শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
সিলেটের তারাপুর চা বাগানের বন্দোবস্ত নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতির মামলায় সিলেটের ব্যবসায়ী রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাইকে চারটি ধারায় মোট ১৪ বছর কারাদ-ের রায় দিয়েছে আদালত।
সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরো বৃহস্পতিবার জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় ঘোষণা করেন।
এ আদালতের অতিরিক্ত পিপি মাহফুজুর রহমান রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলায় পাঁচটি ধারায় দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪৬৬ ধারায় ৬ বছর, ৪৬৮ ধারায় ৬ বছর, ৪৭১ ধারায় ১ বছর এবং ৪২০ ধারায় ১ বছরের সশ্রম কারাদ-ের রায় হয়েছে।
রায়ের সময় রাগীব আলী ও তার ছেলে আদালতেই উপস্থিত ছিলেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর সিলেটের ধনাঢ্য এই ব্যক্তি ও তার ছেলে পালিয়ে ভারতে চলে গেলেও গতবছর শেষ দিকে তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
মামলা বৃত্তান্ত
তারাপুর চা বাগান নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর ১৯৯৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। ২০০৫ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতি এবং সরকারের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা করে।
এর বিরুদ্ধে রাগীব আলী উচ্চ আদালতে গেলে দীর্ঘদিন পর চলতি বছরের শুরুতে তার নিষ্পত্তি হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত ১৯ জানুয়ারি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা পুনরায় চালুর নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে তারাপুর চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়। ওই আদেশের পর ১৫ মে চা-বাগানের বিভিন্ন স্থাপনা ছাড়াও ৩২৩ একর ভূমি সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন।
মামলা হওয়ার ১১ বছর পর সিলেটে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত সুপার সারোয়ার জাহান গত ১০ জুলাই ওই দুই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
এর মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির মামলায় রাগীব আলী ও তার ছেলেকে আসামি করা হয়। আর প্রতারণা মামলায় রাগীব আলী, তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, রাগীব আলীর আত্মীয় মৌলভীবাজারের রাজনগরের বাসিন্দা দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই, জামাতা আবদুল কাদির ও মেয়ে রুজিনা কাদিরকে আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ৪২২ দশমিক ৯৬ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা তারাপুর চা-বাগান পুরোটাই দেবোত্তর সম্পত্তি। ১৯৯০ সালে ভুয়া সেবায়েত সাজিয়ে বাগানটির দখল নেন রাগীব আলী।
ওই দুই মামলায় গত ১০ আগস্ট রাগীব আলী ও তার একমাত্র ছেলে আবদুল হাইসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে সিলেটের আদালত। ওই দিনই জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সপরিবারে ভারতে পালিয়ে যান তিনি।
গতবছর ১২ নভেম্বর ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে রাগীব আলীর ছেলে আব্দুল হাইকে গ্রেপ্তার করে জকিগঞ্জ ইমিগ্রেশন পুলিশ। ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় লুকিয়ে দেশে ফেরার চেষ্টার ২৪ নভেম্বর ভারতে গ্রেপ্তার হন রাগীব আলী। ওই দিনই তাকে দেশে এনে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার।
আত্মসাত ও প্রতারণা মামলার আসামিদের মধ্যে রাগীব আলী, আবদুল হাই ও মোস্তাক মজিদ কারাগারে রয়েছেন। জামিনে আছেন সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত। আর রাগীবের জামাতা আবদুল কাদির ও মেয়ে রুজিনা পলাতক।
কে এই রাগীব আলী
আটাত্তর বছর বয়সী রাগীব আলী বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। ওই ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চা বাগান থেকে শুরু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও মিডিয়াতে ছড়িয়ে আছে তার ব্যবসা।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চা বাগানের ব্যবসার লাভের কিছু অংশ দান করে রাগীব আলী সিলেটে ‘দাতা’র খ্যাতি পান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে ‘শিক্ষানুরাগী’ নামও কুড়ান।
ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের নিয়ে প্রকাশিত বার্ষিক সাময়িকী ‘হু’জ হু’র তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৬ সালে ১৮ বছর বয়সে লন্ডনে যান রাগীব আলী। সেখানে শেয়ার বাজার, বিমা, আবাসন ও রেস্তোরাঁ ব্যবসা করে তিনি বিত্তশালী হন। পরে দেশে এসে ব্যবসায় হাত দেন।
সাউথইস্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, রাগীব আলী সিলেট টি কোম্পানি লিমিটেড, কর্ণফুলী টি কোম্পানি লিমিটেড, রাজনগর টি কোম্পানি লিমিটেডের মালিক।
ইউনিয়ন সিন্ডিকেট লিমিটেড, রাগীব আলী সিকিউরিটিজ লিমিটেড, দৈনিক সিলেটের ডাকে তার মালিকানা রয়েছে। ইংরেজি দৈনিক ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেসের পর্ষদেও তার নাম রয়েছে।
সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, লিডিং ইউনিভার্সিটি ও ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তিনি। এক সময় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ডেও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। নিজের, স্ত্রীর এবং মায়ের নামে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন রাগীব আলী। মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি।- বিডিনিউজ