রাজশাহীতে অস্ত্রোপচারের আগে ‘কিডনি অকেজো হয়ে’ চার প্রসূতির মৃত্যু

আপডেট: এপ্রিল ৫, ২০২৪, ১১:১৫ অপরাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:রাজশাহীতে অস্ত্রোপচারের আগে স্যালাইন দেওয়ার পর ‘কিডনি অকেজো হয়ে’ অন্তত চার প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরও দুই প্রসূতি গুরুতর অসুস্থ হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি রয়েছেন। ঘটনাটি সম্প্রতি রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। এ ঘটনায় ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দিতে মারা যাওয়া নারীদের মধ্যে দুই-একজনের স্বজনদের ‘ম্যানেজ’ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে ওই স্যালাইন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তবে বিষয়টি জেলা সিভিল সার্জন কিংবা স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে জানায়নি বেসরকারি এই হাসপাতাল।

হাসপাতালের একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি অস্ত্রোপচারের আগে আইভি স্যালাইন দেওয়ার পর ছয় নারীর শারীরিক সমস্যা শুরু হয়। অস্ত্রোপচারের পর ধীরে ধীরে তাদের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাদের কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। হার্টে ব্লক দেখা দেয়। এভাবে একপর্যায়ে চার নারীর মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে দুজন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হাসপাতালের পরিচালক ডা. সানাউল হক মিয়াকে অন্তত ১৫ বার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হাসপাতালের ইনচার্জ ইলিয়াস হোসেনকে শুক্রবার (৫ এপ্রিল) তার অফিসে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে কমিটি হয়েছে। তারা কাজ করছেন।’ মৃত নারীদের নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে ইলিয়াস হোসেন বলেন, তিনি বাথরুমে আছেন, বেরিয়ে কথা বলবেন। পরে অসংখ্যবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

খোঁজ নিয়ে দুই নারীর নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাদের একজন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আনুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আসমা খাতুন (৩৮)। আসমার স্বামী আফজাল হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার আরও এক নারীর বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নারীর স্বামী তার কিংবা স্ত্রীর নাম-পরিচয় প্রকাশ করার অনুমতি দেননি। তিনি বলেন, ‘ভাগ্যে মৃত্যু ছিল, হয়ে গেছে। এসব বলে আর লাভ নাই।’

মারা যাওয়া আসমা খাতুন একটি বেসরকারি সংস্থার রাজশাহীর পবা উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন। তার স্বামী আফজাল হোসেন বলেন, আসমা খাতুন প্রথমবার গর্ভধারণ করেছিলেন। এক বছর ধরে প্রতি মাসেই তিনি ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. সুলতানা নাজনীন রিতার কাছে চেকআপ করাতেন। সন্তান প্রসবের সময় হলে গত ১৯ মার্চ সন্ধ্যায় স্ত্রীকে হাসপাতালটিতে ভর্তি করেন। ভর্তির পর তার স্ত্রীকে স্যালাইন দেওয়া হয়। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার স্ত্রী সন্তানের জন্ম দেন। ধীরে ধীরে তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে।

রাত ৪টার দিকে চিকিৎসকেরা জানান, আসমার দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে পড়েছে। হার্টের কার্যক্ষমতাও কমে গেছে। আফজাল হোসেন তখন বলেন, গর্ভধারণের পুরোটা সময়ই তিনি মাসে মাসে স্ত্রীকে চেকআপ করিয়েছেন। তখন কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। হঠাৎ এখন এত সমস্যা কেন? চিকিৎসকেরা তখন জানান, এটা স্যালাইনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

আফজাল হোসেন বলেন, ওই রাতেই ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব লোক ও অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে আসমাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫ মিনিট পর আসমা মারা যান। আসমার মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আপস করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে তিনি আপস করতে চান না। তিনি স্ত্রীর অপমৃত্যুর বিচার চান। এ নিয়ে তিনি মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন।

বিষয়টির জন্য কথা বলার ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুলতানা নাজনীন রিতার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নম্বরটি বন্ধ পায়া যায়।

ঘটনা তদন্তে গঠিত ৬ সদস্যের তদন্ত-কমিটি’র প্রধান হাসপাতালটির সার্জারি-বিভাগের প্রধান ডা. আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, ‘স্যালাইন দেয়ার পর কয়েকজন রোগীর ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। আমরা শুধু আসমা খাতুন’র ব্যাপারটা তদন্ত করছি। ওই স্যালাইনটা আর ব্যবহার করা হচ্ছে না। এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’

রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মো. ফারুক বলেন, ‘ঘটনাটা আজকে শুনলাম, সেটাও অন্য মাধ্যমে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছু জানায়নি। আমরা সব তথ্য চেয়েছি হাসপাতাল থেকে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। হাসপাতালের গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আনোয়ারুল কবির বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগকে ঘটনাটি না জানিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্যায় করেছেন। এটা খুবই স্পর্শকাতর ব্যাপার। আমাদের জানানো উচিত ছিল। আমরা জানতে পারলে আমাদের মতো করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম। তারা কেন আমাদের কাছে এটা লুকিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।’

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ