোঁড়েননি। উল্টো আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হাত থেকে আন্দোলনকারীদের রক্ষা করেছেন।

তাই ৪ আগস্ট বিকেলেই শেরপুর ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ এসআই নীয়াজ শরীফকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান আন্দোলনকারীরা। ৪ আগস্টের ভূমিকার কারণেই পরদিন শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরও স্থানীয় থানায় কোনো হামলা হয়নি।

এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের শেরপুরের আজাদ বখসত উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল শিহাব আহাম্মেদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই আমি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি। আন্দোলন চলাকালে এই এলাকায় পুলিশ কখনোই আক্রমনাত্বক হয়নি।

তাদের নিরপেক্ষ ও বন্ধুভাবাপন্ন অবস্থানের কারণেই সহিংসতা এড়াতে পেড়েছি আমরা। স্থানীয় পুলিশ, বিশেষ করে শেরপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ যিনি আছেন তিনি সবসময়ই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি ছাত্রদের ভাঙচুর ও সহিংসতা থেকে দূরে থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন। তার নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাও আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হওয়ার সাহস পায়নি।

শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অলি আহাম্মেদও জানালেন একই কথা। তিনি বলেন, সারা দেশে পুলিশ যখন আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে, তখন আমরা আমাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি। কারণ স্থানীয় পুলিশ ছিল পুরোপুরি নিরপেক্ষ। তারাতো গুলি চালায়ইনি, উল্টো ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদেরও সেই সুযোগ দেয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নিয়াজ শরীফ বলেন, সারা দেশ যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সহিংস হয়ে উঠেছিল তখনও শেরপুর ছিল শান্ত। কোনো সহিংসতা ছাড়াই আন্দোলনকারীরা তাদের কর্মসূচি পালনের করতে পেরেছে। আন্দোলনের সময় পুলিশের নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণেই সরকার পতনের পরও এখানে কোনো থানা বা ফাঁড়িতে হামলা হয়নি। উল্টো হামলা যাতে না হয়, সেজন্য পাহারা দিয়েছে ছাত্ররা।

তিনি আরো বলেন, আমি সবসময়ই পুলিশের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালনের চেষ্টা করি। কারো পক্ষে অবস্থান না নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সমস্যার সমাধান করি। আমার মনে হয় সাধারণ মানুষ সবসময়ই পুলিশের এই নিরপেক্ষ অবস্থান আশা করে।

শুধু শেরপুরই নয়, রাজশাহীর চারঘাট থানায়ও পুলিশের কোনো স্থাপনা হামলার শিকার হয়নি। স্থানীয়রা জানান, এই থানার পুলিশ জনগণের বিপক্ষে যায়নি, তাই জনগণও তাদের বিপক্ষে যায়নি। পুলিশের দায়িত্বতো এমনই হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে চারাঘাট থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই নূর ইসলাম বলেন, প্রত্যেক মানুষেরই অধিকার আছে শান্তিপূর্ণ ভাবে নিজের দাবি জানানোর। আমি সাধারণ মানুষের এই অধিকারকে সবসময়ই সম্মান করি। এখানে আন্দোলনকারীরা সহিংস হয়নি, তাই পুলিশেরও আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। চারাঘাটে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার পেছনে আমি স্থানীয় মানুষের অনেক অবদান রয়েছে।