রবি ঠাকুরের বিবিধ প্রসঙ্গ

আপডেট: আগস্ট ১০, ২০১৭, ১:১৭ পূর্বাহ্ণ

শুভ্রারানী চন্দ


রবি ঠাকুরের সৃষ্টির ভা-ার এত বিচিত্র এবং বিশাল যেন কোনো কিছুই এড়িয়ে যায় নি তাঁর তীক্ষ্ম দৃষ্টি। মানুষের ভাবনার জগৎকে আলোড়িত করে, তার ভেতরের সুপ্ত সত্তাকে জাগিয়ে তোলে তাঁর সূক্ষ্ম ও অতি সাধারণ ভাষায় লেখা বিষয়গুলো। এ স্বল্প পরিসরে অনেক বিষয় সম্পর্কে জানা সম্ভব নয় বলেই খুব সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করার ক্ষুদ্র প্রয়াস ব্যক্ত করছি।
মনের বাগান-বাড়ি
এখানে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত ভালোবাসা নিয়ে তাঁর সুন্দর-সুকোমল মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন সাবলিলভাবে। নিজের যা কিছু ভালো তা-ই সম্পন্ন করা হচ্ছে- ভালোবাসা। যাতে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো কষ্ট দেওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন-“যাহাকে তুমি ভালোবাস তাহাকে ফুল দাও, কাঁটা দিও না; তোমার হৃদয় সরোবরের পদ্ম দাও, পঙ্ক দিও না। হাসির হীরা দাও, অশ্রুর মুক্তা দাও, হাসির বিদ্যুৎ দিও না, অশ্রুর বাদল দিও না।” ভালোবাসা সমুদ্র মন্থনের মত। সমুদ্র মন্থন করে যে অমৃত পাওয়া যায় তা দেবতাদের ভোগ্য অসুরের নয়। ভালোবাসাও তেমনি। হৃদয় মন্থন করে যে অমৃতটুকু পাওয়া যায় সেটুকু নিবেদন করা উচিৎ ভালোবাসার মানুষটিকে। ভালোবাসার মানুষটিকে দেওয়া উচিৎ সর্বোচ্চ সম্মানের আসন যেখানে কোন রোগ-শোক, চাওয়া-পাওয়ার টানাপোড়েন কিংবা কোন অশুভের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু সংসারে এমন অনেক মানুষ আছে যারা ভালোবাসা যাচাই করার জন্য নানাভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়ানোর পক্ষে মত দেয়। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা তাতে থাকে না।
ভালোবাসার মানুষটির কাছে যদি মনে কদর্যতা থাকে সেটি গোপন করাই ভালো। অনেকেই ভালোবাসার মানুষটির মনের একান্ত ছোট-খাটো অনুভূতিগুলো উপেক্ষা করে যা প্রকারান্তরে তার অনাদর এবং এ অনাদরই এক সময় এ সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর অপমৃত্যু ঘটায়।
বাইরে বেরোলে অনেক পরিচিতজনের সাথে আমাদের দেখা হয়- যাদের কারো সাথে সৌজন্য বিনিময় হয়। কারো সাথে বা অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলাপ হয়- এগুলো নিতান্তই লৌকিক। কিন্তু আমাদের জীবনে এমন কারো অস্তিত্ব থাকা উচিৎ যে আমার একান্ত আপনার, যার আদর্শ আমার কাছে গ্রহণীয় এবং আমার আদর্শও যার অনুকরণীয়। সমস্ত জঞ্জাল, সব কলুষতা ঝেড়ে মুছে এমন পরিস্কার রাখা উচিৎ যাতে মনের মানুষটি সহজেই সেখানে প্রবেশ করতে পারে। মনের বাগানটি হতে হবে নানা ফুলের (গুনের) সমাহারে সমৃদ্ধ যা উভয়ের জন্য স্বাস্থ্যকর। ভালোবাসার অর্থ- অন্যকে ভালো বাসস্থান দেওয়া, অন্যকে মনের সর্বাপেক্ষা ভালো জায়গায় স্থাপন করা।’
গরীব হইবার সামর্থ্য
বিষয়টি একটু গুরুগম্ভীর। মানুষ ধনী হতে চায় সবাই এটা জানে। কিন্তু গরীব হবার সামর্থ্য বিষয়টি কেমন? হ্যাঁ, এ পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের গরীব-মানুষি করার সামর্থ্য নেই। কিন্তু সংসারে এমন মানুষও আছে যারা নিঃসঙ্কোচে নিজের দারিদ্র প্রকাশ করতে পারে। কেউ যদি নিজেকে বড় মানুষ ভাবে তবে তার  বড় মানুষি বজায় রাখতে অনেক ঠাঁটবাট বজায় রাখতে হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কি তারা বড় মানুষ? যারা যে কোনো বিষয় সহজে আয়ত্ত্ব করতে পারে তাদের কাছে তা নিতান্তই গৌণ বিষয়। কিন্তু যারা তা পারে না তাদের জন্য সেটা বিষম উপদ্রব। যেমন- যারা সহজে খাবার খেয়ে হজম করতে পারে, তাদের খাবারের শক্তি সহজে শরীরে রক্ত তৈরি করে জীবনীশক্তি বাড়ায়। কিন্তু যাদের হজমে সমস্যা আছে তাদের মনে সব সময় এ চিন্তা কাজ করে- এটা খাওয়া ঠিক না, ওটা বেশি খেয়েছি ইত্যাদি।
অনেকের টাকা থাকে, কিন্তু তারা নিঃশব্দে টাকা হজম করতে পারে না। এদেরকে বড় মানুষ বলা চলে না। শুধুমাত্র টাকা আর জমি জমা থাকলেই কেউ বড় মানুষ হয় না। বড় মানুষি দেখানোর জন্য প্রতিভা থাকা দরকার। এদের সেটা নেই। ফলে লোক দেখানোর জন্য তারা ঘরে ছবি টাঙ্গিয়ে ঘরকে দোকান ঘর বানিয়ে ফেলে শিল্পবোধ তাদের নেই। কখনো বা এরা টাকা দিয়ে গাইয়ে-বাজিয়ে এনে প্রতিবেশীদের কানে তালা লাগিয়ে দেয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে গান বাজনা উপভোগ করার ক্ষমতা তাদের থাকে না।
রবি ঠাকুর ভাষায়, “এই সকল চিনির বদলদিগকে প্রকৃতি গরীব মনুষ্য করিয়া গড়িয়াছেন। কেবল কতকগুলো জমিদারী ও টাকার থলিতে বেচারাদিগকে বড়ো মানুষ করিবে কি করিয়া?”
কিন্তু-ওায়ালা
স্বভাবত যারা গরীব, তারাই অহংকারী হয়ে থাকে। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক এমন গরীব আছে যারা প্রাণ খুলে অন্যের প্রশংসা করতে জানে না। সাধারণতঃ যাদের নিজের কিছু নেই তারাই এ স্বভাবের হয়ে থাকে। অনেককেই দেখা যায় কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলবে-
উনি ভালো মানুষ কিন্তু ওনার… ভাবখানা এমন ইচ্ছে করলেই উনি ওই মহান ব্যক্তির চেয়েও মহান হতে পারেন। অথবা কারো লেখা পড়ে এমন মন্তব্য করবেন। উনার লেখা ভালো কিন্তু ওর চেয়েও ভালো লেখা আছে। থাকতেই পারে ভালো লেখা। কিন্তু যখন কারো প্রশংসা করছে একটু কাঁটা বিধিয়ে রাখছে। এ কিন্তুর কারণ আর কিছুই নয়, এটা হচ্ছে মানুষের ভেতরের অপরিতৃপ্ত ক্ষুধিত অহংকার। যারা কিন্তু দিয়ে অন্যের যশ ঢেকে রাখতে চায় তারা বড় অসুখি।
লেখকের ভাষায়- “ইহাদের এমন স্বভাব নাই যে পরের প্রশংসা করিতে পারে, এমন শিক্ষা নাই যে, পরের প্রশংসা করিতে পারে, এমন সম্বল নাই যে পরের প্রশংসা করতে পারে- যে দিকে চাহি সে দিকেই দারিদ্র্য’  পৃথিবীতে এমন অনেক বড় মানুষ আছে যারা পরের প্রশংসা করবার মতো সম্বলের অধিকারী কিন্তু এমন হতভাগ্য দরিদ্র অহংকারী আছে যে নিজের অহংকার করতেও পারে না আবার অন্যের প্রশংসা করতেও পারে না। এ কিন্তুগুলো ভিক্ষার ঝুলির মতো যাতে মানুষ অন্যের যশের অংশ চায়। কিন্তু পীড়িত লোকের প্রশংসায় কারো কষ্ট পাওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু রোগ থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে প্রকৃত যশ অর্জন করা। কিন্তু ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারলে মানুষের কাছে মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে, পরস্পরের কাছে আসার সুযোগ তৈরি হয়।
রবি ঠাকুরের সৃষ্টির ভা-ার থেকে আমরা যত নিতে পারছি ততই ঋদ্ধ হচ্ছি। কিন্তু সে ধনভা-ার শেষ হবার নয়। ২২শে শ্রাবণে তাঁর আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের সাথে সাথে এ আশীর্বাদ চাই তাঁর বিপুল সৃষ্টি ভা-ারের কণামাত্র আমাদের হৃদয়ে প্রোথিত করে যেন মানবজীবন ধন্য করতে পারি।