শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
গোলাম মোস্তফা অভি
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বর্ষা ঋতুকে নিয়ে প্রচুর কবিতা, গল্প, গান লিখেছেন। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কখনো কখনো আবার বর্ষার কবিও বলা হয়ে থাকে। তিনি বর্ষাঋতু এবং বৃষ্টিকে তাঁর কবিতায় সাজিয়েছেন বিচিত্রভাবে। বর্ষা কখনো প্রকৃতির রূপ বর্ণনার, কখনো নিরেট প্রেমের অনুঘটক। আবার বর্ষা কখনো হয় স্বয়ং নারী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় লিখেছেনÑ
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়।
এই কবিতাটিকে বিশ্লেষণ করলে কবির বর্ষা নিয়ে যে আলংকারিক মনোভাব ফুটেছে তা সহজেই অনুমেয়।
বাদলের বরিষণে আজ পাঠশালা ছুটি হয়েছে, বিদ্যার্থী তার পাঠ বন্ধ করে জানালায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির বর্ষণমুখর অবস্থা উপভোগ করছে। সন্ন্যাসী তার মৃদঙ্গ বাজনা থামিয়েছে, প্রবাসী স্বামী তার বিরহী বধূর সাথে প্রিয় মিলনের অভিপ্রায়ে বাড়ি অভিমূখে যাত্রা করেছে। দুই দিকে দুই বিরহ ব্যাকুল হয়ে চাতকের মতো তাকিয়ে আছে। একদিকে যারা ঘরে আছে তারা প্রবাসী প্রিয়র অপেক্ষায় বারবার মন উচাটন করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। রমণীর বৃষ্টি দেখে মনের রাজ্য দোলাচলে সদা রমনে ব্যাকুল হয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি সে এলো। অন্যদিকে যে পুরুষ ঘরে প্রিয় রমণী রেখে দূর দেশে কাজে ব্যস্ত আজ বর্ষণমুখর দিনে তার মনেও ভাব জমা হয়েছে। সে আজ রমণীর প্রিয় রমনের ব্যকুলতায় কাজের থির হারিয়ে ফেলে। নর-নারীর মন বিরহের বিষাদ সূরে ভরে যায়।
কবি বলেন, বৃষ্টির দিনে যাকে ভালোবাসি তার দু’হাত চেপে ধরে বলতে ইচ্ছা করে জন্মাজন্মান্তরে তুমি আমার। আজ সমস্ত আকাশ মরিয়া হয়ে উঠেছে, বৃষ্টিভেজা আকাশ আজ পৃথিবীর বুকে কান পেতে আছে। তাই বর্ষার মৃদঙ্গনৃত্যে মনে হয় সময় যেন বয়ে যায়। প্রিয়াকে আজ যে কথা বলবার আছে সব বলে দিতে হবে। কোথাও কোনো শূন্য রাখা যাবে না। শেষ কথার ইতি হলে রমনে মত্ত হবো। এমন সুখ আর কোন্ ঋতুতে আসতে পারে!
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘনো তমসায়।
কবি বলেন, প্রেমিক প্রেয়সীকে একান্ত আপন করে পেতে চায়। এই বাদল বর্ষণে সমাজ সংসার সব আজ তুচ্ছ মনে হয়। কেউ যদি আপন সুরে ভালোবাসার মিষ্টি কথাটি বলে তবে সে কথা আজ কানে অসঙ্গতির সুর হয়ে বাজে। কোথায় যেন টান পড়ে আছে। এই বিরহে এই বর্ষায় শুধু প্রিয়তমাকেই বলতে মন চায়Ñ বড় ভালোবাসি গো, ওহে ভালোবাসি খুব তোমায়।
আবার ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতায় লিখেছেনÑ
এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসাÑ
দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
গীতময় তরুলতিকা।
‘বর্ষার রূপ’ কবিতায় কবি মানবজীবন প্রবাহকে বর্ষার সাথে তুলনা করেছেন। এছাড়া কবি বর্ষার চলে যাওয়াকে তুলে ধরেছেন তার ‘মেঘমুক্ত’ কবিতায়। মেঘ ছুটে গেল, নাই গো বাদল, আয় গো আয় / আজিকে সকালে শিথিল কোমল বহিছে বায়।
‘ভালো করে বলে যাও’ কবিতায় লিখেছেনÑ
আজি অন্ধতামসী নিশি।
মেঘের আড়ালে গগনের তারা
সবগুলি গেছে মিশি।
শুধু বাদলের বায় করি হায়-হায়
আকূলিছে দশ দিশি।
‘মেঘদূত’ কবিতায় লিখেছেনÑ
আবার হারায়ে যায়- হেরি চারি ধার
বৃষ্টি পড়ে অবিশ্রাম, ঘনায়ে আঁধার
আসিছে নির্জননিশা, প্রান্তরের শেষে
কেঁদে চলিয়াছে বায়ু অকূল-উদ্দেশ্যে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর জনপ্রিয় কবিতা ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’-এ লিখেছেনÑ
বাইরে কেবল জলের শব্দ
ঝুপ ঝুপ ঝুপ
দস্যি ছেলে গল্প শোনে
একেবারে চুপ।
এছাড়া ‘নববর্ষা’, ‘সোনার তরী’, ‘আষাঢ় সন্ধ্যা’, ‘আষাঢ়’ প্রভৃতিতে বর্ষা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন তিনি।