রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
বড় মঞ্চ। বড় তারকায় ঠাঁসা দল। উপলক্ষ্যও বড়। এমন ম্যাচে জ্বলে ওঠার প্রত্যাশাই ছিল ঢাকা ডায়নামাইটসের খেলোয়াড়দের কাছে। তবে ব্যাটিংয়ে নিজেদের পুরোপুুরি চেনাতে না পারলেও রাজশাহী কিংসকে ১৬০ রানের চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্যই দিয়েছিল সাকিব আল হাসানের দল। যেটি তাড়া করতে নেমে শুরুর দিকে সম্ভাবনা তৈরি করেছিল রাজশাহীও। কিন্তু বোলারদের নৈপুণ্যে স্যামি-সাব্বিরদের হৃদয় ভেঙে ৫৬ রানের জয়ে শিরোপা নিয়েই মাঠ ছেড়েছে টুর্নামেন্টের হট ফেভারিট ঢাকা। বিপিএলের চতুর্থ আসলে সাকিবরাই চ্যাম্পিয়ন!
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে শুক্রবার আগে ব্যাট করে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৫৯ রান তোলে ঢাকা ডায়নামাইটস। ইভিন লুইসের ৪৫ ও কুমার সাঙ্গাকারার ৩৬ রানে এই সংগ্রহ দাঁড় করায় দলটি। আর তিন ব্যাটসম্যান দুই অংকে যেতে পেরেছেন। সেই সংগ্রহও মাত্র ১৩ ও ১২ রানের। জবাব দিতে নেমে শুরুর ধাক্কা সামলেছিল রাজশাহী। কিন্তু পরে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়েছে। ৩ উইকেটে ৭৬ থেকে ১০৩ রানে অল আউট তারা! ১৪ বল হাতে রেখেই শিরোপা উৎসবে মেতে ওঠেন সাকিব-ব্রাভো-নাসির-রাসেলরা। আহত হয়ে মাঠ ছাড়া কেসরিক উইলিয়ামস পরে ব্যাটিংয়ে নামতে পারেননি।
লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ১৫ রানের উদ্বোধনী জুটির পর নুরুল হাসান সোহানকে হারিয়ে এগোতে থাকে রাজশাহী। টুর্নামেন্ট জুড়ে অনুজ্জ্বল থাকা এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ব্যক্তিগত ৫ রানে আবু জায়েদের বলে রাসেলের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন।
এরপরই সাব্বির রহমানকে নিয়ে পাল্টা আক্রমণে যান মুমিনুল হক। দুজনে ৪৭ রানের জুটিতে ম্যাচের লাগাম ধরে রেখার চেষ্টা করেন। রান আউটে কাটা পড়ে ফেরার আগে ২ চারে ২২ বলে ২৬ রানের ইনিংস খেলেছেন দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে ধৈর্যশীল এক ইনিংস খেলে দলকে ফাইনালে তোলার নায়ক সাব্বির।
বেশিক্ষণ টেকেননি মুমিনুলও। সাকিবের বলে সুইপ করতে যেয়ে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরেছেন ফর্মে থাকা এই বাঁহাতি। ৩ চারে ৩০ বলে ২৭ রানের ধৈর্যশীল একটি ইনিংস খেলেছে তিনি।
মুমিনুল ফেরার আগেই প্রয়োজনীয় রানরেটটা তরতর করে বাড়তে থাকে রাজশাহীর। সেটা কমানোর ভরসা করা যেতো যার ওপর, সেই জেমস ফ্রাঙ্কলিনও (৫) এদিন শিরোপার মঞ্চে আগের ইনিংসগুলোর ফর্মটা টেনে আনতে পারেন নি। সানজামুলকে বাউন্ডারি ছাড়া করতে যেয়ে সীমানার কাছে ব্রাভোর হাতে ধরা পড়েছেন নিউজিল্যান্ড তারকা।
সেখান থেকে ম্যাচের লাগাম প্রায় পুরোটা ঢাকার হাতে তুলে নেওয়ার কাজটা করেন নিজের চতুর্থ ওভার করতে আসা সাকিব। ড্যারেন স্যামির (৬) হাতে বিশাল এক ছক্কা হজম করার পরের বলে কিংস অধিনায়ককে বোল্ড করেন ডায়নামাইটস নেতা। ৮৭ রানে স্যামির বিদায়! শিরোপা উৎসবটা অদৃশ্য ক্যামেরার সেলফিতে যেন ওখানেই করে নেয় ঢাকা!
পরে ষষ্ঠ উইকেট হিসেবে সামিত প্যাটেলকে (১৭) সাজঘরে পাঠিয়ে যে অবশিষ্ট শঙ্কাটুকু ছিল সেটিও দূর করে দেয় ডায়নামাইটসরা! সেখান থেকে বাকি থাকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা। মেহেদি হাসান মিরাজ (১) ও ফরহাদ রেজারা (২) ব্যর্থ হয়ে ফিরলে দ্রুতই গুটিয়ে যায় কিংসরা।
শিরোপা উৎসবের দিনে বল হাতে দারুণ পারফর্ম করেছেন সাকিব, সানজামুল ইসলাম ও আবু জায়েদ রাহি। প্রত্যেকেই ২টি করে উইকেট তুলে নিয়েছেন। এছাড়া ১টি করে উইকেট গেছে আন্দ্রে রাসেল ও ডোয়াইন ব্রাভোর দখলে। এর আগে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম ওভারের শেষ বলেই সুযোগ দিয়েছিলেন মারুফ। কিন্তু প্রথম স্লিপে অনেকটা লাফিয়ে উঠেও বলটা তালুবন্দী করতে পারেননি অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি। পরের ওভারে আরেকবার বাতাসে বল ভাসিয়ে বেঁচে গেছেন এই ওপেনার। দুজন ফিল্ডার দৌড়ে এলেও কেউই তার ক্যাচটি নিতে পারেননি ফরহাদ রেজার বলে। তবে সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে পারেননি টুর্নামেন্ট জুড়েই দুর্দান্ত ব্যাটিং করা ঢাকার এই ব্যাটসম্যান। চতুর্থ ওভারে বোলিংয়ে এসেই তাকে সাজঘরের পথ দেখান মেহেদী হাসান মিরাজ। উইলিয়ামসের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে নামের পাশে কেবল ৮ রানই জমা করতে পেরেছেন। দুর্দান্ত শুরু করা মিরাজ সেই ওভারেই ওয়ানডাউনে নামা নাসির হোসেনকে দুবার ফাঁদে ফেলার খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। পরে আফিফ হোসেন ধ্রুবর করা ম্যাচের পঞ্চম ওভারের চতুর্থ বলে বেরিয়ে এসে মারতে গিয়ে প্যাটেলের হাত ফসকালে আরেক দফা বেঁচে যান নাসির। সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারেননি জাতীয় দলের বাইরে থাকা এই অলরাউন্ডারও। এক বল পরেই ৫ রান করা নাসিরকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে উল্লাসে মাতেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপিএল চমক আফিফ। ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার মিশনে ঢাকা তখন তাকিয়ে আরেক দেশি তারকা মোসাদ্দেক হোসেনের দিকে। কিন্তু ষষ্ঠ ওভারের শেষ বলে এই তরুণকে (৫) এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে শুরুতে ক্যাচ ফেলার প্রায়শ্চিত্ত করেন রাজশাহীর অধিনায়ক স্যামি। ৪২ রানে ৩ উইকেট হারায় ঢাকা। এরপরই পথ হারাতে থাকা ঢাকাকে টেনে তুলতে উদ্বোধনী এভিন লুইসের সঙ্গে যোগ দেন অভিজ্ঞ কুমার সাঙ্গাকারা। ৫ নম্বরে নেমেছেন সাঙ্গাকারা। ব্যাট করছেন ১৯.৫ ওভার পর্যন্ত। দুজনে ৪১ রানের জুটি গড়ে বিপদ কাটিয়ে ওঠার পথেই হাঁটছিলেন। কিন্তু সেটাকে আর বাড়তে দেননি ফরহাদ রেজা। দারুণ খেলতে থাকা এভিন লুইসকে উইলিয়ামসের ক্যাচ বানিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকা জুটিটি ভাঙেন তিনি। ফেরার আগে ৮ চারে ৩১ বলে ৪৫ রানের ঝলমলে একটি ইনিংস উপহার দিয়েছেন এই ক্যারিবিয়ান। ডোয়াইন ব্রাভো বিশাল একটি ছক্কা হাঁকিয়ে অন্যরকম কিছুর বার্তাই দিয়েছিলেন এরপর। কিন্তু ১টি করে চার-ছয়ের পর মুমিনুল-মিরাজের যৌথ প্রযোজনায় রান আউটে কাটা পড়ে ১০ বলে ১৩ রানেই থামতে হয় তাকে। ঢাকার বিপদ আরো বাড়তে পারতো ১৫তম ওভারে। নাজমুলের বলে বাউন্ডারির কাছে আন্দ্রে রাসেলের দেওয়া ক্যাচ তালুতে জমাতে না পেরে সেসময় সুযোগ হাতছাড়া করেন সাব্বির। রাসেলের রান তখন ৬! সেটির সঙ্গে অবশ্য আর দুই রানের বেশি যোগ করতে পারেননি এই ক্যারিবিয়ান। রাসেলের আউটটিতে অবশ্য মিশে থাকল রোমাঞ্চ। প্যাটেলের বলে বাউন্ডারি সীমানার অনেকটা কাছে তার ক্যাচটি যখন ফরহাদ রেজা তালুবন্দী করেন, ততক্ষণে পায়ের স্পর্শ পৌঁছে গেছে সীমানায় কাছাকাছি জায়গায়। সেটি দেখে চতুর ফরহাদ বলকে বাতাসে তুলে দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে ছিটকে পড়েন। আবার সেখান থেকে মাঠে ফিরে বলটা আবার তালুতে জমান। তাতে সাজঘরে ফেরা নিশ্চিত হয় রাসেলের। এমন ক্যাচ চোখে লেগে থাকার মতো। এরপর ক্রিজে আসেন অধিনায়ক সাকিব। অন্যপ্রান্তে মাটি কামড়ে থাকা সাঙ্গাকারা। কিন্তু লঙ্কান কিংবদন্তিকে বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে পারেননি টুর্নামেন্ট জুড়েই নামের প্রতি সুবিচার করতে না পারা সাকিব। ফরহাদের বলে বোল্ড হওয়ার আগে ২ চারে ৭ বলে কেবল ১২ রানের অবদানই রাখতে পেরেছেন তিনি। সাঙ্গাকারা অবশ্য প্রায় শেষ ওভার অবধি লড়েছেন। সংগ্রহটা যে লড়ার মতো জায়গায় পৌঁছাল সেটিও তার ৩৬ রানের সৌজন্যে। ফেরার আগে ২ চার ও ১ ছয়ে ৩৩ বলে এই ইনিংস খেলে এসেছেন সুপারস্টার। শেষদিকে সানজামুল ইসলাম ২ চারে ৫ বলে ১২ রানে অপরাজিত ছিলেন। লক্ষ্যটাকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে রাখতে রাজশাহীর হয়ে দারুণ বোলিং করেছেন ফরহাদ রেজা। ৩টি উইকেট গেছে এই অলরাউন্ডারের দখলে। এছাড়া কেসরিক উইলিয়ামস, মেহেদী হাসান মিরাজ, আফিফ হোসেন ধ্রুব, ড্যারেন স্যামি ও সামিত প্যাটেল নিয়েছেন ১টি করে উইকেট। এই শিরোপা দিয়ে ঢাকার ঘরে তৃতীয়বারের মত বিপিএলের মুকুট উঠল। তবে প্রথম দুই আসরে ঢাকা গ্লাডিয়েটর্স নামে জিতেছে ঢাকা। এখন মালিকানা বদলেও শিরোপা জিতল রাজধানীর দলটি। ঢাকা ডায়নামাইটস নামেই তৃতীয় শিরোপা এল। যার মধ্য দিয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার পর নতুন কোনো ‘চ্যাম্পিয়ন’ অধিনায়কও পেলো বিপিএল। আগের তিন আসরে অধিনায়ক শিরোপা জেতার কীর্তি ছিল মাশরাফির। এবার অধিনায়ক হিসেবে দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক স্যামিকে হারালেন সাকিব। নাম তুললেন জাতীয় দলের সতীর্থ মাশরাফির পাশে।