নিজস্ব প্রতিবেদক:রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) কৃষকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়। ইউনিয়ন পর্যন্ত তারা কৃষকদের সেবা দিয়ে থাকে। রাজশাহী ও রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা ব্যাংক হিসেবে রাকাবকেই চেনে। আগামী জুনে মুনাফায় ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে ব্যাংকটি। সেই সাথে রয়েছে দক্ষ তরুণ এক ঝাক কর্মী। এমন অবস্থায় ডুবতে বসা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
রাকাব এ অঞ্চলের বিশেষায়িত ব্যাংক। দুটি ব্যাংক একীভূতের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিচ্ছেন না কেউ। প্রাথমিক আলোচনা শুনে হতাশায় ডুবেছেন রাকাবের কর্মকর্তারা। ব্যাংকের কর্মকর্তা আর অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিকেবির সঙ্গে একীভূত করা হলে রাকাবের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। কৃষকেরা এখন যেভাবে ঘরের কাছে সেবা পাচ্ছেন তা থেকে বঞ্চিত হবেন। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে উত্তরের কৃষিতে। তাই তারা ব্যাংকটিকে স্বতন্ত্র রাখার পক্ষেই মত দিচ্ছেন।
রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংক হওয়ায় সরকারি এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে নাম প্রকাশ করে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে রাকাবের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, রাকাবই এখন দেশের একমাত্র ব্যাংক। যারা কৃষকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় এখন এর শাখা রয়েছে ৩৮৩টি। কোনো কোনো ইউনিয়নে দুটি করেও শাখা আছে। শতভাগ শাখায় অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
ব্যাংকটির সাড়ে ৩ হাজার কর্মীর বড় অংশই বয়সে তরুণ। তারা সেবার মানসিকতায় কাজ করছেন। ব্যাংকের আইসিটি বিভাগও অনেক বেশি শক্তিশালী। এখন ‘রাকাব লেন্স’ নামের মোবাইল অ্যাপ দিয়ে রাকাবের একটি দক্ষ টিম সবগুলো শাখার কার্যক্রম সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে। সামগ্রিক তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেক শাখার ঋণ বিতরণ, আদায়, মুনাফা অর্জনসহ যাবতীয় তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে এই অ্যাপসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। কোথাও কোনো দুর্বলতা দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়। বিকেবি এসব সিস্টেমের অনেক দূরে। বিকেবির সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করলে রাকাব ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ১৯৭৩ সালে বিকেবি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষায়িত এ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষির উন্নয়নে ঋণ দেওয়ার জন্য। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে বিকেবি বড় ঋণ দেয়ার মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। আর্থিকভাবে নাজুক হয়ে পড়ে ব্যাংকটি। তার আগে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ভেঙে রাকাব প্রতিষ্ঠা হয়। ওই সময় রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের যেসব শাখা ছিল সেগুলোকে রাকাবকে দেওয়া হয়। এখন আবারও রাকাবকে বিকেবির সঙ্গে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এ নিয়ে গত ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দুই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করেন। দ্রুতই এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
দুই ব্যাংক একীভূতের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন রাকাবের বিভাগীয় নিরীক্ষা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোস্তাফিজুর রহমান সরকার। রাকাবের জন্ম ও রাজশাহীতে প্রধান কার্যালয় স্থাপনসহ ব্যাংকের নানা বিষয় খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। মোস্তাফিজুর রহমান তার লেখায় বলেছেন, এর আগে তিন বার বিকেবির সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করার প্রক্রিয়াও হয়েছিল। সে প্রক্রিয়া স্থগিত হওয়াও খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখেছেন, ‘এত বড় একটা সিদ্ধান্ত আরও সময় নিয়ে নেওয়া উচিত। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সম্ভাব্যতা যাচাই করা দরকার।
এই সিদ্ধান্ত নিতে খুব তাড়াহুড়ো করার প্রশ্ন তুলে তিনি লেখেন, দুটি ব্যাংকের আর্থিক সংস্কৃতি, সুরক্ষা, আচরণের ভেতর এখন অনেক তফাৎ। বিশেষ করে রাকাবের মূল কর্মশক্তি যারা তারা অনেক তরুণ এবং কমিটেড। তারা শুরু থেকেই মনের ভেতর আর্থিক যে অবয়ব নিয়ে এগিয়ে গেছেন, সেখানে বড় ধরনের হোঁচট খাবেন। নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেক সময় পার হয়ে যাবে। ফলে সব ধরনের ইতিবাচক গতি কমবে ও আর্থিক সুরক্ষা আরো নড়-বড়ে হয়ে পড়বে।
কেন এই সিদ্ধান্ত সে প্রশ্ন তুলে রাকাব’র এই কর্মকর্তা আরো লিখেন, ২টি ক্ষতি একসাথে হলে ক্ষতি কমে? বরং আরও বড় হয়। তারপর যদি এমন হতো বড়টির (বিকেবি) অবস্থা তুলনামূলক ভালো, তো হয়ত একটা আশা থাকত। সেটি (বিকেবি) তো প্রায়ই ডুবেই গেছে। বরং রাকাব বর্তমানে অনেক ভালো অবস্থায় আছে। কিছু অর্থনীতিবিদের বিশ্লেষণ পড়লাম। তারা কেউই উৎসাহ দেননি, বরং অনেকেই বিডিবিএলের ব্যর্থতার উদাহরণ দিয়েছেন। আশা করি, অনেক সমস্যা তৈরির আগে প্রধানমন্ত্রী আরও সময় নেবেন। তাতেই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, কৃষক, উৎপাদন স্থিতিশিলতা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য মঙ্গল।
এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে রাকাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সব ব্যাংকের মধ্যে রাকাব এখনও ভালো অবস্থানে আছে। দূর্বল ব্যাংকের সর্বশেষ যে তালিকা সেখানে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বিকেবির নাম থাকলেও রাকাবের নেই। বিকেবি তার নাজুক পরিস্থিতি কাটানোর জন্য অনেক দিন থেকে রাকাবের সঙ্গে একীভূত হওয়ার এই চেষ্টা করছিল। আমরা চুপ করে থাকলে ওরা সফল হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিকেবির পরিশোধিত মূলধন ৯০০ কোটি টাকা। ১ হাজার ৩৮টি শাখায় গ্রাহকের আমানত রয়েছে ৪০ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। এই আমানত থেকে ৩২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ২০ শতাংশ। গত বছর পর্যন্ত মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৬ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এদিকে, রাকাবের গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ। এরমধ্যে ব্যাংকে আমানত রাখা গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪৮ লাখ। আর ব্যাংকটি থেকে ঋণ নেওয়া গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ লাখ। চলতি অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে গত বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) পর্যন্ত ৩৮৩টি শাখা থেকে রাকাব ১০৩ কোটি ৩ লাখ টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। রাকাবের পরিশোধিত মূলধন ৮২৪ কোটি টাকা। এই ব্যাংকে কৃষকের আমানতের পরিমাণ ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটি ৭ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে বসে আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। খেলাপি ঋণের হার ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ব্যাংকটি ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। তবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কর্মকর্তাবৃন্দরা আশা করছেন, আগামী জুন থেকেই ব্যাংকটির মুনাফায় ফিরবে। এখন কোন দুর্বলতা থাকলে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে আরও শক্তিশালী করা উচিত। কিন্তু বিকেবির সঙ্গে একীভূত করার বিপক্ষে মত তাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, রাকাব ও বিকেবিকে একীভূত করলে ম্যানেজমেন্ট শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিক-গুলোই বেশি। এর ফলে উত্তরবঙ্গের-অর্থনীতি অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। কারণ বিকেবি তো উত্তরবঙ্গ-ভিত্তিক ব্যাংক নয়। এর ফলে উত্তরবঙ্গ অনেকটা অবহেলিত হতে পারে। কারণ, রাকাবেরও অনেক শাখাই দুর্বল, পারফরমেন্স কম। তারপরও কৃষকের স্বার্থে খোলা রাখা হয়েছে। এগুলো বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। এছাড়াও শাখাগুলোতে ফান্ড চ্যানেলিং খুব কম হবে। ব্যাড পারফরমেন্সের কারণে অনেকেই চাকরি হারাবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইলিয়াছ হোসেন আরও বলেন, বিকেবির খেলাপি ঋণ বেশি। সেটা রাজশাহী ও রংপুরের বাইরের গ্রাহকের। দুইটি ব্যাংক একীভূত হলে এই অঞ্চলটা বিকেবির দায়ের মধ্যে পড়ে যাবে। অন্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে ’ক্যাশ ফ্লো’ কম হবে। কারণ ব্যাংকের নিয়মই এটা যে অঞ্চলে পারফরম্যান্স ভালো হবে, সেই অঞ্চলে ’ক্যাশ ফ্লো’ বেশি হবে। এতে উত্তরবঙ্গের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এতে হয়ত বিকেবির উপকার হতে পারে, কিন্তু উত্তরবঙ্গের যে কৃষি ও কৃষির বিভিন্ন উপখাতগুলো রাকাব থেকে সহযোগিতা পেয়ে থাকে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিকেবির সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে দুইবার বঙ্গবন্ধু কৃষিপদকপ্রাপ্ত রাজশাহীর কৃষক মনিরুজ্জামান মনির জানান, ধরুন আপনি সুস্থ মানুষ। আপনার কাঁধে একটা অসুস্থ মানুষকে তুলে দিলাম। তাহলে আপনার স্বাভাবিক চলার গতি থাকবে না। একইভাবে রাকাবের ওপর বিকেবির মতো লোকসানি ব্যাংককে তুলে দিলে রাকাবেরও স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা হ্রাস পাবে। একজন সাধারণ কৃষক হিসেবে আমি এটাই বুঝি। এরপরও সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে, এখন আমরা সহজেই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যেতে পারি। দুই ব্যাংক একীভূত হলে এটা হবে না। তখন প্রধান কার্যালয়ের জন্য যেতে হবে ঢাকায়।
রাকাবকে একীভূত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে সতর্ক করে পোস্ট দিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন। তিনি লেখেন, ‘সাবধান! উত্তরের প্রাণ রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে আবার ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে।’ যোগাযোগ করা হলে সফিউদ্দিন বলেন, রাকাবের প্রধান কার্যালয় রাজশাহীতে। যে কোন সমস্যায় প্রান্তিক কৃষকেরা প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সহজেই সমস্যার সমাধান পান। বিকেবীর সঙ্গে একীভূত হলে কৃষকদের ঢাকায় যেতে হবে। এতে কৃষকের দুর্ভোগ বাড়বে। রাকাবের ব্যবস্থপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, রাকাব ও বিকেবির পারফরমেন্স নিয়ে গভর্নর স্যার মিটিং করেছেন। পত্রিকায় এসেছে যে দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা আনুষ্ঠানিক চিঠি পাইনি। কবে সমঝোতা স্মারক সই হবে সেটাও জানি না। দুই বোর্ডের সিদ্ধান্ত না হলে হবে না। এই প্রক্রিয়াটা লম্বা হবে। তবে প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরুর ব্যাপারে সমঝোতা হতে পারে।
রাকাবের ব্যবস্থপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ আরও বলেন, রাকাব অনেক স্ট্রং ব্যাংক। বিকেবির সঙ্গে একীভূত হলে রাকাবেরই ক্ষতি হবে। আমার বাড়ি কুমিল্লায়। অন্যবঙ্গের মানুষ। সোনালী ব্যাংক থেকে রাকাবে এসেছি। কিন্তু দেখছি, উত্তরবঙ্গের কৃষিতে রাকাবের যে অবদান সেটা অনেক বড়। এটা টাকার অংকে পরিমাপযোগ্য না। কিন্তু আমরা সরকারি চাকরি করি। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষতিটা মানতেই হবে।