‘রগকাটা শিবিরের’ সেই সব ত্রাসের দিন

আপডেট: আগস্ট ৩, ২০২৪, ১২:১১ অপরাহ্ণ


সোনার দেশ ডেস্ক :


২০১৩ সালের ২২ অগাস্ট রাত সাড়ে ৯টা। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন তুহিন একটি অনুষ্ঠান শেষে সৈয়দ আমীর আলী হল থেকে মোটরসাইকেলে মাদার বখস হলে ফিরছিলেন। সঙ্গে আরও পাঁচ-ছয় সহপাঠী ছিলেন।

সৈয়দ আমীর আলী হলের পাশের রাস্তায় প্রাধ্যক্ষ বাসভবনের সামনে পৌঁছালে ছাত্রশিবিরের তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (পরে সাংগঠনিক সম্পাদক) হাফিজের নেতৃত্বে আট থেকে ১০ জন মোটরসাইকেলে এসে তাদের লক্ষ্য করে প্রথমে হাতবোমা নিক্ষেপ করে; পরে গুলি চালায়।

তাদের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক শামসুজ্জামান সরকার শাওন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তুহিন তাকে ধরতে গেলে প্রথম চাপাতি দিয়ে তার মাথায় কোপ দেওয়া হয়। পরপর তারা তার ডান হাত ও ডান পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়।

সেদিনের হামলার কথা স্মরণ করে তুহিন বলছিলেন, “চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ডান হাতের সব আঙুল কেটে ফেলে। তারা আমার তর্জনী আঙুল ছিড়ে নিয়ে চলে যায়। পরে অন্য আঙুলগুলো অপারেশন করে জোড়া দেওয়া হলেও তর্জনী পাওয়া যায়নি।”

অনেক চিকিৎসার পর মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা তুহিন বলছেন, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তার ক্যাম্পাসে অন্তত ১১ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। হত্যা করা হয় চার ছাত্রলীগ নেতাকে।

শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়; দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ইসলামী ছাত্রশিবিরের এমন নৃশংসতার সাক্ষী হয়েছে।
আশি থেকে শুরু করে পরের তিন দশক অবধি জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মত দলগুলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একচ্ছত্র ‘ভয়ের-রাজত্ব’ কয়েম করেছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির।

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে নানা সময়ে বারবার ছাত্রশিবিরের নৃশংসতার শিকার হয়েছেন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র সমাজ কেউ বাদ যায়নি। রক্ষা পাননি প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকরাও।

ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে খুনে বাহিনী আলবদরের সম্পর্ক আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত এই বাহিনীটি গড়ে তোলে জামায়াতের সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। স্বাধীন বাংলাদেশে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় জাময়াত রাজনীতিতে ফেরার পাশাপাশি ফেরে তার ছাত্র সংগঠনও। তবে ইসলামী ছাত্র সংঘের বদলে নাম রাখা হয় ইসলামী ছাত্র শিবির।

একাত্তরের খুনে বাহিনী আলবদর বাহিনী গড়ে তুলেছিল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এই বাহিনীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীসহ চার জন ফাঁসিতে ঝুলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নতুন নাম ইসলামী ছাত্র শিবির নিয়ে আসে জামায়াত।

একাত্তরের খুনে বাহিনী আলবদর বাহিনী গড়ে তুলেছিল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এই বাহিনীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীসহ চার জন ফাঁসিতে ঝুলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নতুন নাম ইসলামী ছাত্র শিবির নিয়ে আসে জামায়াত।

একাত্তরে মানতবারোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের যে পাঁচ নেতার ফাঁসি হয়েছে, তাদের চারজনই ইসলামী ছাত্র সংঘ ও ছিলেন আলবদর বাহিনীর নেতা। তারা হলেন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী।

আরেক আলবদর কমান্ডার এটিএম আজহারুল ইসলামেরও ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তবে আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় সাজা কার্যকর এখনও আটকে আছে।

শিবিরের ‘মডেল’
শিবিরের নৃশংসতার ‘মডেল’ ছিল হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া; এ কারণে সংগঠনটিকে ‘রগ-কাটা শিবির’ বলতেন অন্য দলের নেতাকর্মীরা।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর এই ছাত্রসংগঠনটির হাতে বহু শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকে অঙ্গহানি হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। শিবিরের রোষানলে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি।

স্বাধীন দেশে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘অবরুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে’ ইসলামী ছাত্রশিবির একটি ‘মূর্তিমান আতঙ্কে’ পরিণত হয়েছিল। নিজের ভাবাদর্শের দল ক্ষমতায় না থাকার পরেও কীভাবে ছাত্রশিবির এমন আধিপত্য দিনের পর দিন ধরে রেখেছিল?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি রাগিব আহসান মুন্না মনে করেন, শিবির ওই আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিল দুটো কারণে।

“প্রথমত, আশির দশকের প্রায় পুরোটা সময় ইসলামী ছাত্রশিবির সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের সমর্থন পেয়েছে। সামরিক নেতৃত্ব তাদেরকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ব্যবহার করেছে। পরে তো তারা বিএনপির সমর্থন পেয়েছে আর আওয়ামী লীগের মত দলকেও ব্যবহার করেছে।

“দ্বিতীয়ত, ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় তারা বিয়েশাদি করে ঘরজামাই থেকেই শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়েছে। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি রাজশাহীর ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ছিল।”

ছাত্র মৈত্রীর সাবেক এই সভাপতি বলেন, এটা শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সবগুলো ক্যাম্পাসেই শিবির এই ‘মডেল’ চালু করেছিল। যখনই প্রয়োজন হত, সেখান থেকে বহিরাগতদের এনে হল দখল বা ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালাত।

একাত্তরে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত’ জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে বৃহস্পতিবার ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ চালানোর অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী জামায়াত এবং এর সকল সহযোগী সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা জামায়াতকে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। পরে জিয়াউর রহমানের আমলে তারা রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়।

দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল তখন থেকেই। ৪৫ বছর পর সেই দাবি পূরণ হল, যদিও যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতের বিচারের দাবি এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের ঘোষণাকে অনেকে স্বাগত জানালেও তাদের নির্যাতনের শিকার অনেকে আক্ষেপ করে বলেছেন, কাজটা হল, তবে অনেক দেরিতে।

তারা সতর্ক করে বলছেন, জামায়াত-শিবির নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ‘মরণকামড়’ দেওয়ার চেষ্টা করতে পরে।
‘প্রথমে কোপায়, তারপর হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়’

২০১৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন টগর মোহাম্মদ সালেহ। তিনি মাদার বখস হলে থাকতেন। রাজনৈতিক কারণেই শিবির তাকে ‘টার্গেট’ করে ফেলেছিল।

টগর বলছিলেন, “একদিন হল থেকে বন্ধু ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাসুদকে নিয়ে রিকশায় বের হই। ওরা আগে থেকেই রেকি করে রাখে, আমরা কোনদিকে যেতে পারি। জিয়া হলের পাশেই আমাদের রিকশা আটকায়। ককটেল আর ফাঁকা গুলি করে। দুই দিক থেকে এসে আমাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।

“আমার শরীরে ২০ থেকে ২৫টা কোপ দেয়। তারপর রগ কেটে দেয়। আমি দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় উঠে দাঁড়াতে পারলেও আমার বন্ধু মাসুদ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।”

আপনার দল ক্ষমতায় ছিল, তারপরেও শিবির সেখানে এইরকম দাপট কীভাবে দেখাত- এমন প্রশ্নের জবাবে টগর বলেন, “দেখুন, শিবিরের মূল শক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকা। সেখানে তারা বিয়েসাদি করে শক্ত ঘাঁটি বানিয়ে ফেলে। শিবিরের ছেলেরা সেখানকার মেয়েদের বিয়ে করে ঘরজামাই থাকতে শুরু করে। এটা তাদের একটা মডেল ছিল।”

সেই আবদুল্লাহ আল মাসুদ এখন পঙ্গু। ছাত্রশিবিরের ‘ক্যাডাররা’ ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাসুদের ডান পা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সেই সঙ্গে কেটে দেওয়া হয়েছিল দুই হাতের রগ।

জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, “জামায়াত-শিবিরকে যদি আরও এক দশক আগে নিষিদ্ধ করা হত তাহলে হয়ত আমি বা আমার মত আরও অনেকেই শিবিরের হাত থেকে বেঁচে যেতাম।”

শিবির কর্মীদের হাতে নিহত জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আশির দশকে ঘটা এসব হত্যা ও নির্মম নির্যাতনের বিচার হয়নি কখনো।
শিবির কর্মীদের হাতে নিহত জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আশির দশকে ঘটা এসব হত্যা ও নির্মম নির্যাতনের বিচার হয়নি কখনো।
২০০৪ সালে শিবিরের হামলার শিকার হয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এস এম চন্দন।

সেই বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “আমি তখন মাস্টার্সের ছাত্র। ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবরের ঘটনা। সেদিন রাতে রাবির মেয়েদের ‘তাপসী-রাবেয়া’ হলে কিছু ছেলে ঢোকার অভিযোগ ওঠে। ঘটনার প্রতিবাদে মেয়েরা উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে। তখন আমরাও প্রতিবাদ জানাই।

“এর জের ধরে ২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে রিকশা থেকে নামিয়ে আমাকে রড দিয়ে পিটিয়ে দুই পা এবং এক হাত গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর দীর্ঘ নয় মাস ভারতে চিকিৎসা শেষে আমি দেশে ফিরি। প্রায় ২০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনও শারীরিক জটিলতা রয়ে গেছে।”

মো. আসাদুজ্জামান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থান বিভাগের ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্রশিবিরে নির্যাতনে ‘দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে’ তিনি তার শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি।
শিবিরের হামলায় খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ফারুক হোসেন। একই সেশনের বাংলা বিভাগের ছাত্র সাইফুর রহমান বাদশার পায়ের রগ কেটে দেয় তারা।

২০০৪-০৫ সেশনের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ফিরোজ হোসেনেরও পায়ের রগ কেটে দেয় ছাত্রশিবির।
‘মেরে ফেলে রাখে যাতে চিকিৎসা না করতে পারি’

রংপুর কারমাইকেল কলেজকে কেন্দ্র করেও ছাত্রশিবির শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলছিল। কলেজের হোস্টেলগুলো তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। কলেজের পাশের কলেজপাড়া, দর্শনা, মর্ডান মোড়সহ আশপাশের এলাকায় নব্বই ও তার পরের সময়ে ছাত্রশিবিরের প্রচুর ছেলে বিয়ে করে আত্মীয়তা তৈরি করেন। কলেজে সমস্যা হলেই এসব এলাকা থেকে বহিরাগতদের নিয়ে আসত।

রংপুর কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ মামুন বলছিলেন, তিনি ১৯৮৯ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন। তখন ছাত্রশিবিরের ব্যাপক তাণ্ডব। কেউ কিছু বললে রেহাই দিত না।

১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে তার ওপর হামলা হয়। আগের দিন রংপুর শহরে একজন দোকানদারকে মারধর করে ছাত্রশিবিরের কয়েকটি ছেলে। তারা তার প্রতিবাদ করেছিলেন।

মামুন বলছিলেন, “পরদিন কলেজে পা দিয়েই বুঝতে পারি, ওরা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। আমি ছাত্রলীগের যারা নেতাকর্মী ছিল সবাই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে বলি। কারণ, আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। সবাইকে বের করে দিয়ে জিএল হোস্টেলের সামনে দিয়ে মোটরসাইকেলে ফিরছিলাম। তখনি শিবিরের ২৫-৩০ জন আমাকে ধরে হলের ভেতরে নিয়ে যায়। বলে, ‘ছাত্রলীগ করস, আয় তোরে বানায়া দিচ্ছি’। মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়।

“তার পর দা দিয়ে কোপানো আর রড দিয়ে পেটানো শুরু করে। আমি মেঝেতে পড়ে যাই। একবার দরজায় গিয়ে জোরে আঘাত করলে সেটির ছিটকানি ভেঙে যায়। তখন সাধারণ ছাত্ররা বিষয়টি বুঝতে পেরে শিক্ষকদের খবর দেয়। তারা আমাকে উদ্ধার করতে আসে।
“কিন্তু ওরা তো চিকিৎসা করতে দেবে না। ওটাই ছিল ওদের কৌশল। মেরে ফেলে রাখবে। নিজেরা পাহারা দেবে, যে পর্যন্ত না বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। ওদের বাধার মধ্যেই শিক্ষক-ছাত্ররা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।”

মামুন বলছিলেন, “সেদিন বেঁচে যাই বটে; কিন্তু চিরকালের মত আমি পঙ্গু হয়ে গেছি।”
ছাত্র ইউনিয়নের কলেজ শাখার সভাপতি কামরুজ্জামান ছিলেন জিএল হোস্টেলের ছাত্র। তিনিও ছাত্রশিবিরের হামলার শিকার হন।
তিনি বলছিলেন, “১৯৮৯ সালের জানুয়ারির দিকের ঘটনা। শিবির হল দখল করতে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের নিয়ে আসে। আমরা সব হোস্টেলে খবর পাঠাই, অধ্যক্ষকে জানাই। তারপর ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে মিছিল করে করি।

“সেই মিছিলে হামলা চালায় শিবিরের ছেলেরা। আমাকে রাস্তায় ফেলে পেটাল। আহত হল প্রায় ১৫ জন। হোস্টেলের ১৩-১৪টা কক্ষ পুড়িয়ে দেয়। পরদিন সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা ছিল, সেটি স্থগিত হয়ে গেল। শিবির প্রকাশ্যে ঘোষণা দিল, ক্যাম্পাসে দেখলেই আমাকে মেরে ফেলবে। পরে তো হোস্টেলে পুলিশ পাহারা বসল। আট-নয় মাস ছিল।”

কামরুজ্জামান বলেন, “সে সময় শিবির অনেককে পরীক্ষা দিতে দেয়নি। আমি অনার্সের ভাইভা দিতে গেছি, আমাকে টেনে নিয়ে যায়। পরে শিক্ষকরা এসে রক্ষা করে। হোস্টেলে থেকে আমি পরীক্ষা দিতে পারিনি। পুলিশের নিরাপত্তায় আমরা পরীক্ষা দিতাম। আরও কত নির্যাতন যে সহ্য করছি সেটা বলার মত না।”

‘আমার টাকায় ভাত খেয়ে শিবির আমারই কব্জি কেটে নেয়’
ছাত্রশিবির যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম শুরু করে কাছাকাছি সময়ে তারা নগরীর অপরাপর শীর্ষ কলেজগুলোতেও সক্রিয় হয়। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের যাত্রা শুরু। ১৯৮০ সালে প্রথম চট্টগ্রাম কলেজে হামলা করে দখলে নেয়। এরপর একে একে মহসিন কলেজ, কমার্স কলেজের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে শিবিরের হামলায় প্রথম শহীদ হন সিটি কলেজ ছাত্রলীগের এজিএস তবারক হোসেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে শিবিরের ক্যাডাররা জবাই করে হত্যা করে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী শাহাদাত হোসেনকে।

চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি এলাকায় শিবির তাদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তিন দশকে সরকারের পরিবর্তন হলেও ছাত্রশিবিরের আধিপত্যে ভাটা পড়েনি।

১৯৮৬ সালের কথা। সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায়। তখন জাতীয় ছাত্র সমাজের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন আবদুল হামিদ। আগের দিন ঢাকায় এইচ এম এরশাদ ও মওদুদ আহমদের উপস্থিতিতে সভা করে ক্যাম্পাসে ফেরেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে থাকতেন আলাওল হলে। শিবিরের ক্যাডাররা তার ডান হাতের কব্জি কেটে নেয়, গুলিও করে।

শিবির ক্যাডারদের ওই হিংস্রতার ঘটনা স্মরণ করে হামিদ বলেন, ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর দুপুরে শাহজালাল হলের সামনে আরও একজনসহ খাবার খেতে যান। ওইখানে আগে থেকেই অবস্থানরত শিবিরের কয়েকজন নেতাকর্মী তার সঙ্গে কথা বলে ভাত খেতে চান। তিনি সরল মনেই তাদের নিয়ে ভাত খেতে বসেন এবং নিজেই বিল দেন।

আবদুল হামিদ বলেন, “ওই সময়ে চাকসু নির্বাচনের জন্য শিবিরবিরোধী প্যানেল দিতে ছাত্রসমাজসহ ১৩টি সংগঠনের মতৈক্য হয়। সে কারণে শিবিরের ছেলেরা আমার ওপর খ্যাপা ছিল।

“ভাত খেয়ে আলাউল হলের দিকে রিকশায় করে যাচ্ছিলাম। যাদের আমি ভাত খাওয়ালাম, ওরাই দেখি আমার ওপর হামলা করেছে। প্রথমে গুলি করলে সেটা মুখে লাগে। এরপরও কিছু না হওয়ায় তারা মাটিতে ফেলে কুপিয়ে আহত করে ডান হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।”

আবদুল হামিদ বলেন, “তারা মনে করেছিল আমি মরে গেছি। সে কারণে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। পরে লোকজন তুলে হাটহাজারী থানায় নিয়ে গেলে অ্যাম্বুল্যান্সে করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ১২ দিন পর হাতের অপারেশন করা হয়।”

জামায়াত ও শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ায় তিনি খুশি। বলছিলেন, “আমার জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিল। পঙ্গু অবস্থায় কোনো রকমে বেঁচে আছি। ওই ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে ওঠি।”

‘দেয়াল লেখায় হামলা, মৃত ভেবে ফেলে যায়’
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে সরকারি কমার্স কলেজে সন্ত্রাসবিরোধী দেওয়াল লিখন করতে গিয়ে ছাত্রশিবিরের হামলার শিকার হন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা দেবপ্রিয় বড়ুয়া অয়ন।

শিবিরের ক্যাডাররা তাকে কোপানোর পর দুই পায়ের গোড়ার রগ কেটে দেয়, ভেঙে দেয় দুই হাত। সাড়ে তিন মাস দেশে চিকিৎসার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়াতেও পাঠানো হয়।

১৯৮৭ সালের ২৯ জানুয়ারি রাতে শিবিরের হামলার ক্ষত দেবপ্রিয় বড়ুয়া এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। বাম পা এখনো তাকে দেবে চলতে হয়।
ওই সময় তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ডবলমুরিং থানা কমিটির সভাপতি। আগ্রাবাদের কমার্স কলেজের দেয়ালে ওইদিন রাতে ‘অস্ত্র নয় বই চাই, সন্ত্রাস নয় শান্তি চাই’ এই স্লোগান লিখছিলেন।

দেবপ্রিয় স্মৃতি হাতড়ে বলেন, “লেখার সময় শিবিরের ক্যাডাররা হঠাৎ আক্রমণ করে। তখন সঙ্গে থাকা অন্যরা পালাতে পারলেও আমি আটকা পড়ি। আমাকে তারা ছুরি, হকিস্টিক ও লোহা দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যায়।

“পথের এক ব্যবসায়ী ট্যাক্সি করে আমাকে হাসপাতাল পৌঁছে দিয়েছিল। শিবিরের ছেলেরা আমার দুই পায়ের রগ কেটে দেয়, দুই হাত ভেঙে দেয়।”
প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “তিন মাস হাসপাতালে থেকেও পুরো ভালো হতে পারিনি। ডান হাতে লিখতে পারতাম না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাম হাতে লেখা প্র্যাক্টিস করেছি। পরে পার্টির (সিপিবি) পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল।”
বর্তমানে চট্টগ্রামের বেসরকারি একটি কলেজের উপাধক্ষ্য দেবপ্রিয় বড়ুয়া বলেন, “আমি এখনো দুই পায়ের জোরে দাঁড়াতে পারি না। ওই ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। কিন্তু আদর্শ থেকে সরিনি।

“জামায়াতের রাজনীতি সরকার নিষিদ্ধ করেছে ভালো, তবে তা অনেক আগেই করা দরকার ছিল।”
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহী প্রতিনিধি ও চট্টগ্রাম ব্যুরোর প্রতিবেদকরা।]
তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Exit mobile version