রাকাব একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বন্ধের দাবি, উত্তরবঙ্গে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে

আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২৪, ১:১৪ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:


বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) সাথে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। রোববার (১৪ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে রাজশাহী চেম্বার ভবনের মিলনায়তনে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক একীভূতকরণ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে বিকেবিকে দুর্বল ব্যাংক আখ্যা দিয়ে এর সাথে রাকাবকে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বন্ধের দাবি জানান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৩৭ বছরে ব্যাংকটি উত্তরবঙ্গ তথা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কৃষক ও সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের ব্যাংক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সরকার রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে একটি দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করে দেশের অন্যতম দুর্বলতম ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বাকেবি) সাথে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে রাজশাহী অঞ্চলের অগ্রসরমান কৃষি ব্যবস্থাপনা ও কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যার ফলে এই অঞ্চলের কৃষি ও কৃষক ন্যায্যতা হারাবে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, রাজশাহী কবিকুঞ্জের সভাপতি ও প্রতিরোধ কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক। তিনি বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের কৃষির অভুতপূর্ব উন্নয়নে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এ অঞ্চলের তথা সারা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় এই ব্যাংকটির অবদান অনস্বীকার্য। পরিকল্পিত উপায়ে জমির ব্যবহার এবং কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে রাকাব উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি দেশের জিডিপিতে উল্লেখজনক অবদান রাখছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের গর্ভজাত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের জন্ম। এর মূল লক্ষ্যই ছিল রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্য অর্জনে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক সরবে-নিরবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।

ব্যাংকের এই বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে কেবল মাত্র দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষির উন্নয়ন এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে। আমরা জানি, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য সবসময় মুনাফা অর্জন নয়- উভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে যা অবদান রেখেছে তা রাজশাহী অঞ্চলের কৃষির বিকাশ, সম্প্রসারণ ও উৎপাদন অগ্রগতি দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়।

প্রত্যক্ষ মুনাফা অর্জনে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সামান্য দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায় বটে; যা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থের সম্পূরক হলো ব্যাংকের পরোক্ষ অর্জন। সেই দিক বিবেচনায় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক অভুতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। সার্বিকভাবে এর অর্থমূল্য বিবেচনা করলে সেটা মুনাফা অর্জনের সীমা অতিক্রম করেছে বলে আমরা মনে করি।

সংবাদ সম্মেলনে রাকাবের উত্তরবঙ্গের ভূমিকা ও ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বলা হয়, রাকাব সৃষ্টির পর এ অঞ্চলে ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে উত্তরবঙ্গ দেশের শস্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৮ কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট এই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে উত্তরবঙ্গ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ হওয়ার পর অভ্যন্তরীণ গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে মাংসের চাহিদা সিংহভাগ মেটানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ যে তাজা মাছ বাজার থেকে ক্রয় করছেন তার সিংহভাগ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে উৎপাদিত। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

বিকেবি আমলে দেশের বৃহত্তর রংপুর মঙ্গাপীড়িত অঞ্চল ছিল। তবে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল আজ মঙ্গা কাটিয়ে দেশের শস্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। সেইসাথে কৃষকসহ সাধারণ জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নত হয়েছে। রাকাব কৃষি ঋণ বিতরণের পাশাপাশি অন্যান্য সকল ব্যাংকিং কর্মকা-ও যেমন: আমানত ব্যাংকিং, কৃষকদের ১০/- টাকার আমানত হিসাব খোলা, বিদ্যুৎ বিল কালেকশন, সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ করে থাকে।

রাকাব এ সকল সেবা গ্রামীণ অঞ্চলে জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঋণ কেলেঙ্কারি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, তবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে এ জাতীয় কোন অনিয়ম কখনই উত্থাপিত হয়নি।

লোকসান কাটিয়ে রাকাব এখন একটি মুনাফা অর্জনকারী ব্যাংক। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ২৪৫.৮৩ কোটি টাকা যা ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে হ্রাস পেয়ে ১৯৬.৪৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে রাকাব ৩.০০ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছে। অপরদিকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক-এ প্রতিবছর লোকসানের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেবলমাত্র ২০২২-২০২৩ অর্থবছরেই বিকেবি’র লোকসানের পরিমাণ ২৩৮৪.০০ কোটি টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরেও একই ধারা অব্যাহত রয়েছে মর্মে জানা যায়।

রাকাবে লোকসানি শাখার সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ব্যাংকটিতে লোকসানি শাখার সংখ্যা ছিল ৮৭টি, সর্বশেষ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৬০টি যা চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে হ্রাস পেয়ে ১২টিতে নেমে এসেছে। রাকাব-বিকেবি একীভূত হলে রাজশাহীতে অবস্থিত রাকাব-এর প্রধান কার্যালয়ের জন্য অনুমোদিত ৫০৮টি পদ বিলুপ্ত হবে। এছাড়া রাকাব-এ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ হতে জনবল নিয়োগ দেয়ার বিধান রয়েছে। বিকেবি ও রাকাব একীভূত হলে এতদাঞ্চলে চাকরি প্রত্যাশীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল, রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজশাহী মহানগরের সাবেক কমান্ডার ডা. আব্দুল মান্নান, ন্যাপ কেন্দ্রীয় সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাফিজুর রহমান খান আলম, চিকিৎসক তবিবুর রহমান শেখ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, রাজশাহী মহানগরের সাধারণ সম্পাদক কবি আরিফুল হক কুমার। রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহ-সভাপতি সুলতান মাহমুদ সুমন প্রমুখ।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ